বর্ষায় আমহার্স্ট স্ট্রি। ফাইল চিত্র।
মরণকালে হরির নাম!
বৃষ্টিতে জলমগ্ন কলকাতার সঙ্গে এই প্রবাদবাক্যের সম্পর্ক বহু দিনের। প্রায় প্রতি বছরই একটু ভারী বৃষ্টি হলেই ডুবে যায় বিভিন্ন এলাকা। তবেই টনক নড়ে পুরসভার কর্তাব্যক্তিদের। তখন কিছু দিন ধরে সেই সমস্যার সমাধান খুঁজে বার করার চেষ্টা করেন তাঁরা। বর্ষা বিদায় নিলে সেই তৎপরতাও বিদায় নেয়। যে কারণে গত বর্ষার মরসুমে কলকাতা পুরসভার বিদায়ী প্রশাসকমণ্ডলীর চেয়ারপার্সন ফিরহাদ হাকিম কিছুটা খেদ ও রসিকতার সুরে বলেছিলেন, ‘‘বর্ষা হলেই খাল সংস্কারের কথা আধিকারিকদের বেশি করে মনে পড়ে। এই তৎপরতা বছরভর দেখাতে হবে।’’
পুরসভার তথ্য অনুযায়ী, অতীতে জল জমার জন্য শহরের বেশ কয়েকটি এলাকা (উত্তরের ঠনঠনিয়া, কলেজ স্ট্রিট, মহাত্মা গাঁধী রোড, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ থেকে শুরু করে দক্ষিণের বেহালা) বিশেষ পরিচিত ছিল। তবে গত কয়েক বছরে দেখা গিয়েছে, একটু বেশি বৃষ্টি হলেই শহরের বিস্তীর্ণ এলাকায় জল জমে যাচ্ছে। এ বছরে যেমন ই এম বাইপাস সংলগ্ন বেশ কিছু রাস্তায় বহু দিন ধরে জল জমে ছিল। জমা জলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত মনে করেন, ‘‘একটু ভারী বৃষ্টি হলেই শহর জুড়ে জল জমে যাচ্ছে। কারণ, অপরিকল্পিত নগরায়ণ। আগে শহরের পশ্চিম প্রান্তের জমা জল অপেক্ষাকৃত ঢালু পূর্ব কলকাতা জলাভূমিতে গিয়ে পড়ত। এখন সেই জলাজমি বুজিয়ে বাড়ি হচ্ছে। বাইপাসের দু’দিকে তাকালেই তা বোঝা যায়। বৃষ্টির জল যাবে কোথায়? বিপদ আমরাই ডেকে আনছি।’’
জমা জলের জেরে নাজেহাল নাগরিকদের অবশ্য পুরসভা প্রতি বছরই আশ্বাস দেয়, অমুক প্রকল্প শেষ হলে সংশ্লিষ্ট এলাকায় জল আর জমবে না। কিন্তু বছর ঘুরলে দেখা যায়, অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। কলকাতা পুরসভার প্রাক্তন ডিজি (নগর পরিকল্পনা) দীপঙ্কর সিংহের অভিযোগ, ‘‘শহরে একটানা ১০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি হলেই জল জমে গিয়ে তা যে দীর্ঘক্ষণ আটকে থাকছে, তার কয়েকটি কারণ রয়েছে। যার অন্যতম হল, ছোট-বড় ১৬টি খালের সংস্কার না হওয়া। খালগুলিতে পলি জমে যাওয়ায় বৃষ্টির জল বেরোতে পারে না। নিকাশি নালা থেকে পলি তোলার কাজেও ঘাটতি রয়েছে।’’
পুরসভার নিকাশি দফতর সূত্রের খবর, এক থেকে একশো নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে ব্রিটিশদের তৈরি ইটের নিকাশি নালা রয়েছে। ওই সব নালা প্রায় ১৪৫ বছরের পুরনো। নিকাশি দফতরের এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘ওই সমস্ত নালার রক্ষণাবেক্ষণ করাটাই আমাদের কাছে এখন বড় চ্যালেঞ্জ। ওই নালা দিয়ে আর কাজ চালানো যাচ্ছে না। বিকল্প ব্যবস্থা কী করা যায়, তা নিয়েই ভাবা হচ্ছে।’’
আজকাল খানিক ক্ষণের বৃষ্টিতেই শহরের যত্রতত্র এমন ভাবে জল জমছে যে, নিকাশি নালাগুলির রক্ষণাবেক্ষণের কাজ আদৌ হচ্ছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। দীপঙ্করবাবু বলেন, ‘‘প্রতি বছরই নিকাশি খাতে পুরসভা কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ করে। বর্ষায় কলকাতা ডুবলেই শাসকদলের প্রতিনিধিদের তরফে বলা হয়, শহরের গড়নটাই এমন যে, ঘণ্টায় ছয় মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি হলেই জল জমবে। কোটি কোটি টাকা খরচ করে কাজের কাজ কিছু কি হচ্ছে?’’
পুরসভার নিকাশি দফতরের এক প্রাক্তন আধিকারিকের কথায়, ‘‘শহরে বৃষ্টির জমা জল কতটা দ্রুত নামবে, তা প্রধানত দু’টি বিষয়ের উপরে নির্ভর করে। নিকাশি নালাগুলি কতটা পরিষ্কার রয়েছে এবং পাম্পিং স্টেশগুলি কতটা ঠিকঠাক চলছে। কিন্তু নিকাশি নালা থেকে সারা বছর পলি তোলার কাজ হয় না। ৭৪টি পাম্পিং স্টেশনের পাম্পগুলিরও অবস্থা ভাল নয়। ফল যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে।’’
পুরসভা সূত্রের খবর, ১০১ থেকে ১৪৪ নম্বর ওয়ার্ডের (যাদবপুর, গার্ডেনরিচ, ঠাকুরপুকুর, বেহালা) সংযুক্ত এলাকায় মাটির নীচে পরিকল্পিত ভাবে নিকাশি নালা তৈরি হয়নি। নেই পাম্পিং স্টেশনও। তাই জল জমার সমস্যা রয়েই গিয়েছে। যদিও সম্প্রতি কেইআইআইপি কিছু কাজ শুরু করেছে।
চড়িয়াল খাল ও মণি খালের মাধ্যমে বেহালার নিকাশির জল গঙ্গায় গিয়ে পড়ে। কিন্তু দীর্ঘ দিন ওই খাল দু’টি সংস্কার না হওয়ায় ভুগতে হচ্ছে এলাকাবাসীকে। খালপাড়ের বিভিন্ন জায়গায় জঞ্জালের স্তূপ এবং অবৈধ বসতি গড়ে ওঠায় সেই খাল সঙ্কীর্ণও হয়ে পড়ছে। নাব্যতার সঙ্গে জলধারণ ক্ষমতাও কমে যাচ্ছে।
পুরসভার বিদায়ী প্রশাসকমণ্ডলীর সদস্য তারক সিংহ বলেন, ‘‘সারা বছরই নিকাশি নালা সাফাইয়ের কাজ করে পুরসভা। সেচ দফতর শীঘ্রই খাল সংস্কারের কাজে হাত দেবে। চলতি বছরে বেশি বৃষ্টি হওয়ায় সমস্যা দেখা দিয়েছিল।’’ তারকবাবুর দাবি, নিকাশি নালা সংলগ্ন গালিপিট, ম্যানহোল ও খালে নোংরা না ফেলার ব্যাপারে মানুষকেও সজাগ থাকতে হবে। তবেই শহর মুক্তি পাবে এই যন্ত্রণা থেকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy