বেআইনি: পুরসভার তৈরি শৌচালয় দখল করে নির্মাণ সামগ্রী রাখছে সিন্ডিকেট চক্র। শিবপুর ট্রাম ডিপোর সামনে। নিজস্ব চিত্র
গত ১১ অক্টোবরের দুপুর। শিবপুরের জিসিআর ঘাট রোড মহল্লা। বস্তির আট ফুট বাই সাত ফুট ঘরে ভাত নিয়ে সবে খেতে বসেছিলেন পাকিজা বেগম। আচমকা চার-পাঁচ জন স্থানীয় যুবক মুগুর, লাঠি, ধারালো অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঢুকে পড়ল বস্তির মধ্যে। ‘বড়দা’ বলেছেন, বস্তি ফাঁকা করতে হবে। কারণ, ওখানে বহুতল উঠবে। বার বার বলার পরেও ওই পরিবার উঠে না যাওয়াতেই এমন ‘অপারেশন’। সিনেমায় যেমন দেখা যায়, অনেকটা সেই ঢঙেই বস্তির বাসিন্দাদের সামনে ওই পরিবারের চার মহিলাকে বেধড়ক মারধর করল হামলাকারীরা। মুগুরের আঘাতে গুরুতর জখম হলেন গুলনাজ পরভিন নামে এক মহিলা। পরে তাঁকে হাওড়া জেলা হাসপাতালে ভর্তি করলেন এলাকার বাসিন্দারা। সে দিনের পর থেকে ওই পরিবারের পুরুষেরা আতঙ্কে আজও ঘরছাড়া।
ওই ঘটনার কথা মনে করে আজও আতঙ্কে কেঁপে ওঠেন গুলনাজ। বললেন, ‘‘আমি সে দিন মারাই যেতাম। ওরা মারতেই এসেছিল। আবার আসবে। আতঙ্কে রাতে ঘুমোতে পারি না!’’
আরও পড়ুন : নিন্দার ঝড়, সে দিন কী লিখেছিলেন রাজ্যের প্রথম করোনা আক্রান্তের বাবা
নিজেদের ১২০০ বর্গফুট জমি বহুতল তৈরির জন্য প্রোমোটারকে দিয়েছিলেন আফসার নুর। চুক্তি ছিল, দোতলার পুরো অংশটা জমির মালিক তিন ভাইয়ের মধ্যে সমান ভাবে ভাগ হবে। অভিযোগ, পুরসভার অনুমোদন ছাড়াই চারতলা বাড়ি উঠে গিয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই বাড়িতে জায়গা পাননি আফসার ও তাঁর ভাইয়েরা। কারণ সেই ‘বড়দা’। ‘‘এলাকায় আমাদের থাকা বা না-থাকাটা ওঁর ইচ্ছের উপরেই নির্ভর করে। ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডে উনিই পুলিশ, উনিই পুরসভা, উনিই প্রশাসন। ওঁর অঙ্গুলিহেলনেই চলে সবাই। উনিই এখানকার বাহুবলী,’’ বলছেন আতঙ্কিত আফসার।
আরও পড়ুন: ১৯৮ কোটির প্রতারণা, ইউনিটেকের এমডি-র বিরুদ্ধে অভিযোগ সিবিআইয়ের
এলাকায় কোনও বহুতল তৈরি করতে হলে নির্মাণ সামগ্রী, অর্থাৎ বালি, সিমেন্ট, রড বা পাথর নিতে হয় এই সব ‘বড়দা’, ‘সিংহদা’ বা ‘খানদা’র সিন্ডিকেটের কাছ থেকেই। বাড়ি তৈরির জন্য ভিত খোঁড়া শুরু হলেই চলে আসে দাদাদের পাঠানো গুন্ডাবাহিনী। এর পরে সংশ্লিষ্ট প্রোমোটার বা বাড়ির মালিককে ‘দাদা’র দরবারে গিয়ে হাজিরা দিতে হয়। না দিলেই চলে গুলি, বোমা। এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, এই সিন্ডিকেট-চক্র এতটাই ক্ষমতাশালী যে, পুরসভার তৈরি করা শৌচাগার হয়ে যেতে পারে আস্ত একটা গোলা। যেমন, শিবপুর ট্রাম ডিপোয় হাওড়া পুরসভার ‘পে অ্যান্ড ইউজ় টয়লেট’ দখল করে সেখানেই নির্মাণ সামগ্রী রাখা হচ্ছে দিনের পর দিন। রাতে সেটাই আবার নির্মাণকর্মীদের বিশ্রামের জায়গা।
হাওড়ার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এতটা অবনতির পিছনে সিন্ডিকেট-চক্রের যে বিরাট ভূমিকা রয়েছে, বার বার তার প্রমাণ মিলেছে। শহর জুড়ে বেড়ে গিয়েছে খুন, জখম, ছিনতাই। বিভিন্ন সিন্ডিকেট-চক্রের রেষারেষি ও এলাকা দখলের লড়াই পুলিশের মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শালিমারে একটি বহুতল আবাসন তৈরি করছে কলকাতার এক নামী নির্মাণ সংস্থা। প্রথমে স্থানীয় একটি সিন্ডিকেটই নির্মাণ সামগ্রী সরবরাহ করছিল। পরে আবার এ নিয়ে তাদের সঙ্গে লড়াই শুরু হয় বটানিক্যাল গার্ডেন থানা এলাকার এক প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের। প্রভাবশালী ওই সিন্ডিকেট দাবি করে, পুরো কাজটাই (নির্মাণ সামগ্রী সরবরাহ) তাদের দিতে হবে। এ নিয়ে গত বছর বোমাবাজি ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছিল। তার পরে শালিমারের সিন্ডিকেটকে অর্ধেক কাজ ছেড়ে দিতে হয়েছিল বটানিক্যাল গার্ডেনের সিন্ডিকেটের হাতে। কিন্তু ফের ওই প্রভাবশালী সিন্ডিকেট দাবি করে, পুরো কাজটাই তাদের চাই। যা নিয়ে গোলমালের জেরে গোটা নির্মাণকাজই এখন বন্ধ। মাথায় হাত নির্মাণ সংস্থাটির।
শালিমারের সিন্ডিকেটের এক মাথার বক্তব্য, ‘‘এ ভাবে চললে ফের গোলমাল হবে। আমরা তো ছেড়ে দেব না। পুলিশকে জানিয়েও লাভ হচ্ছে না। ওই সিন্ডিকেটের মাথায় শাসকদলের বড় নেতার হাত রয়েছে।’’ (চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy