Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Bengali New Year

নতুন বছরে দূর হোক ধর্মীয় ও রাজনৈতিক আগ্রাসন

ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির আগ্রাসনকে দূর করাও জরুরি। অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার এবং ধর্মীয় বিদ্বেষকে রুখে দেওয়া বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য।

A Photograph of students

আহ্বান: সম্প্রীতির মিছিল পড়ুয়াদের। শুক্রবার, মৌলালিতে।  ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।

আফরোজা খাতুন
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০২৩ ০৬:২৪
Share: Save:

বছর বারো আগের ঘটনা। ব্যক্তিগত কাজে বাংলাদেশ গিয়েছি। অভিবাসনের (ইমিগ্রেশন) সময়ে টেবিলের অন্য প্রান্তে বসা ভদ্রলোক আন্তরিক ভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপা আপনি আমাদের উৎসবে যোগ দিতে এলেন?” ট্যাক্সি ড্রাইভারেরও একই প্রশ্ন, “আপা কলকাতা থেকে এলেন আমাদের পরব দেখতে?” তাঁদের ‘পরব’ দেখার উদ্দেশ্যেই গিয়েছি, এই বিশ্বাস থেকে তিনি আমাকে উৎসবের জৌলুস নিয়ে অনেক তথ্য দিলেন।

আমার যাওয়ার দিন চারেক পরেই ছিল ও দেশে বর্ষবরণের উৎসব। আমাদের পয়লা বৈশাখের এক দিন আগেই বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ অনুষ্ঠান হয়। ‘পরব’ নিয়ে ড্রাইভার দাদার আবেগ সে বার মিলিয়ে নিতে পেরেছিলাম। একটা গোটা দেশের বাঙালি, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিনটিকে জাতীয় উৎসব হিসেবে কী ভাবে পালন করছে, তা দেখার সুযোগ হয়েছিল। হিন্দুর নববর্ষ বা মুসলমানের নববর্ষ নয়। বাঙালির নববর্ষ। ছেলে-মেয়ে সকলেই লাল কারুকাজ করা সাদা পোশাক পরেছেন। রাজপথে জনস্রোত। সে এক মুগ্ধ করা দৃশ্য। বাংলাদেশের পহেলা বৈশাখ নিয়ে মৌলবাদীরা তখনও ফতোয়া জারি করেনি।

আমরা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরাও বাংলা বর্ষবরণ উপলক্ষে কোথাও ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’, কোথাও ‘বাংলা ভাবনা পরিক্রমা’, কোথাও বা অন্য নামে উদ‌্‌যাপন শুরু করেছি। অথচ ছোটবেলায় পয়লা বৈশাখ পালন করতাম অনাড়ম্বর ভাবে, বাড়ির পায়েস আর দোকানের হালখাতার মিষ্টি দিয়ে। অভিভাবকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ছিল না। কারণ, বাঙালি সংস্কৃতি নিয়ে তখনও দড়ি টানাটানি শুরু হয়নি। ‘আরও বেঁধে বেঁধে’ থাকার ডাক দিয়ে নববর্ষ পালনের প্রয়োজন হয়নি।

কিন্তু এখন সাড়ম্বরে নববর্ষ পালন জরুরি। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির আগ্রাসনকে দূর করাও জরুরি। অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার এবং ধর্মীয় বিদ্বেষকে রুখে দেওয়া বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য। ১৪৩০ সাল উদ্‌যাপনকে কেন্দ্র করে বাংলা ভাবনার আরও বিস্তার ঘটুক। বাংলা সংস্কৃতিকে ধর্ম দিয়ে ভাগ করা যায় না। বাংলা নববর্ষ‌ও কোনও বিশেষ ধর্মের মাহাত্ম্য প্রচার করে না। হিন্দু বাঙালি, মুসলমানবাঙালি, খ্রিস্টান বাঙালি, বৌদ্ধ বাঙালি— সব বাঙালির উৎসব বাংলা নববর্ষ। যা বাঙালি সংস্কৃতির অঙ্গ। ধর্মে ভিন্ন হলেও ভাষায়, খাদ্যাভ্যাসে, পোশাকে, জীবনাচরণে একই শিকড়ে বাঙালির অবস্থান। এই বোধে স্নাত হয়ে নতুন বছর প্রত্যাশা পূরণের প্রত্যয় নিয়ে পশ্চিমবঙ্গবাসীর জীবনে দেখা দিক।

ভাষা তো সংস্কৃতির অঙ্গ। পয়লা বৈশাখ পালন করেই কি আমরা বাংলা ভাষার উপর আগ্রাসন ভুলে যাব? বিশেষ সুযোগ-সুবিধার কথা জানাতে বছরভর বিভিন্ন সংস্থা থেকে দিনে দু’-তিনটি করে ফোন আসে। তাঁরা সকলেই মূলতহিন্দিতে কথা বলেন। বাংলায় ব্যবসা করবেন, অথচ বাংলা জানবেন না! কেন? এই প্রশ্নে তাঁরা বিস্মিত এবং বিরক্ত হন। সে বার কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে বাংলায়কথা বলছি, সেখানকার এক স্বাস্থ্যকর্মী সব উত্তর হিন্দিতে দিচ্ছেন।অসহিষ্ণু হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি বাংলা বলতে পারেন না? তিনি ঝরঝরে বাংলায় বললেন, ‘‘হ্যাঁ, আমি তো বাঙালি।’’ জোর করে তাঁর মুখ থেকে বাংলা বার করতে হল!বাঙালির বাংলা ভুলে যাওয়া অথবা ভুলিয়ে দেওয়ার প্রবণতা দেখেও আমরা কি খুব নিশ্চিন্তে থাকতে পারি? ভাষার ভিত্তিতে গঠিত এ দেশের রাজ্যগুলি। প্রত্যেকের নিজের ভাষাচর্চার স্বাধীনতা থাক। বিশেষ করে সেটা যখন নিজের রাজ্য। কিন্তু এই বাংলায় থেকে হিন্দিতে কথা বলতে না পারলে বাঙালিরচাকরির আসন যেন কমে না যায়।

চৈতন্য-লালন, রবীন্দ্রনাথ-নজরুল, রোকেয়া-প্রীতিলতার বাংলায় ধর্ম থাক ব্যক্তিগত পরিসরে। এক দিকে, ধর্মের নামে অস্ত্র হাতেভোট ধরার রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় বাংলার পরিবেশ বিষাক্ত। অপর দিকে, যুক্তিবাদের জায়গায় ভাববাদ বাড়ছে বা ভাববিলাসিতা দখল করছে। ধর্মকে গণপরিসরে আনাও বিলাসিতা নয় কি? ধর্মের বিদ্বেষকে রুখে দেওয়ার জন্য থাক আমাদের সামাজিক উৎসবের মিলনক্ষেত্র। বন্ধ হোক বাংলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় অনুষ্ঠান। কলকাতার পার্শ্ববর্তী জেলায় ধর্ম পালনের নামে নানা অপ্রীতিকর ঘটনার সাক্ষী থেকে পুরনো বছর বিদায় নিল। নতুন বছরে পশ্চিমবঙ্গবাসীর জন্য শান্তির বাতাবরণ তৈরিতে প্রশাসন আরও তৎপর থাকুক।

আমরা চাই, লিঙ্গ বৈষম্য মুক্ত এক বাংলা। পণের দাপট, বধূহত্যা, মানসিক নির্যাতন, গণধর্ষণ বাংলার বাতাসে যেন হাহাকার জাগিয়ে না তোলে। কন্যাশ্রীতে লেখাপড়া করা শ্রীময়ীরা অর্থনৈতিক ভাবেস্বাবলম্বী হোক। রূপশ্রীর প্রলোভনে প্ররোচিত হয়ে বিয়েতেই নারী জীবনের চরম সার্থকতা ভেবে যেন না বসে। এই রাজ্যের পিতৃতান্ত্রিকদৃষ্টিভঙ্গির সরকার নারীর গুণকে প্রাধান্য না দিয়ে রূপকে প্রচারে এনে, বিয়েটা প্রধান অবলম্বন বলেভাবতে শেখাচ্ছে। এবং বিয়ের খরচ মেয়েদেরই লাগে, তারও সামাজিক স্বীকৃতি সরকারি বদান্যতায় স্থায়ী হচ্ছে। বিবাহ প্রতিষ্ঠানে কে ঢুকবে বা ঢুকবে না, সেটা ব্যক্তিগত বিষয়। সরকারের নয়। কিন্তু বাংলার নাগরিকদের কর্মসংস্থানের দায়িত্ব সরকারের। দিন, মাস, বছর চাকরির ন্যায্য দাবিতে কেন পথে কাটাতে হয় এ রাজ্যের তরুণ-তরুণীদের? কেন কর্মশক্তির অপচয়? নতুন বছরে হিসেবের খাতা খুলে রাজ্য সরকার কি এই শ্রমশক্তির ক্ষয় রোধ করতে পারবে?

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy