বিতর্ক: এ ভাবে সিমেন্ট দিয়ে পাড় বাঁধিয়ে দেওয়ায় সঙ্কটে জলাশয়। নিজস্ব চিত্র
কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রকের অধীনস্থ ‘দ্য ন্যাশনাল অ্যাটলাস অ্যান্ড থেম্যাটিক ম্যাপিং অর্গানাইজ়েশন’-এর (ন্যাটমো) তরফে বছর পনেরো আগে শহরের জলাশয় ও পুকুর সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট বার করা হয়েছিল। তবে রিপোর্টটি ওই সময়ের আরও ২০ বছর আগের সংগৃহীত তথ্যের উপরে ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল। অর্থাৎ রিপোর্ট অনুযায়ী, সব মিলিয়ে ৩৫ বছর আগে শহরে পুকুর ও জলাশয়ের সংখ্যা ছিল ৮৭৩১।
বর্তমানে শহরে পুকুরের সংখ্যা কত? কলকাতা পুরসভার তথ্য বলছে, সাড়ে তিন হাজারের কাছাকাছি। অর্থাৎ, গত ৩৫ বছরে ৫২৩১টি পুকুর, জলাশয় শহরের মানচিত্র থেকে পুরোপুরি নিখোঁজ হয়ে গিয়েছে। এক পুরকর্তার কথায়, ‘‘গণিতের হিসেব বলছে, প্রতি বছরে প্রায় ১৫০টি পুকুর, জলাশয় বুজিয়ে দেওয়া হয়েছে কোনও না কোনও ভাবে।’’
সব সময়ে আলোচনার কেন্দ্রে থাকা পূর্ব কলকাতা জলাভূমির পাশাপাশি শহরের অগুনতি পুকুর, জলাশয়ের অস্তিত্বও যে বিপন্ন, শহরের বুক থেকে পাঁচ হাজার জলাশয়ের চিরতরে হারিয়ে যাওয়া সেটাই প্রমাণ করছে বলে জানাচ্ছেন পরিবেশবিদেরা। মঙ্গলবার, ‘বিশ্ব জলাভূমি দিবস’-এ বিষয়টি আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। আর এর পিছনে প্রশাসনিক গাফিলতিকেই দায়ী করছেন তাঁরা।
এ ক্ষেত্রে পরিবেশবিদেরা বছর দেড়েক আগে পুর কর্তৃপক্ষের জারি করা একটি নির্দেশিকার প্রসঙ্গ টেনে আনছেন। যে নির্দেশিকায় ‘জলতন্ত্র’ শব্দবন্ধের ব্যবহার নিয়ে কৌতূহল তৈরি হয়েছিল পুর প্রশাসনের একাংশের মধ্যে।
কী এই জলতন্ত্র? পুরকর্তাদের একাংশ জানাচ্ছেন, জলাশয় সংরক্ষণের জন্য ‘ওয়াটারবডি ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম’ (ডব্লিউবিএমআইএস) বা পুকুর, জলাশয় সংক্রান্ত তথ্যভাণ্ডারই হল এই জলতন্ত্র ব্যবস্থা। ওই ব্যবস্থায় শহরের প্রতিটি পুকুর, জলাশয়ের জন্য একটি নিজস্ব পরিচয় নম্বর (ইউনিক আইডি নম্বর) রাখা হবে। তথ্যভাণ্ডারে ‘ন্যাশনাল রিমোট সেন্সিং এজেন্সি ম্যাপ’, পুকুরের তালিকা, পুকুরের মাপ এবং পুর ‘অ্যাসেসমেন্ট কালেকশন’ দফতরে নথিভুক্ত সংশ্লিষ্ট পুকুরের মাপের সঙ্গে তার সামঞ্জস্য রয়েছে কি না, সেটি কোন ওয়ার্ড, বরো ও স্ট্রিটের অন্তর্গত এমন একাধিক তথ্য সংগৃহীত থাকবে।
কিন্তু যা উল্লেখযোগ্য ছিল তা হল, পুকুর বা জলাশয় ভরাট হচ্ছে কি না তা জানতে সরাসরি নজরদারির জন্য ‘ড্রোন’ ব্যবহারের উল্লেখ। শুধুমাত্র নজরদারি চালাতে সপ্তাহে সাত দিন, ২৪ ঘণ্টার একটি ‘ডেডিকেটেড’ কন্ট্রোল রুমের কথাও বলা হয়েছিল। ওই কন্ট্রোল রুমে বসে ড্রোনের মাধ্যমে ‘রিয়্যাল টাইম’ পরিস্থিতি দেখা সম্ভব হবে। আরও বলা হয়েছিল, পুরসভার ‘পরিবেশ ও ঐতিহ্য’ বিভাগের অস্থায়ী কর্মীদের সাইকেল দেওয়া হবে, যাতে তাঁরা সরেজমিন পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে যেতে পারেন।
কিন্তু ওই নির্দেশিকা জারির দেড় বছর পরে দেখা যাচ্ছে, ড্রোনে নজরদারি, জলাশয় সংরক্ষণের জন্য ‘ডেডিকেটেড’ কন্ট্রোল রুম, সরেজমিন পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে যেতে অস্থায়ী কর্মীদের সাইকেল দেওয়া-সহ জলতন্ত্রের অনেক শর্তই পূরণ করা হয়নি। যদিও কলকাতা পুর প্রশাসকমণ্ডলীর সদস্য স্বপন সমাদ্দারের বক্তব্য, ‘‘আগে কী হয়েছে জানি না। তবে শহরে যাতে আর পুকুর, জলাশয় বোজানো না যায়, সে ব্যাপারে উপযুক্ত পদক্ষেপ করা হচ্ছে।’’ রাজ্যের পরিবেশমন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্রেরও বক্তব্য, ‘‘অভিযোগ পেলেই আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। জলাশয় বোজানোর সঙ্গে কোনও ভাবেই আপস করা হচ্ছে না।’’
এর পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত বলছেন, ‘‘অনেক বোজানো জলাভূমিকে পূর্বাবস্থায় ফেরানোর জন্য জাতীয় পরিবেশ আদালতের নির্দেশ রয়েছে। কিন্তু তা বাস্তবায়িত করতে সরকারি উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। ফলে পুর প্রশাসন কী পদক্ষেপের কথা বলছে, তা বোঝা যাচ্ছে না!’’ পরিবেশবিজ্ঞানী তপন সাহা আবার জানাচ্ছেন, পুকুরের পাড় বাঁধানো হলে জলাশয়ের জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হয়। কিন্তু সৌন্দর্যায়নের কারণে পাড় বাঁধানো চলছেই এবং তা জলাশয়ের ‘ইকোটোন’ জ়োনের (দু’টি বাস্তুতন্ত্রের মধ্যবর্তী এলাকা) ক্ষতি করছে। তপনবাবুর কথায়, ‘‘নোংরা জল পড়লে জলাশয়ের জীববৈচিত্র্য তা শোষণ করে নেয়। কিন্তু জলাশয়ের জীববৈচিত্র্যই ক্ষতিগ্রস্ত হলে তখন আর সেটা হয় না।’’
এর ফলে ক্রমশই বুজে যেতে থাকে পুকুর। তার পরে এক সময়ে শহরের মানচিত্র থেকে তা পুরোপুরি হারিয়ে যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy