মল্লিকবাজারে রাস্তার উপরে এ ভাবেই চলছে গাড়ি সারাই। শনিবার ছবিটি তুলেছেন সুমন বল্লভ।
মহানগরে দূষণের প্রকোপ নতুন কিছু নয়। তা ঠেকাতে সরকারের নানা প্রতিশ্রুতিও আছে। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতির সারবত্তা কতটা, সেই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা-রিপোর্ট। পরিবেশ গবেষণা সংস্থা ‘টক্সিক লিঙ্ক’-এর ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, মহানগরেই রমরমিয়ে চলছে একাধিক দূষণ সৃষ্টিকারী কারখানা। তার ফলে এলাকায় দূষণ তো ছড়াচ্ছেই, সঙ্গে অসুখের প্রকোপ বৃদ্ধির আশঙ্কা বাড়ছে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে।
কোথায় কোথায় চলছে এমন কারখানা?
তপসিয়া, পিকনিক গার্ডেন, পাগলাডাঙা: তপসিয়া এলাকায় প্রকাশ্যেই বিদ্যুতের তার পুড়িয়ে ভিতর থেকে তামা, লোহার বার করা হয়। চলে সিসা গলানোর কাজও। এই জায়গাগুলিতে বর্জ্য প্লাস্টিক জমা হয়। সেই প্লাস্টিক পুড়ে যে ধোঁয়া বেরোয়, তা বাতাসকে বিষাক্ত করে তোলে। জনবসতি এলাকায় এ ভাবে বর্জ্য পোড়ানোর কুপ্রভাব পড়ে এলাকার বাসিন্দাদের উপরে। ছবিটা একই রকম পাগলাডাঙাতেও। পিকনিক গার্ডেনে আবার বর্জ্য পোড়ানোর পাশাপাশি ধাতব বর্জ্য ভাঙার কাজ চলে। তাতে যেমন বাতাস দূষিত হয়, তেমনই জলে ধুয়ে নানা বিষাক্ত রাসায়নিকও মেশে মাটিতে। পরিবেশকর্মীদের মতে, ‘অরেঞ্জ ক্যাটেগরি’-র এই সব কারখানা কলকাতা পুর-এলাকায় থাকার কথা নয়।
মানিকতলা এলাকায় ডাঁই করা হচ্ছে খোলা ব্যাটারি
ট্যাংরার চামড়াপট্টি: ২০০২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছিল, ট্যাংরা থেকে চামড়ার কারখানা সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সেই মতো বানতলায় লেদার কমপ্লেক্স তৈরি হয়েছে। কিন্তু সরেনি চামড়ার কারখানাগুলি। সেগুলি থেকে দূষিত বর্জ্য এখনও এলাকার নিকাশি নালা দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। কারখানা থেকে বিভিন্ন রাসায়নিকও বেরিয়ে এলাকার মাটি ও জলে মিশছে। কাঁচামাল ও অন্যান্য জিনিসপত্র খোলা জায়গায় ফেলে রাখায় বৃষ্টির জলে ধুয়ে এলাকায় দূষণ ছড়াচ্ছে বলে অভিযোগ পরিবেশকর্মীদের।
মানিকতলা পেয়ারাবাগান: রাস্তার পাশেই গাড়ির ব্যাটারি খোলা হচ্ছে। ফলে সিসা ও অ্যাসিডের মতো ক্ষতিকারক রাসায়নিক ছড়িয়ে পড়ছে পরিবেশে। অভিযোগ, অ্যাসিড বাষ্প থেকে বাতাসেও বাড়ছে বিষের পরিমাণ। আইন অনুযায়ী, ‘স্পেশ্যাল রেড ক্যাটেগরির’ এই কারখানাগুলিও কলকাতা পুর-এলাকায় থাকা নিষেধ। বৌবাজারের বেশ কিছু গলিতে সোনা-রুপোর কারখানাতেও বেআইনি ভাবে অ্যাসিডের ব্যবহার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ।
হাজরা-রিচি রোড, রাজাবাজার: রিচি রোডে রাস্তার পাশেই একের পর এক দোকানে বৈদ্যুতিক ও বৈদ্যুতিন সামগ্রী সারানো হয়। চলে পুরনো পণ্য ভেঙে যন্ত্রাংশ বার করার কাজও। পর্ষদের নিয়ম অনুযায়ী, এই ধরনের ‘বৈদ্যুতিন বর্জ্য’ কারখানা শহরের মধ্যে থাকতে পারে না। কারণ, এই সব যন্ত্রাংশ থেকে সিসা-সহ একাধিক বিষাক্ত রাসায়নিক পরিবেশে মিশতে পারে। তা হলে এই কাজ চলছে কী করে? ‘টক্সিক লিঙ্ক’-এর সমীক্ষা বলছে, শুধু হাজরা নয়। একই ধরনের ব্যবসা রমরমিয়ে চলছে রাজাবাজারেও। এবং সেগুলির কোনওটিরই অনুমোদন নেই।
মল্লিকবাজার: রাস্তার পাশেই সার সার গাড়ি সারাইয়ের দোকান। দিনভর সে সব দোকানে ঠুং-ঠাং করে কাজ তো চলেই, উপরন্তু সে সব ‘ভাঙাগড়া’ থেকে বাতাসে মেশে নানা ধরনের ধূলিকণা। রাস্তার
পাশেই ঢালা হয় নানা ধরনের আঠা, ব্রেক অয়েল, মোটর অয়েল। তা-ও মেশে পরিবেশে। বিজ্ঞানীদের অভিযোগ, সমীক্ষায় জানানো হয়েছে এই দূষণের কথাও।
পরিবেশ রক্ষায় রাজ্যে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ রয়েছে। তার পরেও মহানগরে এত দূষিত কারখানা
চলছে কী ভাবে?
পর্ষদের বক্তব্য, কলকাতায় কিছু কিছু এলাকায় এমন কারখানার কথা জানা রয়েছে তাদের। কিন্তু বহু মানুষের রুজির কথা মাথায় রেখেই তড়িঘড়ি সেগুলি বন্ধ করা সম্ভব নয়। কিন্তু পর্ষদের আইন অনুযায়ী তো শহরের মধ্যে এমন দূষিত কারখানা থাকারই কথা নয়। তা হলে সেগুলি গজিয়ে ওঠার সময়েই ব্যবস্থা নেওয়া হল না কেন? পর্ষদের এক শীর্ষকর্তার বক্তব্য, ১৯৯৭ সালে তৈরি হওয়া নীতিতে নতুন করে এমন কারখানার অনুমতি দেওয়ার কথা নয়। পুরনো কারখানাগুলির ক্ষেত্রে বেশ কিছু পদক্ষেপ করার কথা বলা হয়েছিল। সেই পদক্ষেপ করা হয়নি কেন? পর্ষদের বক্তব্য, কোন এলাকায় কী ব্যবসা হচ্ছে, তা জানতে ট্রেড লাইসেন্সের উপরে নির্ভর করা হয়। ‘‘কিন্তু এই ধরনের ব্যবসাগুলিতে ট্রেড লাইসেন্সই থাকে না,’’ দাবি ওই পর্ষদ কর্তার।
পর্ষদের প্রাক্তন মুখ্য আইন অফিসার বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় অবশ্য জানান, বহু বছর আগে কেএমডিএ-কে সঙ্গে নিয়ে একটি সমীক্ষা করা হয়। তার রিপোর্টে কলকাতার কোন এলাকায় কী কী কারখানা রয়েছে, তার তালিকা রয়েছে। তা দেখলেই এই সব ব্যবসার হাল-হকিকত জানা যায়। তা ছাড়া, দূষণের অভিযোগ উঠলে পর্ষদ ব্যবস্থা নিতেই পারে বলে দাবি
করেন বিশ্বজিৎবাবু।
আচমকা এই ধরনের ব্যবসা বন্ধ করে দিলে সমস্যা হতে পারে, তা মানছেন ‘টক্সিক লিঙ্ক’-এর প্রোজেক্ট ম্যানেজার মোনালিসা দত্তও। তবে তিনি বলেন, ‘‘ট্যানারিগুলিকে তো সরানো যেতেই পারে। ব্যাটারি,
সিসা নিয়ে যে সব কারখানা কাজ করছে, সেগুলিকেও শহরের বাইরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত।’’ এ ব্যাপারে পর্ষদের নীতি ঠিক মতো প্রয়োগের দাবিও তুলেছেন তিনি। রুটিরুজি বন্ধ না করে বিকল্প দাওয়াই দিয়েছেন গভর্নমেন্ট কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড লেদার টেকনোলজির এনভায়রনমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষিকা অনুলিপি আইচ। তাঁর মতে, ‘‘প্লাস্টিকের মতো কঠিন বর্জ্যের ব্যবসাকে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় স্থানান্তরিত করা যেতে পারে। সেগুলি পোড়ালে দূষিত ধোঁয়া যাতে সরাসরি বাতাসে না মেশে, তার জন্য যন্ত্রও বসানো সম্ভব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy