গত ৭ অগস্ট থেকে সিমা-র গ্যালারিতে শুরু হয়েছে প্রদর্শনী। গ্যালারিতে স্থান পেয়েছে সোহম গুপ্ত এবং বিশাল ভান্ড-সহ ছয় শিল্পীর ‘আর্ট ওয়ার্ক’।
এ-ও এক লড়াই। করোনা ও লকডাউনের বিরুদ্ধে লড়াইটা শিল্পের। বিশ্বের কয়েকটি প্রান্তে ধীরে ধীরে খুলছে বিভিন্ন আর্ট গ্যালারির দরজা। কলকাতাতেও সেই লড়াইটা শুরু করল সেন্টার অব ইন্টারন্যাশনাল মর্ডান আর্ট (সিমা)। দর্শকদের জন্য শিল্পের সম্ভার সাজিয়ে তুলল তারা গ্যালারিতে। এই মুহূর্তে কলকাতায় সিমা ছাড়া আর সব গ্যালারিই কার্যত বন্ধ। কোনও গ্যালারিতে ছবি-ভাস্কর্য-ইনস্টলেশন আর্ট প্রদর্শিত হচ্ছে না। ফলে সামনাসামনি শিল্পকর্ম দেখার সুযোগও নেই দর্শকদের। তবে সিমা শুরু করার পর অন্যরাও গ্যালারি খোলার ভাবনাচিন্তা করছে।
লড়াই কেন? সিমা-র ডিরেক্টর রাখী সরকার বলছেন, “অনেক বাধা ছিল। একে করোনা পরিস্থিতি, তায় লকডাউন। নানা রকম সমস্যা। সে সবের মধ্যেই কোথাও একটা শুরু হওয়ার দরকার ছিল। এ এক লড়াই। প্রায় জোর করেই শুরু করলাম।’’ করোনা পরিস্থিতিতে কলকাতায় গ্যালারির এই দরজা খুলে দেওয়াকে সিমা-র সাহসী পদক্ষেপ বলেই মনে করছে শিল্প মহল।
ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ভার্চুয়াল প্রদর্শনীর আয়োজন করছে অনেক গ্যালারি। কিন্তু ভার্চুয়াল প্রদর্শনীতে শিল্পী থেকে রসিক জন, সকলেরই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর অবস্থা। শিল্পী বিশাল ভান্ড যেমন বলছেন, ‘‘আমি শান্তিনিকেতনের কলাভবনের ছাত্র। সেখানে পড়ার সময় ভ্যান গগের ছবি দেখেছি। পরে যখন আমস্টারডামে গিয়ে তাঁর আসল ছবি দেখলাম, তুলির স্ট্রোকগুলো চমকে দিয়েছিল! এটাই আসল ছবি দেখার মজা। ভার্চুয়ালে সেটা সম্ভব নয়।’’
সিমা-র গ্যালারিতে ইনা কউর-সহ ছয় শিল্পীর ৫৬টি শিল্পকর্ম দেখার সুযোগ থাকবে আগামী ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।
বিশাল একা নন। এই ভাবনাটা শিল্পীদের সকলের। আর সেই আবেগটাকেই ধরতে চেয়েছে সিমা। রাখী যেমন বলছেন, ‘‘এখন আমাদের এখানে যে প্রদর্শনীটি চলছে, কী অসাধারণ সব অন্তর্মুখী কাজ! যে সময়ে শুরুর করার ভাবনা ছিল, তা কিছুটা পিছিয়েই শুরুটা করতে হয়েছে। শিল্পীদের স্বার্থেই এটা করার প্রয়োজন ছিল।’’
গত ৭ অগস্ট থেকে সিমা-র গ্যালারিতে শুরু হয়েছে প্রদর্শনী। কিন্তু এই ‘শুরু’র কাজটা মোটেও সহজ ছিল না। নানা ধরনের বাধার মুখোমুখি হতে হয়েছে। ক্যুরিয়র বন্ধ ছিল। লকডাউনের সময়ে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ছবি আসতেও দেরি হয়েছে। তা সত্ত্বেও, এ প্রজন্মের নামী শিল্পীদের সৃষ্টি দর্শকদের সামনে আনতে বদ্ধপরিকর ছিলেন সিমা কর্তৃপক্ষ। ছয় শিল্পীর একেবারে ভিন্ন স্বাদের কাজ গ্যালারিতে ঘুরে দেখতে পারবেন দর্শক। তবে, মানতে হবে করোনার নিয়মবিধি।
কলকাতায় যেমন সিমা শুরু করেছে, তেমনই লন্ডনের বিখ্যাত টেট মর্ডান গ্যালারিতেও প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। করোনার কারণে নিয়মবিধি মানা হচ্ছে সেখানেও। টেট-এর তরফে স্টিভেন স্মিথ বলেন, ‘‘গ্যালারিতে মানা হচ্ছে সমস্ত রকম সুরক্ষাবিধি। দর্শকরা যাতে দূরত্ববিধি চলেন, তা-ও নিশ্চিত করা হচ্ছে। গ্যালারিতে একসঙ্গে যত সংখ্যক দর্শক আগে প্রবেশ করতে পারতেন, এখন তার মাত্র ৩০ শতাংশকে আমরা ভিতরে আসতে দিচ্ছি। সরকারি নির্দেশ মেনে মাস্ক পরতে হচ্ছে।’’
রেশমি বাগচি সরকারের শিল্পকর্ম।
সুরক্ষাবিধি চালু করা হয়েছে এখানেও। সিমা-তেও গ্যালারির ভিতরেও করোনার যাবতীয় নিয়মবিধি মানা হচ্ছে। একসঙ্গে ১০ জনের বেশি করিডোরে ঢোকানো হচ্ছে না। গ্যালারিতে ঢোকার সময় থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে শরীরের তাপমাত্রা মাপা হচ্ছে। হাত স্যানিটাইজ করতে হচ্ছে ভাল করে। মুখে মাস্কও বাধ্যতামূলক। গ্যালারিতে সিমার তরফে যাঁরা থাকছেন, তাঁরা সকলে গ্ল্যাভস, মাস্ক এবং ফেস শিল্ড পরে থাকছেন। তবে সিমার ওয়াবসাইটে ভার্চুয়াল প্রদর্শনীও দেখা যাবে।
সিমা-য় ছয় শিল্পীর ৫৬টি শিল্পকর্ম দেখার সুযোগ থাকবে আগামী ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এই প্রদর্শনীর নাম দেওয়া হয়েছে ‘মিক্সড মিডিয়া’। ক্যানভাসে আঁকা ছবি তো রয়েইছে, কেউ আবার ক্যানভাস হিসাবে বেছে নিয়েছেন হ্যান্ডমেড পেপার। কেউ আবার কাপড়ের উপরেই রেখেছেন শিল্প সত্ত্বার ছাপ। ইনা কউর, সোহম গুপ্ত, কিংশুক সরকার, রেশমি বাগচি সরকার, শ্রেয়সী চট্টোপাধ্যায়, বিশাল ভান্ডের ‘আর্ট ওয়ার্ক’ স্থান পেয়েছে সিমা গ্যালারিতে। মানুষের দৈনন্দিন জীবন, প্রকৃতির সঙ্গে তাদের সম্পর্কের নানা ধরনের ভাবনা যেমন ফুটে ওঠেছে ক্যানভাসে, তেমনই সাধারণ মানুষের জীবন, তার বেঁচে থাকা এবং জীবন চর্চার বিষয়ও শিল্পীরাতুলে ধরেছেন তাঁদের শিল্পকলায়।
শ্রেয়সী চট্টোপাধ্যায় এবং কিংশুক সরকারের মতো শিল্পীদের ভিন্ন স্বাদের কাজ গ্যালারিতে ঘুরে দেখতে পারবেন দর্শক।
কলকাতায় সিমা ছাড়া অন্যান্য গ্যালারিতে এখনও পর্যন্ত প্রদর্শনী শুরু হয়নি। সরকারি তত্বাবধানে থাকা চারুকলা ভবনের গ্যালারিও বন্ধ রয়েছে লকডাউন থেকে। অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের প্রদর্শনী বন্ধ রয়েছে সেই মার্চ মাসে লকডাউন ঘোষণার পর থেকেই। পাঁচটি গ্যালারি মিলিয়ে এখনও পর্যন্ত প্রায় ১০০টি শো বাতিল হয়েছে। অ্যাকাডেমির সচিব কল্লোল বসু বলেন, “সরকারি নির্দেশে প্রদর্শনী বন্ধ। বহু শিল্পী তাঁদের শিল্পকর্ম দর্শকদের সামনে তুলে ধরতে পারছেন না।’’ তাঁর প্রশ্ন, ‘‘শিল্প সামনে থেকে না দেখলে কী করে তার সঙ্গে একাত্ম হবেন দর্শক?”
আরও পড়ুন: ভুলে যাও মোরে ভুলে যাও একেবারে
আরও পড়ুন: শক্তি দায়িত্ব নিলে অন্য রকম কৃত্তিবাস হতো
ইমামি আর্ট গ্যালারির সিইও রিচা আগরওয়ালেরও একই মত। তিনি বলেন, “ওয়েবসাইটে ভার্চুলায় প্রদর্শনী আমাদের চলছে। তবে গ্যালারিতে ঘুরে ছবি দেখার সঙ্গে কোনও কিছুর তুলনা চলতে পারে না। আবার করোনা পরিস্থিতিও মাথায় রাখতে হচ্ছে। আপাতত কেউ অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিলে, তবেই তিনি গ্যালারিতে এসে ছবি বা ভাস্কর্য দেখতে পারছেন।”
শহরে পরিচিত গ্যালারিগুলোর অন্যতম বিড়লা অ্যাকাডেমি অব আর্ট অ্যান্ড কালচার। সেখানে এখনও প্রদর্শনী শুরু না হলেও জানুয়ারিতে বার্ষিক প্রদর্শনীর জন্য নভেম্বর থেকে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হবে বলে জানালেন অ্যাকাডেমির কিউরেটর শিখা রায়। তিনি বলেন, “দূরত্ববিধি মেনে সেই সময় প্রদর্শনী হবে। তারই চেষ্টা চলছে। তবে চিত্র প্রদর্শনী হওয়া জরুরি।”
একই কথা বলছেন রাখী সরকারও। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের সকলের এগিয়ে আসা দরকার। কিছু লোক তো আসছেন। সেই শুরুটারই প্রয়োজন ছিল।’’
—নিজস্ব চিত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy