Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪

বঞ্চনার দুয়ারে কাঁটা দিয়েই উৎসব ওঁদের 

সে দিক দিয়ে ভাইফোঁটায় পরিবারের ভিতরে বা অন্তরঙ্গ পরিসরে রূপান্তরকামীদের জন্য স্বীকৃতি একটা ইতিবাচক দিক হিসেবেই দেখছেন অনেকে।

উদ্‌যাপন: বাগবাজার রিডিং লাইব্রেরিতে ভাইফোঁটায় শামিল আর এক দল রূপান্তরকামী। বৃহস্পতিবার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

উদ্‌যাপন: বাগবাজার রিডিং লাইব্রেরিতে ভাইফোঁটায় শামিল আর এক দল রূপান্তরকামী। বৃহস্পতিবার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

ঋজু বসু
শেষ আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

নিজের দাদা তো বটেই, একটা সময়ে খুড়তুতো, পিসতুতো, মামাতো মিলিয়ে জনা তেরো দাদা ও ভাই ঘিরে থাকত তাঁকে। কিশোরী বা সদ্য তরুণী ‘বোন’টির কিন্তু অদ্ভুত টানাপড়েন।

লোকাচার মেনে ফোঁটা দিলেও যম-যমুনার চিরকালীন ভাইফোঁটার মন্ত্র কিছুতেই মুখে আসত না তাঁর। শাড়ির বদলে ধুতিতে সেজে সেই ‘বোন’ তাঁর প্রাণসখী রাধারানির কাছে ভাইদের জন্য আশীর্বাদ চাইতেন। আর মনে মনে ভাবতেন, ‘ইস, আমাকে যদি কোনও দিদি ফোঁটা দিত!’ আজ, শুক্রবার,

ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার সকালে সেই ফোঁটার আশা পূর্ণ হতে চলেছে রূপান্তরকামী পুরুষ কবিরাগ পোদ্দার তথা আগেকার কেতকীর। শিলিগুড়িতে নিজের দাদাকেও এক বার ফোন করবেন কবিরাগ। কিন্তু গোখেল রোডে ‘দিদি’ রঞ্জিতা সিংহের আদর-আপ্যায়নের জন্যও তাঁর প্রাণ আঁকুপাঁকু করছে।

রঞ্জিতার কাছেও এ এক স্বপ্নপূরণের সকাল। জন্মসূত্রে পুরুষ, কিন্তু মনে নারী রঞ্জিতার ছোটবেলায় ভাইফোঁটার দিন খুঁচিয়ে

তুলত অপ্রাপ্তির যন্ত্রণা। ভাইফোঁটার এই সকালে এমন কয়েকটি যন্ত্রণারই যেন সেতুবন্ধন ঘটবে। ছোটবেলায় কখনও ভাইফোঁটা দিতে না-পারা রঞ্জিতা তাঁর স্নেহ উজাড় করে দেবেন পাতানো ভাইদের। তাঁরা কেউ কেউ আসলে রূপান্তরকামী পুরুষ।

কবিরাগ পোদ্দার ওরফে কেতকী, ঋষি বণিক ওরফে রিয়া, তাপসী দত্ত ওরফে জো, রেয়ান ঘোষ ওরফে মৌমিতা! থাকবেন বাপ্পাদিত্য মুখোপাধ্যায়, শোভন মুখোপাধ্যায়ও। বেহালায় নিজের দাদা ফোঁটা না নিন, রঞ্জিতা তাঁর পাতানো ভাইদের জন্য বৃহস্পতিবারই মোহনভোগ, ফুলকপির রসা এবং খেজুর-আমসত্ত্বের চাটনি রেঁধে রেখেছেন। সকাল সকাল লুচিটা ভেজে নিলেই চলবে। উপোস রেখে ভাইদের জন্য ‘দিদি’ রঞ্জিতা যম দুয়ারের কাঁটা দূর করার মন্ত্র পড়বেন!

আর এক রূপান্তরকামী নারী, পেশায় মডেল শ্রেয়া কর্মকারের (একদা সম্রাট) কাছে ভাইফোঁটা কিন্তু এক সময়ে আত্মীয়স্বজনের

কাছে মুখ লুকনোর দিন ছিল। নেতাজিনগরের বাসিন্দা শ্রেয়ার কথায়, ‘‘আমি ভাবতাম, ফোঁটা নেব কেন? আমি তো দেব! মাসির মেয়েরা আসতে পারে বলে বাড়িতেই থাকতাম না।’’ এ বার তিনিও এক গুচ্ছ পাতানো ভাইকে ফোঁটা দিচ্ছেন। বেলঘরিয়ার বাসিন্দা, রূপান্তরকামী পুরুষ রেয়ানকে কিন্তু প্রথম বার তাঁর মাসতুতো বোন ফোঁটা

দেবেন। পেশায় উকিল, রূপান্তরকামী পুরুষ অঙ্কন বিশ্বাস বলছিলেন, ‘‘আমি ভাগ্যবান! ছোটবেলা থেকেই আমার মা অন্তত আমি যে মনেপ্রাণে পুরুষ, তা বুঝেছেন। বাবার অস্বস্তি থাকলেও আমার বোন আমাকে ফোঁটা দিত। দিদি না বলে দাদা হিসেবেই দেখত।’’

এ দেশের সর্বোচ্চ আদালতও রূপান্তরকামী তথা তৃতীয় লিঙ্গদের অস্তিত্ব মেনে নিয়েছে। তবু এখনও বেশির ভাগ বাড়িতে

মা-বাবারা সন্তানের জন্মগত লিঙ্গ পরিচয়টাই শেষ কথা বলে ভাবেন। সে দিক দিয়ে ভাইফোঁটায় পরিবারের ভিতরে বা অন্তরঙ্গ পরিসরে রূপান্তরকামীদের জন্য স্বীকৃতি একটা ইতিবাচক দিক হিসেবেই দেখছেন অনেকে। নারী অধিকার রক্ষা কর্মী তথা অধ্যাপক শাশ্বতী ঘোষ অবশ্য মনে করাচ্ছেন, ‘‘শুধু ভাইয়ের দীর্ঘায়ু কামনার মধ্যে এক ধরনের

একপেশে দিকও আছে।’’ তবে এই দিনটির সঙ্গে দীর্ঘদিনের আবেগের সম্পর্ক তিনি অস্বীকার করছেন না। তাঁর কথায়, ‘‘যাঁকে মেয়ে বলে স্বীকৃতি পেতেই লড়তে হয়, তিনি ফোঁটা দেওয়ার সুযোগ পেলে

যে আনন্দ, সেটাও খাটো করতে পারি না। পুরুষ হিসেবে যাঁকে অনেকে মানতে চান না, দিদি বা বোনেদের ফোঁটা তাঁর কাছেও এক ধরনের বড় স্বীকৃতি। এই দিকগুলিও বোঝার ও ভাবার।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Bhaidooj Transgender Festival Civic Issues
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy