Advertisement
০৮ নভেম্বর ২০২৪
Tala Bridge

৫৭ বছরের টালা সেতুর বহনক্ষমতা এখন শূন্য

গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে বহু গুণ। অথচ ২০০০ সালের পরে সেতুর কাঠামো পরীক্ষাই করা হয়নি। বর্তমান অবস্থা কেমন? আনন্দবাজারের তরফে ঘুরে দেখলেন সেতু বিশেষজ্ঞ বিশ্বজিৎ সোমএমনিতেই যে কোনও কংক্রিটের কাঠামো নির্মাণের ২৫-৩০ বছর পরে সেটি সংস্কারের প্রয়োজন হয়। সে বাড়িই হোক বা কোনও সেতু। সেতুর ক্ষেত্রে সংস্কার আরও বেশি প্রয়োজন।

টালা সেতু।

টালা সেতু।

শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০১৯ ০২:৫৭
Share: Save:

সেই ২০০০ সালেই টালা সেতুকে ‘ফাংশনালি অবসোলিট’ বা অচল ঘোষণা করার দরকার ছিল। প্রয়োজন ছিল কোনও বিকল্প পথের কথা ভাবার। কারণ, ১৯৬২ সালে সেতুটি তৈরি হওয়ার সময় থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সেখান দিয়ে গাড়ি চলাচলের সংখ্যা ধরলে দেখা যাবে, ওই ক’বছরে সেতুর উপর দিয়ে চলা গাড়ির সংখ্যা বহু গুণ বেড়েছে। অথচ কাঠামোর ভার বহন ক্ষমতা একই থেকে গিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ২০০০ সালের পরে যখন দেশের কংক্রিটের প্রযুক্তিতে বড় পরিবর্তন এসেছিল, কাঠামোয় কত পুরু কংক্রিট ব্যবহার করা প্রয়োজন তা নিয়ে নতুন কোড বেরিয়েছিল, তার পরেও আশ্চর্যজনক ভাবে টালা সেতুর কাঠামোয় কোনও পরিবর্তন দরকার কি না, সেই পরীক্ষা করা হয়নি। বিদেশে কিন্তু নিয়মিত এই পরীক্ষা হয়। এবং প্রয়োজন মতো কোনও সেতুকে সচল বা অচল ঘোষণা করা হয়।

এমনিতেই যে কোনও কংক্রিটের কাঠামো নির্মাণের ২৫-৩০ বছর পরে সেটি সংস্কারের প্রয়োজন হয়। সে বাড়িই হোক বা কোনও সেতু। সেতুর ক্ষেত্রে সংস্কার আরও বেশি প্রয়োজন। কারণ, বাড়ির মতো স্থির ওজন বা ‘স্ট্যাটিক লোড’ এর নয়, বরং সেতু ‘রিপিটেটিভ লোড’ বা ‘পুনঃপুনঃ ওজন’ বহন করে। ফলে ৫৭ বছর আগে যে সেতু তৈরি হয়েছিল, অনেক দিন আগেই তার ভার বহন ক্ষমতা শূন্যে এসে ঠেকেছে! টালা সেতুতে যদিও ছোট গাড়ি চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কাঠামোর যা অবস্থা, তাতে কিন্তু তার উপরেও কড়া নজর রাখতে হবে। এটা ঠিকই যে, সেতু যদি নিজস্ব ওজন বহন করতে পারে তা হলে ধরে নেওয়া হয় ছোট গাড়ির ভারও সে নিতে পারবে। কিন্তু সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে, মাঝেরহাট সেতু যখন ভেঙেছিল তখন কিন্তু সেখানে কোনও বড় গাড়ি ছিল না। ফলে এ ক্ষেত্রে আরও বেশি সতর্কতা প্রয়োজন।

কাঠামো অনুযায়ী টালা সেতুতে ৩৯টি গার্ডার রয়েছে, যেগুলি একটি শক্তিশালী লোহার তার দিয়ে আড়াআড়ি ভাবে বাঁধা আছে। যাতে একক ভাবে কোনও গার্ডারের উপরে চাপ এসে না পড়ে। ৩৯টি গার্ডার যেন ঐক্যবদ্ধ ভাবে সেতুর উপরের ওজন ধারণ করতে পারে। আভিধানিক ভাবে একে বলা হয় ‘ক্রস প্রি-স্ট্রেসড ডেক’। কিন্তু যে লোহার তার দিয়ে ওই ৩৯টি গার্ডার একসঙ্গে বাঁধা রয়েছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাতে মরচে ধরেছে। সেটির ক্ষয়ও শুরু হয়েছে। ফলে পরস্পরের সঙ্গে আলগা হয়ে গার্ডারগুলির ‘ডিফারেন্সিয়াল মুভমেন্ট’ বা অসম চলন শুরু হয়েছে। রেললাইনের উপরে সেতুর যে অংশটি রয়েছে, তা দেখলেই এটা পরিষ্কার হবে। কারণ, রেললাইনের নীচের অংশের অবস্থাই সব থেকে খারাপ। কেন সেখানে নজরদারি করা হয়নি, সেটা আশ্চর্যের বিষয়। সেখানে তো কোনও গার্ডার বেরিয়ে এসেছে নীচে, কোনওটার আবার কংক্রিটের আবরণ খসে নীচের লোহার রড বেরিয়ে পড়েছে! কোথাও গার্ডারে তৈরি হয়েছে গভীর গর্ত। কোনওটার ফাঁক থেকে আবার জল পড়ছে চুঁইয়ে চুঁইয়ে। এখন কংক্রিটের ডেকের উপর থেকে জল চুঁইয়ে পড়া কিন্তু একদম শেষের ধাপ। কারণ, সেতুর উপরে জল জমা বা চুঁইয়ে পড়া তো আজকের নয়। অনেক দিন ধরেই হচ্ছে। সেটাও নজর এড়িয়ে গেল কী ভাবে? কংক্রিট ভেদ করে যখন জল প্রবেশ করেছে, তখন শুধু যে ভিতরের সিমেন্ট নষ্ট করেছে তা-ই নয়, ভিতরের লোহার রডেও মরচে ধরে তাকে দুর্বল করে দিয়েছে।

তবু বলব আমরা ভাগ্যবান যে টালা সেতু আমাদের অনেকটা সময় দিয়েছে এবং দিচ্ছেও। কারণ, মাঝেরহাট সেতুও কিন্তু টালা সেতুর মতো একই নির্মাণশৈলীর উপরে ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল। ওই সেতুর ক্ষেত্রে কী হয়েছিল, সেটা কিন্তু সকলেরই জানা!

(লেখক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ভিজ়িটিং প্রফেসর ও সেতু ডিজ়াইনার)

অন্য বিষয়গুলি:

Tala Bridge Carrying Capacity
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE