Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

ইউনেস্কোর স্বীকৃতি এলেও কি বাঁচবে হেরিটেজ!

ইতিহাস বলছে, কলকাতা পুর ভবন, কলকাতা বন্দরের ক্লক টাওয়ার-সহ শহরের একাধিক ঐতিহ্যশালী ভবন যিনি তৈরি করেছেন, সেই ডব্লিউ ব্যাঙ্কস গাইথার এই ভবনটি তৈরি করেছিলেন। এখানে তাঁর সহযোগী ছিলেন এডওয়ার্ড থর্নটন, মাইসুরুর মেমোরিয়াল ঘাটের নকশা যিনি করেছিলেন।

রাজকীয়: বি বা দী বাগের রয়্যাল ইনসিওরেন্স বিল্ডিং। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

রাজকীয়: বি বা দী বাগের রয়্যাল ইনসিওরেন্স বিল্ডিং। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

দেবাশিস ঘড়াই
শেষ আপডেট: ০৩ অগস্ট ২০১৮ ০৩:০১
Share: Save:

পুরনো দিনের ব়ড় পাখাগুলো ঘুরছে হলঘরটা জুড়ে। ঘরের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত ঝুলন্ত পাখার রাজত্ব যেন! সিলিংয়ের যেখানে পাখার দণ্ডগুলো মিশেছে, সেখান থেকে একটা লম্বা নেট টাঙানো পুরো ঘর জুড়ে। এক কর্মী জানালেন, উপর থেকে সিলিঙের টুকরো যাতে না খসে পড়ে, সে কারণেই ওই ব্যবস্থা।

দেখে কে বলবে এই ভবনকেই ব্রায়ান পল বাখ ‘ক্যালকাটা’স এডিফিস: দ্য বিল্ডিং অব আ গ্রেট সিটি’ বইটিতে বলছেন, ‘সুপার্বলি পোলাইট বিল্ডিং’! ডালহৌসি স্কোয়ারের অন্য নির্মাণগুলিকে হেরিটেজ স্থপতিরা ব্যাখ্যা করেন, ‘অ্যারোগ্যান্স’ বা ঔদ্ধত্য দিয়ে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মতো ভবনগুলিও সগর্বে যেন নিজেদের উপস্থিতি জানান দেয়। সেই ঔদ্ধত্যের মধ্যেই রয়্যাল ইনসিওরেন্সের বিল্ডিং ছিল ‘নম্র’, বলছেন হেরিটেজ স্থপতিদের একাংশ। তবে ওই অফিস ঘর যাদের, সেই সরকারি বিমা সংস্থার কর্মীদের কেউই ভবনের অবস্থা নিয়ে কিছু বলতে নারাজ। এক কর্মী বললেন, ‘‘যা দেখছেন এটাই অবস্থা। এর থেকে বেশি কিছু বলার নেই।’’ জানা গেল, সংস্কারের কথা একাধিক বার বলা হয়েছিল ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে। কিন্তু তার পরে কাজ কত দূর এগিয়েছে, সে সম্পর্কে কেউ কিছু জানেন না।

ইতিহাস বলছে, কলকাতা পুর ভবন, কলকাতা বন্দরের ক্লক টাওয়ার-সহ শহরের একাধিক ঐতিহ্যশালী ভবন যিনি তৈরি করেছেন, সেই ডব্লিউ ব্যাঙ্কস গাইথার এই ভবনটি তৈরি করেছিলেন। এখানে তাঁর সহযোগী ছিলেন এডওয়ার্ড থর্নটন, মাইসুরুর মেমোরিয়াল ঘাটের নকশা যিনি করেছিলেন।

কিন্তু সেই ভবনের ভিতরেই এখন ভঙ্গুর অবস্থা। কর্মীরা যেখানে বসে কাজ করেন, সেখানকার দেওয়ালের পলেস্তারা খসে পড়ে পুরনো দিনের ইট বেরিয়ে এসেছে। যে চিত্র শহরের অন্য বিপজ্জনক বাড়িতে দেখা যায়, অনেকটা তেমনই চিত্র ধরা পড়েছে এই ঐতিহ্যবাহী ভবনে।

তবে ঐতিহ্যে যে ‘সমূহ বিপদ’ রয়েছে, তা বোঝা গেল রয়্যাল ইনসিওরেন্স বিল্ডিংয়ের অনতি দূরের ম্যাকলয়েড অ্যান্ড কোম্পানির ভবনে গিয়ে। বিংশ শতাব্দীতে তৈরি ওই ভবন থেকেই এক সময়ে চা, কয়লা-সহ বাণিজ্যের বিস্তার শুরু হয়েছিল। সেই ভবনের ম্যানেজার ডি আর বৈদ, হেরিটেজের কথা শোনামাত্রই বললেন, ‘‘হেরিটেজ চাই না! কোনও বিতর্ক চাই না।’’ এ শহরে হেরিটেজ মানেই যে বিতর্কের বস্তু, তা আঁচ করেই বোধহয় ওই মন্তব্য। গত ২৩ বছর ওই ভবনে কাজ করছেন রামনারায়ণ রাই। বললেন, ‘‘গত ২০ বছরে আশপাশে অনেক কিছু পাল্টেছে। এই জায়গাটা তেমন পাল্টায়নি!’’

যেমন ভাবে পাল্টায়নি স্টিফেন হাউসের সিঁড়ির দেওয়াল। পানের পিকে দেওয়ালের আসল রং আগেই হারিয়েছে। বাইরে ঝকঝকে হলেও ভিতরে ঝুলভর্তি। অতীতে এক বার আগুন লেগেছিল। পরে সংস্কার হলেও বর্তমানে অনেক জায়গারই ফের অপরিচ্ছন্ন দশা। ওই ভবনে ঢুকতেই সামনে প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন করিডর। পুরনো আসবাবপত্র রাখা এক দিকের দেওয়ালে। সার দেওয়া ট্রান্সমিটার বাক্স থেকে তার বেরিয়ে রয়েছে। প্যাসেজের মধ্যে একটা অংশে লোহার স্ট্যান্ড, ত্রিপল, কাঠের বোর্ড টাঙিয়ে সংস্কারের কাজ চলছে।

স্টিফেন হাউসের অন্দরমহলে যেন পুরনো ও নতুন কলকাতার সহাবস্থান। নতুন অফিসের দেওয়ালে পানের পিক নেই, চকচকে মার্বেল। সেখানকার এক কর্মচারীর কথায়, ‘‘যাঁদের যেমন ক্ষমতা তাঁরা তেমন ভাবে সারিয়ে নিচ্ছেন। যাঁরা পারছেন না, একই রকম ভাবে রেখে দিচ্ছেন। ভবনের পুরোটাই আসলে সারানো দরকার। কিন্তু কে সারাবে!’’

এক সময় এই স্টিফেন হাউসই বাংলার রাজনীতিতে শোরগোল ফেলে দিয়েছিল। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত প্রফুল্লচন্দ্র সেন না কি স্টিফেন হাউস কিনে নিয়েছেন, এমন বিতর্কে তোলপাড় হয়েছিল রাজ্য-রাজনীতি। যদিও সেই অভিযোগের কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সে সব তথ্যও এখন বিস্মৃতপ্রায়।

ঐতিহাসিক-লেখক লিউইস মামফোর্ড এক বার বলেছিলেন, ‘আর্কিটেকচার টেলস হিস্ট্রি, ফর ইট শোজ, হাউ, অ্যান্ড হোয়াই, অ্যান্ড টু হোয়াট এন্ড পিপল হ্যাভ লিভড।’ অফিসপাড়ায় দাঁড়ালে এর থেকে বড় সত্যি আর কিছু নেই হয়তো। এক সময়ে ব্রিটিশ ভারতের মূল ভরকেন্দ্র কী ভাবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে, সেই আধারকে শুধুই কয়েকটি ভবন হিসেবে দেখলে হয়তো ঠিক হবে না। পাথর-স্থাপত্য শৈলী, নির্মাণ কৌশল সব ছাপিয়ে হয়তো এক বহমান সময় হিসেবে দেখা উচিত, বলছেন হেরিটেজ বিশেষজ্ঞেরা!

আশার কথা, ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ হিসেবে ডালহৌসি স্কোয়ারের নাম ইউনেস্কোর কাছে প্রস্তাব করা যায় কি না, তা নিয়ে সম্প্রতি রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। অবশ্য অন্য এলাকাও রয়েছে কমিশনের ভাবনায়। ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’দের হারিয়ে শেষ পর্যন্ত যদি ডালহৌসি স্কোয়ার সেই মর্যাদা পায়, তা হলে হয়তো একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হবে। একটা সংযোগ সেতু হয়তো তৈরি হবে পুরনো কলকাতার সঙ্গে নতুন কলকাতার!

তবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেলেই কি দুর্দশা ঘুচবে হেরিটেজ ভবনগুলির? সেই প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে।

কলকাতার রাজনীতি, কলকাতার আড্ডা, কলকাতার ময়দান, কলকাতার ফুটপাথ - কলকাতার সব খবর জানতে পড়ুন আমাদের কলকাতা বিভাগ।

অন্য বিষয়গুলি:

Heritage UNESCO History
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy