Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪

সংঘর্ষের মাঝে পড়ে গুলিবিদ্ধ বালক, স্পষ্ট তল্লাশির খামতি

কলকাতা পুলিশের একাধিক অপরাধ দমন বৈঠকে কমিশনার বলেছিলেন, শহর থেকে ঠিক মতো অস্ত্র উদ্ধার করা হচ্ছে না। অফিসারদের এ ব্যাপারে আরও তৎপর হতেও বলেছিলেন তিনি।

বাড়িতে মহম্মদ রায়ান। রবিবার, বেনিয়াপুকুরে। — নিজস্ব চিত্র

বাড়িতে মহম্মদ রায়ান। রবিবার, বেনিয়াপুকুরে। — নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০২:২৮
Share: Save:

কলকাতা পুলিশের একাধিক অপরাধ দমন বৈঠকে কমিশনার বলেছিলেন, শহর থেকে ঠিক মতো অস্ত্র উদ্ধার করা হচ্ছে না। অফিসারদের এ ব্যাপারে আরও তৎপর হতেও বলেছিলেন তিনি। কিন্তু শীর্ষকর্তার ওই বক্তব্য যে স্রেফ কাগজে-কলমেই থেকে গিয়েছে, ফের তার প্রমাণ মিলল শনিবার রাতে। বেনিয়াপুকুরে দুষ্কৃতীদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে এক বালকের গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায়। আহত বালকের আঘাত গুরুতর না হলেও ফের শহরের বুকে গুলি চলার এই ঘটনায় উদ্বেগ ছড়িয়েছে।

পুলিশ সূত্রের খবর, শনিবার গভীর রাতে বেনিয়াপুকুরের হরেকৃষ্ণ কোনার রোডে ওই ঘটনায় মহম্মদ রায়ান আলম নামে ওই বালকের বাঁ পায়ে গুলি লাগে। বেনিয়াপুকুর ইসলামিয়া স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র বছর দশেকের রায়ানের বাড়ি পাশের হাজি লেনে। তাকে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান এলাকাবাসীরা। হাসপাতাল সূত্রের খবর, প্রাথমিক চিকিৎসার পরে রাতেই ওই বালককে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

কী ঘটেছিল শনিবার রাতে?

পুলিশ জানিয়েছে, হরেকৃষ্ণ কোনার রোডে একটি অনুষ্ঠান বাড়ির সামনে সঙ্গীদের নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন দীপক বাল্মিকী ওরফে পাপ্পু নামে এক যুবক। সেই সময়ে তিনটি মোটরবাইকে চেপে ঘটনাস্থলে আসে ছ’জনের একটি দল। যার নেতৃত্বে ছিল সরফুদ্দিন ওরফে সারফু নামে এক দুষ্কৃতী। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পাপ্পুর সঙ্গে বচসা বাধলে সারফুদের মধ্যে থেকে এক দুষ্কৃতী গুলি ছোড়ে। পাপ্পুরা তাদের পিছনে ধাওয়া করে। পালানোর সময়ে ফের এক রাউন্ড গুলি ছোড়ে ওই দুষ্কৃতীরা।

পুলিশ জানিয়েছে, এর পরেই এলাকারবাসীরা দেখতে পান রাস্তায় শুয়ে কাতরাচ্ছে রায়ান। তার পায়ে গুলি বিঁধে রয়েছে। তাঁরাই ওই বালককে হাসপাতালে নিয়ে যান। রবিবার সকালে বাড়িতে শুয়ে রায়ান বলে,‘‘রাতে চিপ্‌স কিনে ফিরছিলাম। আচমকা বিকট একটা আওয়াজ। তার পরেই দেখি, আমার পা থেকে রক্ত বেরোচ্ছে।’’

পুলিশ সূত্রে খবর, দুই দুষ্কৃতী গোষ্ঠীর বিরোধের জেরেই এই ঘটনা। পাপ্পুর সঙ্গে সারফুদের বিরোধ অনেক পুরনো। সারফু ও তার সঙ্গী ফতে, বাপি, কালো, চিনা, কাল্টা শামিমদের বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার অভিযোগে মামলা রুজু হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, পাপ্পু বেনিয়াপুকুরের বাসিন্দা হলেও অভিযুক্তেরা সকলেই এন্টালি এলাকার বাসিন্দা। এন্টালি থানায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে একাধিক বার গুলি চালানোর অভিযোগ রয়েছে।

প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশ জানিয়েছে, এলাকা দখল নিয়ে সারফুর দলবলের সঙ্গে বিরোধ ছিল বাবলু নামে আর এক দুষ্কৃতীর দলবলের। উভয় পক্ষই শাসকদলের দুই গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ বলে পুলিশ সূত্রের দাবি। অভিযোগ, গত বছর এন্টালিতে বাবলুর দল সারফুর দলের উপরে চড়াও হয়। আহত হয় তিন জন। পুলিশ কয়েক জনকে গ্রেফতার করলেও কিছু দিনের মধ্যেই জামিন পায় তারা। এক পুলিশকর্তা জানান, জামিনে মুক্তির পরে এ বছর মে মাসে সারফুর শারগেদ কালো, বাপি এবং চুনিলালরা গুলি করে বাবলুকে। ওই ঘটনায় কয়েক জন দুষ্কৃতী গ্রেফতার হলেও সারফুর খোঁজ পায়নি পুলিশ। লালবাজার সূত্রের খবর, ঘটনার কিছু দিনের মধ্যেই আদালত থেকে জামিন পায় ওই দুষ্কৃতীরা। অভিযোগ, স্থানীয় থানার একাংশের মদতেই জামিন মেলে। গত বছর জুন মাসেও সারফুর বিরুদ্ধে এক মাংস বিক্রেতাকে গুলি করার অভিযোগ উঠেছিল। ইতিমধ্যে মাসখানেক আগে অস্ত্র মামলায় গ্রেফতার হওয়া পাপ্পু জামিনে ছাড়া পেয়ে এলাকায় ঢোকে। অভিযোগ, সারফুর বিরোধী গোষ্ঠী বাবলুর সঙ্গে যোগাযোগ করে পাপ্পু। গোয়েন্দারা জেনেছেন, পাপ্পু বেশ কিছু অস্ত্র তুলে দেয় বাবলুদের হাতে। আর সেই খবর পেয়েই শনিবার রাতে পাপ্পুর উপরে চড়াও হয় সারফুরা। গোয়েন্দাপ্রধান পল্লবকান্তি ঘোষ বলেন, ‘‘ঘটনার তদন্ত চলছে। গুলি চালানোর ঘটনায় দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’

কিন্তু একের পর এক গুলি চালানোর ঘটনা ঘটালেও কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না ওই দুষ্কৃতীদের? লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগ সূত্রের খবর, সারফু দীর্ঘদিন ধরেই পলাতক। গত সাত বছরে এক বারও সে গ্রেফতার হয়নি। এলাকাতেও থাকে না সে।

গত ফেব্রুয়ারি থেকে শনিবার পর্যন্ত মোট ১২টি গুলি চলার ঘটনা ঘটেছে শহরে। যার মধ্যে হরিদেবপুর, গিরিশ পার্ক এবং কাশীপুর উদ্যানবাটীর ঘটনা সাড়া ফেলেছে সর্বত্র। পরপর গুলি চলার ঘটনায় দুষ্কৃতী দমনে কলকাতা পুলিশের দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অনেকেই বলছেন, অপরাধ দমন বৈঠকে সিপি শহর থেকে অস্ত্র বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দিলেও তা যে পালন করা হচ্ছে না, শনিবার রাতের ঘটনাই ফের তা প্রমাণ করে দিল। লালবাজারের একটি সূত্র বলছে, ওই এলাকায় দুষ্কৃতীদের অস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করার খবর গোয়েন্দাদের একাংশের কাছে ছিল। কিন্তু কলকাতা পুলিশের শীর্ষমহল থেকেই ওই অফিসারদের বলা হয়, ওই দুষ্কৃতী শাসক দলের ঘনিষ্ঠ। তাই ধরা যাবে না। স্থানীয় বাসিন্দাদেরও অভিযোগ, সারফু, পাপ্পু দীর্ঘদিন ধরেই তৃণমূল ঘনিষ্ঠ। যদিও কলকাতার ডেপুটি মেয়র ইকবাল আহমেদ এবং স্থানীয় বিধায়ক স্বর্ণকমল সাহার দাবি, অভিযুক্তেরা তৃণমূলের কেউ নয়।

তবে লালবাজারের অন্য একটি অংশের দাবি, নিয়মিত বিভিন্ন জায়গায় অস্ত্রের খোঁজে তল্লাশি চলছে। শুধুমাত্র শেক্সপিয়র সরণিতে ব্যবসায়ীর গাড়ি লক্ষ করে গুলি চালনার ঘটনাতেই কেউ গ্রেফতার হয়নি। বাকি প্রতিটি ঘটনাতেই অভিযুক্তেরা গ্রেফতার হয়েছে। তবে পুলিশের একাংশের অভিযোগ, গ্রেফতার করা হলেও ওই দুষ্কৃতীরা তাড়াতাড়ি জামিন পেয়ে যাচ্ছেন। এক গোয়েন্দাকর্তার দাবি, ‘‘শীর্ষকর্তারা যদি বাহিনীর নিচুতলার অফিসারদের পাশে না দাঁড়ান, তবে শত চেষ্টাতেও শহর থেকে অস্ত্র উদ্ধার করা যাবে না।’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy