স্মৃতিমেদুর: ভেঙে পড়েছে বৌবাজারের বাড়ি। ফাইল চিত্র (ডান দিকে) নতুন ফ্ল্যাটে পড়াশোনায় মগ্ন অস্মিতা। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
বছর শেষে উৎসবের এই সময়েও ঘরছাড়া ওঁরা। শহরের বিভিন্ন প্রান্তে যেন এক-একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বসবাস করছেন এক-এক জন। তাই বড়দিনের মতো বর্ষবরণের উৎসবও এ বার ফিকে ওঁদের কাছে।
ওঁরা সকলেই বৌবাজারের দুর্গা পিতুরি লেন ও সেকরাপাড়া লেনের বাসিন্দা। ওই এলাকায় ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর সুড়ঙ্গ খোঁড়ার সময়ে বহু বাড়িতে ফাটল ধরে যায়। তার পরেই বহু বাসিন্দাকে সরে আসতে হয় নিজেদের বাসস্থান ছেড়ে। প্রথম কিছু দিন হোটেলে কাটানোর পরে এখন শহরের বিভিন্ন প্রান্তে মেট্রো কর্তৃপক্ষের ভাড়া করে দেওয়া বাড়িতেই দিন কাটছে তাঁদের।
কেশবচন্দ্র সেন স্ট্রিটের একটি আবাসনের চারতলায় দু’কামরার ফ্ল্যাটে পরিবার নিয়ে রয়েছেন আশিস সেন। সেকরাপাড়া লেনে তাঁদের নিজেদের বাড়ি ছিল। আশিসবাবু বলেন, “বর্ষবরণের দিন আমাদের পাড়ায় ছোটখাটো একটা জলসা হত। পাড়ার সকলেই তাতে অংশ নিতেন। দুপুরে ছোটদের বিভিন্ন রকম খেলার প্রতিযোগিতা হত। খাওয়াদাওয়া হত রাতে। এ বার কিছুই হচ্ছে না। বাড়ি সব ভেঙে দেওয়ার পরে ওখানে তো এখন বড় মাঠ!” এই অবস্থায় কি আর নববর্ষের উৎসব করা চলে?
আশিসবাবুর স্ত্রী মৌমিতা জানান, বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিলেন ৩১ অগস্ট। প্রায় কিছুই উদ্ধার করতে পারেননি তাঁরা। মেট্রো কর্তৃপক্ষ আর্থিক সাহায্য দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয়। এত ক্ষয়ক্ষতির পরে উৎসব পালনের ইচ্ছেটাই উবে গিয়েছে তাঁদের। আশিসবাবু জানান, শীতের ছুটিতে প্রতি বারই তাঁরা বেড়াতে যান। এ বার সেই সামর্থ্যও নেই।
সব চেয়ে বেশি মন খারাপ আশিসবাবুর মেয়ে অস্মিতার। হোলি চাইল্ড স্কুলের ছাত্রী অস্মিতা এ বার মাধ্যমিক দেবে। তার কথায়, “ক্রিসমাস আর নিউ ইয়ারের সময়ে বন্ধুদের সঙ্গে খুব মজা করতাম। বাড়ির ছাদে বন্ধুরা মিলে ছোটখাটো পার্টিও হত। এ বার কিছুই হবে না।” অস্মিতা জানায়, ভাঙা বাড়ির ধ্বংসস্তূপের নীচে প্রচুর বই ও পড়াশোনার নোটস চাপা পড়ে ছিল। সেগুলি উদ্ধার করা যায়নি। তাই নতুন করে আবার খাটতে হচ্ছে।
দুর্গা পিতুরি লেনের বাসিন্দা সোনাক্ষী সরকারের পরিবারকে বেলেঘাটার আলোছায়া বাসস্টপের কাছে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করে দিয়েছেন মেট্রো কর্তৃপক্ষ। সোনাক্ষী বললেন, “পয়লা সেপ্টেম্বর ভোরে বাড়ি ছেড়েছি। এখন দু’কামরার ছোট্ট ফ্ল্যাটেই নতুন বছর শুরু করব।” সোনাক্ষী জানান, নতুন বছরে পাড়ার বাসিন্দারা মিলে প্রতি বারই একটা পিকনিক হত। সেই পিকনিক এ বার বাতিল করা হয়েছে।
শুধু বাড়ি নয়, বৌবাজারের ঘটনায় সোনাক্ষীদের বাড়ির নীচে থাকা সোনার গয়নার কারখানাটিও ভেঙে গিয়েছে। তাঁর স্বামী প্রসেনজিৎ সরকার এখন কারখানার জন্য ঘর ভাড়া নিতে ছোটাছুটি করছেন। সোনাক্ষীর প্রশ্ন, “নতুন বছরে এই আর্থিক ক্ষতি সামলে উঠতে পারব তো?”
একই প্রশ্ন সেকরাপাড়া লেনের বাসিন্দা সঞ্জয় সেনের। মেট্রো কর্তৃপক্ষ ওয়েলিংটন মোড়ের কাছে একটি বাড়ির দোতলায় ফ্ল্যাট ভাড়া করে দিয়েছেন তাঁদের। সঞ্জয়বাবু জানান, বাড়ির সঙ্গে ভেঙে গিয়েছে তাঁর ছাপাখানাটিও। এখন তাঁর কাজের কোনও জায়গা নেই। ঘুরে ঘুরেই যেটুকু পারছেন, করছেন। নতুন বছরে এই অবস্থা থেকে তিনি কী ভাবে সামলে উঠবেন, বুঝে উঠতে পারছেন না। সঞ্জয়বাবুর স্ত্রী নূপুরের কথায়, “এই ফ্ল্যাটে নতুন করে সংসার পাততে হয়েছে। তার মধ্যে ব্যবসার এই হাল! এটা কি আর নতুন বছর নিয়ে আনন্দ করার সময়?”
সঞ্জয় ও নূপুরের মেয়ে সুদর্শনা বৌবাজার লোরেটোর অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। সে জানায়, পাড়ার বন্ধুরা সকলেই শহরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। তাই এ বার আরও কারও সঙ্গেই দেখা হবে না। উৎসবের চিন্তা ভুলে গিয়েছেন। সঞ্জয়বাবু এখন শুধু জানতে চান, ‘‘নতুন বছরে আমরা বাড়ি ফিরব কবে?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy