Advertisement
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪

বুজে যাওয়া বৌরানি খালই কি বিপর্যয় ডেকে আনল বৌবাজারে?

কলকাতার বহু পুরনো ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, বৌবাজার এলাকায় একটি খাঁড়ি ছিল। চাঁদপাল ঘাট থেকে হেস্টিংস স্ট্রিট, ওয়াটারলু স্ট্রিট, ওয়েলিংটন স্কোয়ার, ক্রিক রো, শিয়ালদহ, বেলেঘাটা হয়ে সল্টলেক পর্যন্ত বিস্তৃত ওই জলপথে নৌকা চলত। ছিল মাছ ধরার কারবারও। পরবর্তী সেই খাঁড়ির সংস্কার করে ব্রিটিশরা, নাম হয় বৌরানি খাল।

মেট্রো কর্তৃপক্ষ কি জানতেন না ‘বৌরানি খাল’-এর অস্তিত্ব?

মেট্রো কর্তৃপক্ষ কি জানতেন না ‘বৌরানি খাল’-এর অস্তিত্ব?

সোমনাথ মণ্ডল
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১০:০০
Share: Save:

খাল কাটা হয়েছিল বহু বছর আগে। কিন্তু প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে তা বুজে গিয়েছিল। বৌবাজারের সেই খালেই এ বার ‘কুমির’ ঢুকে পড়েছে। সুড়ঙ্গ বিপর্যয়ের পর তাই প্রশ্ন উঠছে, ইস্ট-ওয়েস্ট প্রকল্পের রুট পরিবর্তনের আগে মেট্রো কর্তৃপক্ষ কি জানতেন না ‘বৌরানি খাল’-এর অস্তিত্ব? না কি গলদ ছিল মেট্রোর সমীক্ষাতেই?

কলকাতার বহু পুরনো ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, বৌবাজার এলাকায় একটি খাঁড়ি ছিল। চাঁদপাল ঘাট থেকে হেস্টিংস স্ট্রিট, ওয়াটারলু স্ট্রিট, ওয়েলিংটন স্কোয়ার, ক্রিক রো, শিয়ালদহ, বেলেঘাটা হয়ে সল্টলেক পর্যন্ত বিস্তৃত ওই জলপথে নৌকা চলত। ছিল মাছ ধরার কারবারও। পরবর্তী সেই খাঁড়ির সংস্কার করে ব্রিটিশরা, নাম হয় বৌরানি খাল। কিন্তু, ১৭৩৭-এর ১১ জুলাই ভয়াবহ এক ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে ওই খালের একাংশ বুজে যায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নথিপত্রে সেই ঘূর্ণিঝড়ের উল্লেখ আছে। ঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৩৩৩ কিলোমিটার। ঘূর্ণিঝড় তছনছ করে দিয়েছিল সব। তার শক্তি এতটাই ছিল যে, একটি বড় নৌকা চার কিলোমিটার দূরে উড়ে গিয়ে ওয়েলিংটন স্কোয়ারের কাছে পড়েছিল। এখন যে জায়গা সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার নামে পরিচিত। খাল থাকার কারণে ওই এলাকায় একটি জায়গার নাম ডিঙাভাঙা ছিল। পরে তা ডিঙাভাঙা লেন নামে পরিচিতি পায়।

আর এই ইতিহাসকে ভিত্তি করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অলোক কুমার (মেম্বার অব ফ্যাকাল্টি) মেট্রোর সমীক্ষাকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাচ্ছেন। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘কলকাতার ভৌগোলিক এই ইতিহাস কি খতিয়ে দেখা হয়নি মেট্রোর সমীক্ষায়? অসম্পূর্ণ সমীক্ষার উপর ভিত্তি করে কী করে ওই পথে মেট্রো প্রকল্প এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল?’’

অধ্যাপক অলোক কুমার (মেম্বার অব ফ্যাকাল্টি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়)

তাঁর মতে, ‘‘ওই এলাকার নীচে রয়েছে খাঁড়ির ইতিহাস। কর্নেল মার্ক উড (১৭৮৪-’৮৫) এবং এ আপজন (১৭৯২-’৯৩)-এর মানচিত্রে আমরা বৌরানি খালের অস্তিত্ব পাই। যদি সমীক্ষা ঠিকমতো করা হয়ে থাকে, তা হলে বিষয়টি নিশ্চয়ই মেট্রোর জানার কথা।’’

আরও পড়ুন:বৌবাজার কাণ্ডে ক্ষতিপূরণ নিতে গেলে এ বার মেট্রোকে মুচলেকা দিতে হবে ঘরছাড়াদের

লন্ডনে যখন টিউব রেলের কাজ শুরু হয়, তখন ব্রিটিশ সরকার ভেবেছিল, কলকাতাতেও এমন কিছু করা যেতে পারে। ১৮৬৩ সালে লন্ডনে মাটির তলায় লাইন পাতার কাজ শেষ হয়। কলকাতার মাটির তলায় এই ধরনের প্রকল্প করা যায় কি না ১৯০৫ সালে ‘দ্য অ্যাডভাইসরি বোর্ড অব ইঞ্জিনিয়ার্স’ এবং ‘রয়্যাল কমিশন অব ট্রাফিক’ যৌথ ভাবে তা খতিয়ে দেখে। তাদের যৌথ রিপোর্টে বলা হয়, কলকাতার তলায় পিছল পলি এবং এঁটেল মাটি রয়েছে। ফলে মাটির তলায় লাইন পাতার কাজ সহজ হবে না। প্রশ্ন উঠছে, এই তথ্যও কি মেট্রোর কাছে ছিল না? ওই এলাকার পুরনো মানচিত্র বা ইতিহাস যদি খতিয়ে দেখা হত, তা হলে এই বিপর্যয়ের হাত থেকে হয়তো রক্ষা পাওয়া যেত, এমনটাই মত অলোকবাবুর।

ঘূর্ণিঝড়ে খালের মুখ বুজে গেলেও জলাশয় হিসাবে বহু দিন তার অস্তিত্ব ছিল। এলাকার নোংরা আবর্জনা ওই জলাশয়ে ফেলা হত। পরবর্তী সময়ে খাল বুজিয়ে দেওয়ার নেপথ্যে দুর্গা পিতুরি (দুর্গাচরণ মুখোপাধ্যায়)-র ভূমিকা ছিল বলে শোনা যায়। তাঁর বাড়িও ওই বৌবাজার এলাকাতে ছিল। যে হেতু সেখানে খাল ছিল, তাই ওই এলাকায় জেলেদের বসবাসও ছিল। এখনও জেলেপাড়়া লেন, সারেঙ্গা লেন, ক্রিক রো-র অস্তিত্ব রয়েছে। জেলেরা জানবাজার এবং ফেনরিক বাজারে মাছও বিক্রি করতেন। তারও ইতিহাস রয়েছে। অলোকবাবুর কথায়: “ওই এলাকা শুধু খাঁড়ির জন্য পরিচিত ছিল তা নয়। ক্রিক রো এলাকায় অরবিন্দ ঘোষের ‘বন্দে মাতরম’ পত্রিকার অফিস ছিল। রাজা সুবোধ মল্লিকের বাড়িতে সুভাষচন্দ্র বসু, বাল গঙ্গাধর তিলক, মহাত্মা গাঁধী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলামের মতো মানুষের যাতায়াত ছিল। লন্ডনের হার্লে স্ট্রিটের সঙ্গে ক্রিক রো-র তুলনা করত ব্রিটিশরা। ফলে ক্রিক রো-র ইতিহাস খুঁজে বার করা এমন কোনও কষ্টের কাজ ছিল না।”

আরও পড়ুন: বেহালায় বিজেপি কর্মীর দোকান ভাঙচুর, জ্বালিয়ে দিল বাড়ি, ফুটেজ দেখে দুষ্কৃতীদের চিনছে পুলিশ

ওই এলাকায় যে একটি খাঁড়ি ছিল, তা মেনে নিচ্ছেন নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র। তিনি বলেন, ‘‘ভাগীরথীর পূর্ব দিকে অনেকগুলো শাখা বয়ে যেত। ক্রিক রো-র কাছ দিয়ে এমন একটা শাখা ছিল যা বয়ে যায় পূর্ব কলকাতার জলাভূমির দিকে। কখনও তার জল কমেছে। কখনও বেড়েছে। কখনও বালি এসেছে। কখনও পলি। পরে তা বুজেও যায়। নদী বিবর্তনের ইতিহাসটা ওই এলাকার ভূস্তরে লুকিয়ে আছে।’’

কল্যাণবাবুর মতে, ভাগীরথী ঐতিহাসিক ভাবে একটা পেন্ডুলামের মতো নড়াচড়া করে এগিয়েছে। শহর গড়ে ওঠার পর তার নড়াচড়া কমে গিয়েছে। শহরের ভূস্তরের বৈশিষ্ট লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ভূমির উপরের দিকে একটি কাদা ও পলির মিহি স্তর রয়েছে। তার নীচে রয়েছে বালির স্তর। কল্যাণবাবুর কথায়: ‘‘মেট্রো সুড়ঙ্গ তৈরির সময় যখন টানেল বোরিং মেশিন ব্যবহার করা হয়, তখন তা ওই বালির স্তরে যেতেই চার পাশ থেকে জল এসে দ্রুত শূন্যস্থান ভরাট করে। আর তাতেই বিপত্তি বেধেছে।’’

অলোকবাবুরও দাবি, খালের ইতিহাস ছিল বলে ওই এলাকায় ‘টানেল বোরিং মেশিন’ দিয়ে সুড়ঙ্গ খুঁড়তে গিয়েই বিপর্যয় ঘটে দিয়েছে। দুর্গা পিতুরি লেন, সেকরাপাড়া লেন এবং গৌর দে লেনের নীচ দিয়ে মেট্রোর সুড়ঙ্গ নিয়ে যাওয়ার সময় এই বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কা তো ছিলই। বিপর্যয়ের পর কলকাতা মেট্রো রেল কর্পোরেশন লিমিটেড (কেএমআরসিএল)-এর তরফে বলা হয়, মাটি পরীক্ষার সময় ওই এলাকায় কোনও জলস্তর (ওয়াটার পকেট) ধরা পড়েনি। ফলে ট্যানেল বোরিং মেশিন দিয়ে মাটি কাটার সময় জল ঢুকে পড়ায় বিপর্যয় ঘটেছে। অলোকবাবু এই যুক্তি মানতে নারাজ। তাঁর মতে, বৌরানি খালের অস্তিত্ব ভুলেই মেট্রো ওই বিপর্যয় ডেকে এনেছে।

প্রাথমিক ভাবে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর যে রুট নির্ধারিত হয়েছিল, সেখানে বিবি গাঙ্গুলি স্ট্রিটের নীচ দিয়েই সরাসরি শিয়ালদহ-লালদিঘি জোড়ার কথা ছিল। সল্টলেক সেক্টর ফাইভ থেকে শিয়ালদহ, বৌবাজার, লালদিঘি হয়ে হাওড়া ময়দান পর্যন্ত প্রস্তাবিত সেই মেট্রোর রুট ২০০৮-এর ২৭ অক্টোবর অনুমোদন পায়। কিন্তু পুরনো মেট্রোর সেন্ট্রালের কাছে নতুন স্টেশন করা নিয়ে জমি জট তৈরি হয়। মহাকরণের কাছেও স্টেশন তৈরি করা নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। ফলে সেক্টর ফাইভ থেকে শিয়ালদহ স্টেশন পর্যন্ত হয়ে থমকে যায় মেট্রোর কাজ। শেষ পর্যন্ত রুট পরিবর্তন করে লালদিঘি থেকে এসপ্ল্যানেডে নিয়ে যাওয়া হয় মেট্রোর সুড়ঙ্গ। সেখান থেকে সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার হয়ে বিবি গাঙ্গুলি স্ট্রিট।

রুট পরিবর্তন না করে যদি পুরনো পথেই মেট্রো যেত তবে কি বিপর্যয় এড়ানো যেত? অলোকবাবুর কথায়: ‘‘হয়তো এড়ানো যেত। কারণ, বৌরানি খালের যে গতিপথ ছিল, পুরনো রুট সেখান দিয়ে ছিল না।’’

তথ্য সূত্র:

১) ক্যালকাটা, ওল্ড অ্যান্ড নিউ, আ হিস্টরিক্যাল অ্যান্ড ডেসক্রিপ্টিভ হ্যান্ডবুক টু দ্য সিটি। ইভান কটন, ১৯০৭
২) ক্যালকাটা পাস্ট অ্যান্ড প্রেজেন্ট। ক্যাথলিন ব্লেশিনডেন, ১৯০৫
৩) দ্য কন্ডিশন, ইমপ্রুভমেন্ট অ্যান্ড টাউন প্ল্যানিং অব দ্য সিটি অব ক্যালকাটা অ্যান্ড কন্টিগুয়াস এরিয়াজ, দ্য রিচার্ড

অন্য বিষয়গুলি:

Bow Bazar East West Metro
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy