Advertisement
২১ নভেম্বর ২০২৪
Ecofriendly Pen

লেখার কলম থেকে সটান গাছ! দেখতে পান না ‘সবুজ যুদ্ধের সৈনিক’

নিজে দেখতে পান না। কিন্তু শুনে আনন্দ পান যে, তাঁর বিক্রি করা কলম থেকে গাছ হয়েছে কোথায়। ফুল ফোটার কথা শুনলে আনন্দ পান। এক সময়ে উপার্জনের জন্য শুরু করা কাজই এখন তাঁর ব্রত।

Blind Suman Khan sales eco friendly pen in Kolkata

ফুল ফুটুক। চান সুমল। — নিজস্ব চিত্র।

পিনাকপাণি ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৮:৫৮
Share: Save:

কলকাতা বইমেলায় এক হাতে ব্যাগ, অন্য হাতে একগুচ্ছ কলম হাতে সুমল খাঁ বলছিলেন, ‘‘এই কলমের প্রাণ আছে। কাগজে লেখা ফোটায়। আর লেখার শেষে বাগানে বা টবে ফুল ফোটায়, ফল ফলায়।’’

বছর ষাটের সুমলের চোখে কালো চশমা। ছোটবেলায় কাল বসন্ত কেড়ে নিয়েছে দৃষ্টি। পিতৃদত্ত নাম ‘সুমন’ কেড়ে নিয়েছে নিয়তি। সবার কাছে তাঁর পরিচয় এখন ‘সুমলদা’। তবে ‘সু মন’ নিয়েই তিনি সবুজের লড়াইয়ের সৈনিক। এমন একটা কলম বিক্রি করেন, যা আদতে কাগজের তৈরি। নীল কালির ডট পেন শেষ হয়ে গেলে সামান্য কিছু অংশ ছাড়া কলমের সবটাই মাটিতে মিশে যায়। তার পরে সেখান থেকেই গজায় গাছের চারা। মাটির সঙ্গে ঠিকঠাক জল, বাতাস, আলো পেলে ফুল ফোটে। ফল ফলে।

চোখে দৃষ্টি না থাকলেও কথা বলায় সুমলের জুড়ি নেই। মান্না দে’র গানের কথা বলছিলেন বইমেলায় দাঁড়িয়ে, ‘‘ওই যে গান আছে না, ‘যদি কাগজে লেখো নাম, কাগজ ছিঁড়ে যাবে... হৃদয়ে লেখো নাম, সে নাম রয়ে যাবে।’ এই কলম সেই রকম। লেখার শেষে হৃদয়ে নাম রেখে যায়। গাছ হয়ে থেকে যায়। সঙ্গে অহঙ্কার দেয়, যে পরিবেশ দূষণ থেকে একটু হলেও আপনি পৃথিবীকে রক্ষা করলেন।’’ সুমল জানান, তাঁর কাছে দু’রকমের কলম থাকে। একটি সাধারণ, দ্বিতীয়টি ক্যাপসুল। প্রথমটির মধ্যে যে কোনও একটি গাছের বীজ থাকে। আর দামি ক্যাপসুল কলমে তিন, চারটে। লঙ্কা, ঢেঁড়শ, বেগুন, টোম্যাটো নানা ফসলের বীজ থাকে। বাইরে থেকে বোঝা যাবে না কোনটা কী গাছ ফলাবে। কোনও কোনও কলম থেকে জিনিয়া, দোপাটি, নয়নতারা ফুলও ফুটতে পারে। যে ফুল যে সময়ের সেই ঋতু মেনেই দেওয়া হয় বীজ।

অনেক দৃষ্টহীন মানুষই বিক্রি করেন কাগজের কলম। তবে সুমলের কাহিনি অন্যরকম।

অনেক দৃষ্টহীন মানুষই বিক্রি করেন কাগজের কলম। তবে সুমলের কাহিনি অন্যরকম। — নিজস্ব চিত্র।

কলম তিনি নিজে তৈরি করেন না। কলকাতারই যুবক শুভজিৎ সাহা কয়েক বছর আগে একটি পরিবেশবান্ধব সংস্থা তৈরি করেন। লক্ষ্য— কাগজ দিয়ে কলম তৈরি। প্রথম দিকে নিজে বানালেও শুভজিৎ পরে অনেককে নিয়োগ করেন। মূলত মহিলারাই বাড়িতে বসে এই কাগজের কলম বানান। কোনও দোকানে বিক্রির জন্য দেওয়া হয় না এই কলম। সবটাই হকারদের মাধ্যমে। শুভজিৎ বলেন, ‘‘আমাদের কলম শুধু বিক্রির জন্যই নয়। মানুষকে দেওয়ার সময়ে এই কলম কেন ব্যবহার করা উচিত, সেটা বলা দরকার। আবার এই কলমের লেখা ছাড়াও যে অন্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে, সেটাও মানুষকে বলা দরকার। দোকানদারদের পক্ষে যে হেতু সেটা সম্ভব নয়, তাই হকারদের মাধ্যমেই বিক্রি করা হয়।’’

সুমল একা নন। অনেক দৃষ্টিহীন মানুষই এই সংস্থার কাগজের কলম বিক্রি করেন। তবে তাঁদের মধ্যে অনেকটাই অন্য রকম সুমল। বাড়ি টালিগঞ্জের কাছে সোদপুর কালীতলায়। প্রতিদিনই কলমের ব্যাগ কাঁধে বেরিয়ে পড়েন। মূলত ট্রেনেই তাঁর ক্রেতা বেশি। বনগাঁ, বসিরহাট, ক্যানিং যে কোনও দিকেই চলে যান। কখনও কখনও চাকদহ, রানাঘাট হয়ে সেই শান্তিপুর।

সুমলের পিঠে ঝোলে পোস্টার। সেখানে পরিবেশ রক্ষার বার্তা।

সুমলের পিঠে ঝোলে পোস্টার। সেখানে পরিবেশ রক্ষার বার্তা। — নিজস্ব চিত্র।

একা মানুষ সুমল। বোনেদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। নিজে ও পথে যাননি। যখন যেখানে পারেন হোটেলে খেয়ে নেন। বাড়িতে রান্নাবান্না হয়। যখন বোনেরা বেড়াতে আসেন। বলেন, ‘‘প্রথমে উপার্জনের জন্য এই কলম বিক্রি করতাম। এখন এটাই আমার জীবনের ব্রত হয়ে গিয়েছে। ট্রেনে করে চলে যাই এক একদিন এক এক জায়গায়। অনেকেই ডেকে কলম নেন। যখন তাঁরা বলেন, বাড়িতে ফুল বা ফল হয়েছে খুব আনন্দ পাই। অনেকেই বেশি বেশি করে অর্ডার দেন। আমার ফোন নম্বর লেখা থাকে পিঠের পোস্টারে। অনেকে ফোন করে কলম চান।’’

সুমল জানান, এ বার কলকাতা বইমেলায় দারুণ বিক্রি হয়েছে। গড়ে এক একদিন ৩০০ কলম। শেষ দু’দিন ৫০০-র কাছাকাছি। তবে মেলার সময় শুধু এক বীজের ৫ টাকার কলমই বিক্রি করেছেন। সুমল বলেন, ‘‘দৃষ্টি না থাকায় দু’রকমের কলম নিয়ে সমস্যা হত। সেই কারণেই ১০ টাকা দামের ক্যাপসুল কলমটা রাখিনি।’’

চার বছর বয়সে বসন্ত হয়েছিল। চোখের উপরে প্রভাব পড়েছিল। দৃষ্টিশক্তি ক্রমশ কমতে থাকে। এখন একেবারেই দেখতে পান না সুমল। তবে দৃষ্টি হারানোর চেয়ে আসল নামটা হারানোর কষ্ট বেশি তাঁর। এটা হয়েছে বেহালা ব্লাইন্ড স্কুলে পড়ার সময়। বলেন, ‘‘সবাই নাম বিকৃত করে সুমল বলে ডাকত। পরে জানতে পারি, আমার স্কুলের সার্টিফিকেটেও সেই নাম হয়ে গিয়েছে। এখন দু’টো নামই বয়ে বেড়াই।’’ নামের ‘এন’ কখন ‘এল’ হয়ে গিয়েছে জানতে পারেননি। কিন্তু সবুজ পৃথিবী দেখতে চান তিনি। তাই ট্রেনে, মেলায় ‘পরিবেশ বান্ধব কাগজের কলম’ বলে হাঁক পাড়েন রোজ।

অন্য বিষয়গুলি:

blind pen Environment Eco Friendly
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy