আলোচনায় এই পাখিটিই। দেখা মিলেছে লোথিয়ান দ্বীপে। ছবি: অমৃতেন্দু মল্লিক।
‘ফ্রম রাশিয়া উইথ লাভ’।
সুদূর রাশিয়া থেকে উড়তে উড়তে এই বাংলায় এসে পৌঁছেছিল সে। এখানেই কাটিয়ে দিয়েছিল টানা চার মাস। আসার পথে অবশ্য হংকংয়ে বিজ্ঞানীরা তার পায়ে লাগিয়ে দেন জিপিএস যন্ত্র। নাম দেন ডি১ ওরফে ডিএক্সএ১৩১৫। সেই জিপিএস জানিয়েছিল, ২০২২-এর ২৯ ডিসেম্বর থেকে ২০২৩ সালের ২০ এপ্রিল— অর্থাৎ প্রায় চার মাস বাংলার উপকূলে ঘুরে বেরিয়েছে ডি১— অতি বিরল ও বিপন্ন ‘নর্ডমানস গ্রিনশ্যাঙ্ক’ প্রজাতির এই পাখিটি।
সে খবর পেয়েই মাঠে নেমে পড়েছিলেন এ রাজ্যের ‘জেমস বন্ড’ পাখিদেখিয়েরা। ডি১-কে চোখের দেখা দেখতে চষে বেড়িয়েছিলেন পূর্ব মেদিনীপুরের উপকূলবর্তী এলাকা। তাতে তার দেখা না মিললেও পূর্ব মেদিনীপুরের মেইদিনগর ও হিজলি সমুদ্রতটে ২০২৩ সালে দেখা মেলে অন্য তিনটি নর্ডমানস গ্রিনশ্যাঙ্কের। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে দক্ষিণ ২৪ পরগনার লোথিয়ান দ্বীপে ছবি উঠেছিল দু’টি পাখির। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ফের লোথিয়ান দ্বীপেই তিনটি পাখিকে দেখতে পেয়েছেন পাখিপ্রেমীরা। পর পর তিন বছর এমন বিরল-দর্শনে তাঁরা মনে করছেন, শীতকালীন ঠিকানা হিসাবে হয়তো পশ্চিমবঙ্গের উপকূলবর্তী এলাকাকে বিশেষ পছন্দ করছে রাশিয়ার অতিথিরা।
নর্ডমানস গ্রিনশ্যাঙ্কের বাসস্থান, বাস্তুতন্ত্র সম্পর্কে কিছু বছর আগেও অনেক কিছুই অজানা ছিল। ‘ওয়েটল্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ২০২৩’-এর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে এই প্রজাতির মাত্র ৯০০-১২০০টি পাখি রয়েছে। ফলে তা অতি-বিরল এবং বিপন্ন। জানা গিয়েছে, প্রজননের সময়ে (জুন-অগস্ট) রাশিয়ার উপকূলের আশপাশের জঙ্গলে থাকে পাখিটি। শীতে উড়ে আসে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়— তাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, বাংলাদেশের কর্দমাক্ত উপকূলে। বসন্তে সে ফেরে রাশিয়ায়। ‘‘বিশ্বে এদের মোট সংখ্যা এতটাই কম যে, একসঙ্গে তিনটে পাখির দেখা পাওয়াই বিরাট ব্যাপার। তাই বছর তিনেক ধরে এদের দেখা মিলেছে বলে আমাদের মনে হচ্ছে যে, শীত কাটাতে হয়তো ওরা এ রাজ্যের উপকূল এলাকা, ম্যানগ্রোভ অরণ্যকে পছন্দ করছে।’’— বলছেন ‘বার্ড ওয়াচার্স সোসাইটি’ নামে রাজ্যের একটি পাখিপ্রেমী সংগঠনের সদস্য সন্দীপ দাস।
পেশায় চিকিৎসক এবং ‘বার্ড ওয়াচার্স সোসাইটি’-র সদস্য কণাদ বৈদ্য জানাচ্ছেন, ২০২০ সালে এ দেশে প্রথম নর্ডমানস গ্রিনশ্যাঙ্কের ছবি ওঠে মহারাষ্ট্রে। ২০২২ সালে দক্ষিণ ২৪ পরগনার লোথিয়ান দ্বীপে ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার মিলন মণ্ডলের তোলা ছবিতে দু’টি পাখিকে দেখা যায়। ২০২৩ সালে মেইদিনগর সমুদ্রতটে একাধিক বার অভিযান চালিয়ে মোট তিনটি পাখির দেখা পান সন্দীপ ও তাঁর সঙ্গী। সন্দীপের কথায়, ‘‘এই পাখি জলের কাছাকাছি, মাটিতেই বসে থাকে। কাদামাখা এলাকা, ম্যানগ্রোভের পলি পছন্দ। কাদা থেকে ছোট ছোট কাঁকড়া ধরে খাওয়ার মতো আদর্শ ঠোঁট। সেবার দূর থেকে দেখি কাদায় বসে থাকা একটি নর্ডমানস গ্রিনশ্যাঙ্ককে। একটু এগোতেই দেখলাম, উড়ে আসা একটি পাখির দলকে লক্ষ্য করছে সে। তার পরেই সেই দলের সঙ্গে মিশে চলে গেল।’’
গত ফেব্রুয়ারিতে ফের লোথিয়ান দ্বীপে অভিযান চালিয়েছিলেন কণাদ-সন্দীপেরা। তাঁরা জানাচ্ছেন, এই দ্বীপে সাধারণের প্রবেশাধিকার না থাকায় মানুষের গতিবিধি কম। গরু-কুকুরের ঝামেলাও নেই। তাই হয়তো ওই ‘লাজুক’ পাখির এই জায়গা পছন্দ। এ বারও সেখানে বহু পাখির সঙ্গে একত্রে তিনটি নর্ডমানস গ্রিনশ্যাঙ্কের দেখা মিলেছে। অথচ ফ্রেজ়ারগঞ্জ, বকখালির মতো জায়গা এর বাসস্থানের উপযুক্ত হলেও মানুষ-গরু-কুকুরের উপদ্রবের জন্যই সেখানে তারা অমিল।
অতি বিরল এই পাখির সূত্রে গত বছর থেকে হংকংয়ের বিজ্ঞানীদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে তথ্য আদানপ্রদান করে চলেছেন এ রাজ্যের পাখিপ্রেমীরা। বাংলায় নর্ডমানস গ্রিনশ্যাঙ্কের আনাগোনা নিয়ে একযোগে পেপারও লিখে ফেলেছেন।
কিন্তু যার জন্য এত কিছুর সূত্রপাত, সেই ডি১-এর খবর কী? সন্দীপ বলছেন, ‘‘এই পাখি দিনে হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। সে কখন কোথায় থাকবে, তা নির্ভর করে খাবারের জোগান এবং তার সঙ্গীদের মর্জির উপরে। জিপিএস বলছে, এ বছর ডি১ এ দেশে আসেইনি! এখনও সে চিনের উপকূলে রয়েছে। হয়তো সেখানেই খাবারের সন্ধান মিলেছে, তাই বাংলায় ফেরার প্রয়োজন পড়েনি ওর।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy