গরমের ছুটির শান্তিনিকেতনকে আঁকেন বিনোদবিহারী।
এক্ষণ পত্রিকায় একাধিক লেখা লিখেছিলেন বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, ‘চিত্রকর’, ‘কত্তামশাই’, ‘শিল্প-জিজ্ঞাসা’-র মতো শিরোনামে, পরে দু’মলাটের মধ্যে বই হয়েও বেরোয় তারা, চিত্রকর নামেই। স্মৃতিকথা আর শিল্পভাবনার আশ্চর্য মিশেল এই বইয়ে— একশো বছর আগের শান্তিনিকেতন, আশ্রম, রবীন্দ্রনাথ, প্রকৃতি, কলাভবন, মাস্টারমশাই-ছাত্র-আঁকাজোখার গল্প মিলিয়ে যেন অন্য জগৎ এক। গরমের ছুটির শান্তিনিকেতনকে আঁকেন বিনোদবিহারী, গ্রীষ্মদুপুরে খালি পায়ে খালি মাথায় ঘুরে বেড়ান গ্রামের পথে, খোয়াইয়ের ধারে। এবং পরে লেখেন, “এই নির্জনতাই বোধহয় আমার দৃশ্য-চিত্রের প্রধান বিষয়। তাই ভাবি আমি শিখলাম কার কাছ থেকে? নন্দলালের কাছ থেকে, না লাইব্রেরি থেকে, অথবা শান্তিনিকেতনের এই রুক্ষ প্রকৃতি থেকে? নন্দলাল না থাকলে আমার আঙ্গিকের শিক্ষা হতো না, লাইব্রেরি ছাড়া আমার জ্ঞান আহরণ করা সম্ভব হতো না, আর প্রকৃতির রুক্ষ মূর্তি উপলব্ধি না করলে আমার ছবি আঁকা হতো না।”
মনে রাখা দরকার, যে সময়ে শান্তিনিকেতনের এই দৃশ্য-চিত্র আঁকছেন বিনোদবিহারী, তখন আঙ্গিক হিসাবে ল্যান্ডস্কেপের কদর নেই বঙ্গীয় শিল্পমহলে— বলছিলেন বিশিষ্ট শিল্প-ইতিহাসবিদ আর শিবকুমার, ইমামি আর্ট-এর শিল্প প্রতিষ্ঠান ‘কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটি’ (কেসিসি)-তে, গত ২০ মে বিকেলে। তাঁর সযত্ন কিউরেশনে সে দিন থেকেই এখানে শুরু হয়েছে অনন্য এক প্রদর্শনী— সিনস ফ্রম শান্তিনিকেতন অ্যান্ড বিনোদবিহারী’জ় হ্যান্ডস্ক্রোলস। শিল্পী যোগেন চৌধুরী, অধ্যাপক সুগত বসু, শিল্প-সমালোচক প্রণবরঞ্জন রায়-সহ উপস্থিত শিল্পপ্রেমী দর্শকেরাও ছিলেন রীতিমতো আপ্লুত, কারণ এই প্রথম দেখা গেল ১৯২৪ সালে বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের আঁকা একটি হ্যান্ডস্ক্রোল, ৪৪.৬ ফুট দীর্ঘ! ‘নব আবিষ্কৃত’ এই হ্যান্ডস্ক্রোলটি শিবকুমারের কাছে এনে দেখিয়েছিলেন ‘গ্যালারি রস’ (Gallery Rasa)-এর কর্ণধার রাকেশ সাহনি, অতঃপর খুলে গেল শিল্পী বিনোদবিহারীকে আবিষ্কারের এক নতুন দিগন্ত। সেই উন্মোচনই এই প্রদর্শনী, যার মধ্যমণি ওই দীর্ঘ দৃশ্য-চিত্রটি— একশো বছর আগে শান্তিনিকেতনের ঋতুরঙ্গ, প্রকৃতি ও মানুষের বারোমাস্যা যেখানে ফুটে উঠেছে (উপরের ছবি দু’টি তারই অংশ)।
সত্যজিৎ রায় তাঁর দি ইনার আই তথ্যচিত্রে ফুটিয়ে তুলেছিলেন বিনোদবিহারীর শিল্পের অন্তর্জগৎ, সে ছবির কথাও স্বাভাবিক ভাবেই উঠে এল এ দিনের আলোচনায়। প্রদর্শনীতে দেখা যাবে উনিশশো কুড়ি-তিরিশের দশকে নানা সময়ে আঁকা বিনোদবিহারীর অন্য হ্যান্ডস্ক্রোলও— কলাভবন, লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলবার্ট মিউজ়িয়ম-এর সংগ্রহ থেকেও। রয়েছে শিল্পীর আত্মপ্রতিকৃতি, তাঁর চিনা স্কেচবইয়ের ছবি, কলাভবন হস্টেলে বিনোদবিহারীর বিখ্যাত ম্যুরালের প্রতিরূপও। খোয়াই, গ্রাম, শালগাছ, জঙ্গলের বন্যতা... সব মিলিয়ে এ এক অনন্য রসাস্বাদন, প্রায় শতবর্ষ পরে। কেসিসি ও গ্যালারি রস-এর যৌথ আয়োজনে এই প্রদর্শনীটি দেখার সুযোগ কেসিসি-র অ্যাম্ফিথিয়েটারে আগামী ২০ জুন পর্যন্ত, রবিবার বাদে রোজ সকাল ১১টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা।
বিপ্লবী স্মরণে
স্বাধীনতার ৭৫ বছরেও বিস্মৃত বহু বিপ্লবী, তাঁদের অন্যতম পুলিনবিহারী দাস (ছবি)। তাঁর হাতেই প্রতিষ্ঠা ঢাকা অনুশীলন সমিতির। বঙ্গযুবাদের সশস্ত্র বিপ্লবে দক্ষ করে তুলতে ১৯২০ সালে ভারত সেবক সঙ্ঘ, ১৯২৮-এ কলকাতার মেছুয়াবাজারে তৈরি করেন বঙ্গীয় ব্যায়াম সমিতি। আখড়ায় লাঠি, তলোয়ার চালনা, কুস্তি শেখানো হত। ১৯৩০-এ কলকাতা পুরসভার মেয়র সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় তাঁর, সমিতিকে কুড়ি কাঠা জমি দেয় পুরসভা। দুর্ভাগ্য, এই মানুষটির ঠাঁই হয়নি পাঠ্যবইয়ে, তাঁর নামাঙ্কিত কোনও রাস্তা নেই, নিমতলা ঘাট শ্মশানে তাঁর সমাধিফলকটিও উৎপাটিত। এই প্রজন্মের কাছে তাঁকে তুলে ধরতে প্রয়াসী ‘পুলিনবিহারী দাস মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’, তাদের উদ্যোগে পুলিনবিহারীর আত্মজীবনী আমার জীবন কাহিনী সম্পাদনা করেছেন বিপ্লবীর পৌত্র বিশ্বরঞ্জন ও মণীশরঞ্জন দাস। আজ বিকেল ৪টেয় রোটারি সদনে প্রকাশিত হবে বইটি, দেখানো হবে ওয়াইড অ্যাঙ্গল নির্মিত তথ্যচিত্র।
অন্য পাঠ
১৫ মে তারাতলার নবদিশা সেন্টারে শহর সাক্ষী থাকল ছোটদের ঘিরে অন্য রকম এক উদ্যোগের। সেন্টারটি ‘বিক্রমশীলা এডুকেশন রিসোর্স সোসাইটি’ দ্বারা পরিচালিত, দেশ জুড়ে নানা আর্থ-সামাজিক অবস্থানে থাকা অল্পবয়সিদের শিক্ষাদানের ভিন্নতর, বিকল্প পাঠব্যবস্থা নিয়ে কাজ করে এই প্রতিষ্ঠান। এ দিন তাদের সঙ্গী ছিল ‘অল্টএড’, যাদের কাজ আবার মিডিয়া ও তথ্য সাক্ষরতার প্রচার-প্রসার নিয়ে। দুই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে গত দু’মাস ধরে ১২-১৪ বছর বয়সি ত্রিশ পড়ুয়াকে নিয়ে এক প্রকল্প চলছিল— তথ্যের ঠিক-ভুল বিচার, সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার ইত্যাদি নিয়ে, তারই তুঙ্গমুহূর্তটি ছিল এ দিন। চার্ট, ইন্টারঅ্যাক্টিভ বুথ ইত্যাদির মাধ্যমে সব দেখাল, বোঝাল এই পড়ুয়ারাই— বড়রা শুনলেন মন দিয়ে।
নাট্যোৎসবে
জাতির পিতা, পরিবারেরও— এই দুই সত্তার লড়াই নাটক জুড়ে। চেতনা-র নতুন নাটক মহাত্মা বনাম গান্ধী-তে মোহনদাস ও হরিলাল, বাবা ও ছেলের আদর্শের সংঘাত, মাঝখানে কস্তুরবা। অজিত দলভি রচিত এই নাটকের বাংলা তরজমা অরুণ মুখোপাধ্যায়ের। গান্ধীর ভূমিকায় অনির্বাণ চক্রবর্তী, নিবেদিতা মুখোপাধ্যায় হয়েছেন কস্তুরবা, পরিচালনায় ও হরিলালের চরিত্রে সুজন মুখোপাধ্যায়। ১ জুন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় মধুসূদন মঞ্চে এ নাটক, ‘বেহালা ব্রাত্যজন’-এর বঙ্গ রঙ্গমহোৎসবের অঙ্গ। ২৬ মে থেকে ৪ জুন, মধুসূদন ও অ্যাকাডেমি মঞ্চে বিভিন্ন নাট্যগোষ্ঠীর বিশিষ্ট প্রযোজনা: একটি স্বপ্নময় মৃত্যু, পড়ে পাওয়া ১৬ আনা, জগন্নাথ, শল্যপর্ব, মণিকর্ণিকায় মণিকা, ডজন দু’জন, মারীচ সংবাদ, হারানের নাতজামাই আর ঊরুভঙ্গম।
ভিনাইল ক্লাব
পশ্চিমি ধ্রুপদী সঙ্গীত ভালবাসতেন সত্যজিৎ রায়, সেই সঙ্গীতবোধ চারিয়ে গিয়েছিল তাঁর চলচ্চিত্র-ভাবনায়, ভাষাতেও। আজকের কলকাতায় কেউ যদি মন দিয়ে শুনতে চান ধ্রুপদী সেই সঙ্গীত, কী করবেন? সেই ভাবনা থেকেই কলকাতার গ্যোয়টে ইনস্টিটিউট-ম্যাক্সমুলার ভবন শুরু করেছে ‘ভিনাইল ক্লাব’। তাদের সংগ্রহে আছে গত শতকের ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক্যাল মিউজ়িকের বিপুল সম্ভার, রেকর্ডে। সঙ্গীতপ্রেমীরা সে সব রেকর্ড শুনতে পারবেন, তা নিয়ে হবে আলোচনা, ইনস্টিটিউটের গিটার-কিবোর্ডে তুলতে পারবেন সুরঝঙ্কারও। ভিনাইল ক্লাবের প্রথম সন্ধ্যাটি ছিল গতকাল, জোহান সেবাস্টিয়ান বাখ-এর কম্পোজ়িশন কিউরেট করেছিলেন আব্রাহাম মজুমদার। আগামী অধিবেশন ২৩ জুন, ২৮ জুলাই, ২৫ অগস্ট ও ২২ সেপ্টেম্বর, সন্ধে সাড়ে ৬টায়।
ঘোড়াগুলি
সত্তরের দশকে জীবনানন্দের কবিতার চরণ থেকে এল নাম। তাপস, তপেশ, বুলা, বিশু, আবু, রঞ্জন আর মণিদা (গৌতম চট্টোপাধ্যায়) মিলে ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’-র পথ চলা কলকাতা তথা বাংলার এক অতি গুরুত্বপূর্ণ কালখণ্ডের ইতিহাসও বটে। মহীনের ঘোড়াগুলির আদ্যন্ত নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থের অভাব ছিল, তা-ই লিখেছেন সাজ্জাদ হুসাইন। ঢাকার ‘ছাপাখানার ভূত’ বার করেছে বই মহীনের ঘোড়াগুলির গান: রয়েছে গানদলের যাত্রাপথ, প্রকাশিত-অপ্রকাশিত ষোলোটি গানের পূর্ণাঙ্গ লিরিকস, কর্ড, তিনটি গানের স্টাফ নোটেশন। লেক রোডের কাফে ড্রিফটার-এ আগামী কাল, ২৮ মে সন্ধ্যা ৭টায় বইটির আনুষ্ঠানিক প্রকাশ, থাকবেন তিন আদি ঘোড়া, বন্ধুজন।
নতুন গ্যালারি
ডুবে যাওয়ার আগে টাইটানিকের বার্তা পেয়ে কাপের্থিয়া জাহাজটি অকুস্থলে পৌঁছে বহু যাত্রীকে উদ্ধার করেছিল। বেতার যোগাযোগ না থাকলে কী হত! মর্স কোডের সঙ্কেত থেকে আজকের ক্লাউড-কম্পিউটিং জমানায় তথ্যের ভার্চুয়াল ভান্ডারের চালিকাশক্তি হল উন্নত যোগাযোগ। এই বিশাল কর্মকাণ্ডে কলকাতার ভূমিকাও কম নয়, জগদীশচন্দ্র বসুর রেডিয়ো ট্রান্সমিটার, রেডিয়ো সম্প্রচারে শিশিরকুমার মিত্রের ভূমিকা... যোগাযোগ-প্রযুক্তির ইতিহাসকে নানা নমুনা, ছবি ও দৃশ্যশ্রাব্য উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে তুলে ধরতে গুরুসদয় রোডে বিড়লা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড টেকনোলজিক্যাল মিউজ়িয়মে (বিআইটিএম) খুলে গেল একটি নতুন গ্যালারি, ‘ভিন্টেজ ভয়েজ’ (ছবি)। যোগাযোগ-প্রযুক্তির অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ দেখার সুযোগ ছুটির দিন বাদে রোজ, সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা।
সম্ভার
গ্রামবাংলার শিল্পীদের শিল্পরূপ আলপনা। ব্রত, পার্বণে তার জন্ম গোবর নিকানো উঠোন বা পিঁড়ির সমতলে, প্রধানত পিটুলিগোলা দিয়ে। এই প্রজন্মের কাছে গ্রামবাংলার আলপনার বিপুল সম্ভার অধরা রয়ে যাবে, যদি না তার নিয়মিত চর্চা হয় ভিন্নতর শিল্পযাপনে। ১৬ লেক টেম্পল রোডের ‘ছবি ও ঘর’ প্রদর্শশালা এ কথা মাথায় রেখেই আয়োজন করেছে প্রদর্শনী ‘বাংলার আলপনা’। শিল্পী, লেখক, লোকশিল্প গবেষক বিধান বিশ্বাসের আঁকা ছত্রিশটি আলপনাচিত্র (ছবিতে একটি) নিয়ে এই প্রদর্শনী। আলপনাশিল্পী হিসাবে দেশে-বিদেশে বহু কর্মশালা ও সেমিনার করেছেন বিধানবাবু, গত দুই দশকে। সাম্প্রতিক কাজগুলিতে তিনি আলপনা দিয়েছেন গোবর বা রাঢ় বাংলার লাল মাটির প্রলেপ দেওয়া কাগজের উপর খড়িমাটি দিয়ে, ফলে আলপনার নির্যাসটি রক্ষিত হয়েছে। পৌষ পার্বণ, মাঘমণ্ডল, সুবচনী, পুণ্যিপুকুর, সেঁজুতি প্রভৃতি ব্রত আর পিঁড়িচিত্র নিয়ে প্রদর্শনীর সঙ্গে চলছে শিল্পীর উপস্থিতিতে আলপনার কর্মশালাও। প্রদর্শনী শুরু হয়েছে ১৯ মে, চলবে ৪ জুন অবধি, মঙ্গলবার বাদে প্রতি দিন দুপুর ৩টে থেকে রাত ৮টা।
তন্নিষ্ঠ
পেশায় পুরাউদ্ভিদবিজ্ঞানী। পুরাতাত্ত্বিক খননে পাওয়া জীবজ নমুনার বিশ্লেষণ করে পুরাইতিহাসের গবেষণায় মগ্ন থাকতেন রুবি ঘোষ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদবিদ্যায় স্নাতকোত্তর, পশ্চিম মেদিনীপুরের মোগলমারি-সহ নানা স্থানের পুরাখনন-নমুনা থেকে ওই অঞ্চলে পুরাইতিহাসের সঙ্গে উদ্ভিদবিদ্যার মেলবন্ধন বিষয়ে পিএইচ ডি। লখনউয়ের বীরবল সাহনি ইনস্টিটিউট অব প্যালিয়ো সায়েন্সেস থেকে পান প্রতুলচন্দ্র ভান্ডারী পদক, কর্মজীবনও শুরু এখানেই। ভারতে ‘ফাইটোলিথ’ নমুনা ভিত্তি করে অতীত জলবায়ু ও পরিবেশ বদলের দিকনির্দেশ নিয়ে গবেষণায় ছিলেন পুরোধা বিজ্ঞানী। ১৮ এপ্রিল মাত্র ছেচল্লিশ বছর বয়সে চলে গেলেন কোভিডে, গত ৬ মে সন্ধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের গবেষণাগারে তাঁকে স্মরণ করলেন গুণগ্রাহীরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy