Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

লাদাখে গাড়িসুদ্ধ বরফ চাপা

সোমবার বেলা সাড়ে এগারোটা থেকে রাত ন’টা। টানা সাড়ে ন’ঘণ্টা গাড়ির ভিতরে আটকে ছিলেন ওঁরা। আর গাড়িটা আটকে গিয়েছিল বরফের চাদরের ভিতর। শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনী যখন সেটি উদ্ধার করল, ভিতরে বসা চার জনই তখন সাড়হীন। হাসপাতালে দু’জনের জ্ঞান ফিরেছে। বাকি দু’জনকে আর জাগানো যায়নি। লাদাখে বেড়াতে গিয়ে তুষারধসের মধ্যে পড়ে এ ভাবেই প্রাণ হারালেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিভাগীয় প্রধান রাজশ্রী বসু (৫২) ও তাঁর ছেলে খড়্গপুর আইআইটি-র পদার্থবিদ্যার দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সৌম্যদীপ (২০)।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০১৫ ০৩:৫৬
Share: Save:

সোমবার বেলা সাড়ে এগারোটা থেকে রাত ন’টা। টানা সাড়ে ন’ঘণ্টা গাড়ির ভিতরে আটকে ছিলেন ওঁরা। আর গাড়িটা আটকে গিয়েছিল বরফের চাদরের ভিতর। শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনী যখন সেটি উদ্ধার করল, ভিতরে বসা চার জনই তখন সাড়হীন। হাসপাতালে দু’জনের জ্ঞান ফিরেছে। বাকি দু’জনকে আর জাগানো যায়নি।
লাদাখে বেড়াতে গিয়ে তুষারধসের মধ্যে পড়ে এ ভাবেই প্রাণ হারালেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিভাগীয় প্রধান রাজশ্রী বসু (৫২) ও তাঁর ছেলে খড়্গপুর আইআইটি-র পদার্থবিদ্যার দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সৌম্যদীপ (২০)। রাজশ্রীদেবীর স্বামী, সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স-এর বিজ্ঞানী পদ্মনাভ বসু এখনও লেহ্-র হাসপাতালে আইসিইউ-এ ভর্তি রয়েছেন। গাড়ির চালক আবদুল হককে মঙ্গলবার সকালে হাসপাতাল থেকে ছাড়া হয়েছে।
কলকাতায় বসু পরিবারের বাড়ি মানিকতলা এলাকায়। পদ্মনাভবাবু চাকরি থেকে অবসরের মুখে দাঁড়িয়ে। চাকরি জীবনের শেষ এলটিসি নিয়ে সপরিবার বেড়াতে বেরিয়েছিলেন লেহ্-লাদাখ। প্রথমে ঠিক ছিল, জুন মাসের মাঝামাঝি বেরোবেন। কিন্তু ওই সময় বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সেস-এ সৌম্যদীপের একটি প্রজেক্ট করার কথা ছিল। তাই বেড়ানোর পরিকল্পনা এগিয়ে আনা হয়। তার পরিণাম যে এমন হবে, কেউই দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি তা।

লেহ্-র পুলিশ সুপার সুনীল গুপ্ত এ দিন ফোনে জানান, সোমবার সকালে লেহ্ থেকে নুব্রা উপত্যকার উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন পদ্মনাভবাবুরা। বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ খারদুং লা পাস পেরনোর কিছু পরেই আচমকা তুষারধসে চাপা পড়ে যায় তাঁদের ভাড়া করা জাইলো গাড়িটি।

লেহ্ শহর থেকে খারদুং লা-র দূরত্ব প্রায় ৩৯ কিলোমিটার। সাড়ে ১৭ হাজার ফুট উঁচু এই পাস জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয় ১৯৮৮ সালে। গাড়ি চলাচলের উপযোগী সবচেয়ে উঁচু রাস্তা বলে পরিচিত খারদুং লা। সেখান থেকে উত্তরে আরও ৭৫ কিলোমিটার গেলে নুব্রা উপত্যকা। এই রাস্তা দিয়েই সিয়াচেনে ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য রসদ যায়। লাদাখের পর্যটকদের কাছেও অবশ্য দর্শনীয়-র তালিকায় পড়ে নুব্রা।

সোমবার সকালে সে রকম পরিকল্পনা নিয়েই বেরিয়েছিল বসু পরিবারও। খারদুং লা পর্যন্ত ঠিকঠাকই চলছিল সব। নিরাপদে পাস থেকে নেমে নুব্রার দিকে এগোচ্ছিল গাড়ি। আড়াই-তিন কিলোমিটার মতো গিয়েই হঠাৎ নেমে এল বিশাল তুষারধস। গিলে ফেলল গাড়িটাকে। মঙ্গলবার সকালে লেহ্-র হাসপাতাল থেকে ফোনে পদ্মনাভবাবু বলছিলেন, ‘‘বিরাট বরফের চাঁই আচমকা আমাদের গাড়ির উপরে পড়়ল। চালকের দু’পাশের জানলার কাচ ভেঙে গাড়ির ভিতরেও ঢুকে এল বরফ।’’ দরজা আটকে গেল, গাড়ির মাথাতেও কয়েক ফুট বরফ জমে গেল নিমেষে। এক পাশে খাড়াই পাহাড় আর অন্য পাশে খাদের মধ্যিখানে সরু রাস্তাটা গাড়ি সমেত চাপা পড়ে গেল বরফের তলায়।

লেহ্-র জেলাশাসক বঙ্গতনয় সৌগত বিশ্বাস এ দিন জানালেন, সোমবার প্রায় ১৫ ফুট উঁচু ধস নেমে এসেছিল নুব্রার রাস্তায়। পদ্মনাভদের গাড়ির চিহ্নটুকুও আর দেখা যাচ্ছিল না। পাহাড়-রাস্তা-খাদ মিলেমিশে তখন শুধুই তুষারের পুরু আস্তরণ। জাইলো গাড়িটির পিছনে ছিল একটি মোটরবাইক। তার আরোহীই সর্বপ্রথম দেখতে পান, আচমকা এক বরফের ধস যাত্রী-সহ গিলে ফেলছে সামনের গাড়িটাকে। এসপি সুনীলবাবু এ দিন বলেন, ওই আরোহীই ঊর্ধ্বশ্বাসে বাইকের মুখ ঘুরিয়ে নিকটবর্তী পুলিশ আউটপোস্টে ঘটনাটি জানিয়েছিলেন। সেনা, পুলিশ এবং বর্ডার রোড অর্গানাইজেশনের অফিসারেরা ছুটে যান সঙ্গে সঙ্গেই। সুনীলবাবুর কথায়, ‘‘চোখের সামনে ওই দৃশ্য দেখে বাইক-আরোহী নিজেও এত আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন যে, পুলিশ ছাউনিতে তাঁরও চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হয়েছিল।’’

ও দিকে খারদুং লা-নুব্রার রাস্তা আটকে যাওয়ায় তত ক্ষণে নুব্রার উদ্দেশে রওনা হওয়া অন্য গাড়িগুলিও মাঝপথে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়। মুখ ঘোরায় নুব্রা থেকে লেহ্-র দিকে রওনা হওয়া গাড়িগুলিও। লেহ্-র জেলাশাসক জানাচ্ছেন, মঙ্গলবারও লেহ্ থেকে নুব্রা যাওয়ার মূল রাস্তাটি বন্ধ ছিল। পর্যটকদের অন্য গাড়িগুলিকে আলাদা রাস্তা দিয়ে চলাচল করানো হয়েছে।

কিন্তু গাড়ি সমেত বরফের মধ্যে ঢুকে গিয়ে পদ্মনাভবাবুদের তখন কী অবস্থা? পদ্মনাভ এবং চালক আবদুল জানিয়েছেন, কোনও রকমে গাড়ির আলো জ্বেলে প্রাণপণে হর্ন বাজাচ্ছিলেন ওঁরা। চিৎকার করছিলেন। কিন্তু বরফের চাদর ভেদ করে কোনও আওয়াজই বাইরে পৌঁছয়নি। মোবাইল কাজ করেনি। গাড়ির মধ্যে রাখা অক্সিজেন সিলিন্ডার থেকে খানিক ক্ষণ পালা করে শ্বাস নিচ্ছিলেন ওঁরা। পদ্মনাভবাবুর কথায়, ‘‘ঘণ্টা দু’তিন পরে আমাদের আর জ্ঞান ছিল না।’’

কিন্তু দুপুর থেকে বরফ সরানোর কাজ শুরু হওয়ার পরেও পদ্মনাভবাবুদের উদ্ধার করতে সোমবার রাত ন’টা বেজে গেল কেন? লেহ্-র পুলিশ সুপার জানাচ্ছেন, উদ্ধারকারী দল যখন ঘটনাস্থলে পৌঁছয়, তখন সেখানে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে শুধু বরফ আর বরফ। তার মধ্যে ঠিক কোনখানে গাড়িটি রয়েছে, তা ঠাহর করার কোনও উপায় ছিল না। ফলে নানা দিক থেকে বুলডোজার দিয়ে খেপে খেপে বরফ সরিয়ে গাড়িটি খোঁজার চেষ্টা করা হচ্ছিল। তার মধ্যেই দু’তিন বার নতুন করে তুষারধস নামে। জেলাশাসক আরও জানান, গাড়িটি কোথায় থাকতে পারে জানা ছিল না বলেই বরফ সরানোর বড় দাঁতওয়ালা যন্ত্র ব্যবহার করা হয়নি। পাছে গাড়ির দেওয়াল ফুঁড়ে আরোহীদের আঘাত লাগে! কিন্তু সেটা করতে গিয়ে উদ্ধারের কাজ কিছুটা প্রলম্বিত হয়। এর পরেও রাত আটটা পর্যন্ত খোঁড়াখুঁড়ি চালিয়েও গাড়ির হদিস মেলেনি। পুলিশ সুপার জানান, অগত্যা সে রাতের মতো উদ্ধারের কাজ থামানোর কথা যখন ভাবা হচ্ছে, ঠিক তখনই এক সেনা অফিসারের চোখে পড়ে চাপা পড়া গাড়িটির একটি অংশ। সঙ্গে সঙ্গে ফের শুরু হয় বরফ সরানোর কাজ। রাত ন’টা নাগাদ গাড়িটি বার করে আনা সম্ভব হয়। সংজ্ঞাহীন অবস্থায় চার জনকেই নিয়ে যাওয়া হয় কাছের সেনা ছাউনিতে। অক্সিজেন দেওয়া হয়। কিন্তু সাড়া মেলেনি রাজশ্রীদেবী ও সৌম্যদীপের। তখন গভীর রাতে তাঁদের সবাইকেই লেহ্-র সোনম নুরবু মেমোরিয়াল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে রাজশ্রীদেবী ও সৌম্যদীপকে মৃত বলে ঘোষণা করেন চিকিৎসক।

তবে হাসপাতালের মেডিক্যাল সুপার ইয়ংচ্যাং দলমা মঙ্গলবার ফোনে জানান, ‘‘পদ্মনাভবাবু ও আবদুল দু’জনেই ভাল আছেন। পদ্মনাভবাবুকে স্ত্রী-পুত্রের মৃত্যুসংবাদ দেওয়া হয়নি। বলা হয়েছে, দু’জনেই গুরুতর অসুস্থ।’’ পদ্মনাভবাবুদের আত্মীয়দের পৌঁছনোর জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে।

৩০ মে কলকাতা থেকে লাদাখ রওনা হয়েছিলেন পদ্মনাভবাবুরা। আজ, বুধবার ওঁদের ফেরার কথা ছিল। এ ক’দিনের জন্য পদ্মনাভর দাদা অমিতাভ বসু সস্ত্রীক শিলিগুড়ি থেকে এসে মানিকতলার বাড়িতে ছিলেন। হাসপাতাল থেকে অমিতাভবাবুর স্ত্রী কাবেরীদেবীর সঙ্গে কথা বলেছেন পদ্মনাভবাবু। সাহা ইনস্টিটিউট এবং রবীন্দ্রভারতীর তরফেও অমিতাভবাবুদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কাবেরীদেবী জানান, তাঁদের এক আত্মীয় সেনাবাহিনীতে রয়েছেন। তিনিই গোটা বিষয়টি তদারকি করছেন। লেহ্ থেকে দিল্লি হয়ে দু’জনের দেহ এবং পদ্মনাভবাবুকে নিয়ে আসা হবে কলকাতায়। রাজ্যের পর্যটন মন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলেন, ‘‘দিল্লিতে রেসিডেন্ট কমিশনারকে বলা হয়েছে পুরো বিষয়টি দেখভাল করার জন্য।’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE