আকাশ পানে: এই ঠিকানায় ঠাঁই হয় ঠিকানাহীনের। নিজস্ব চিত্র
দেড়শো বছরেরও দীর্ঘ সময়ের ইতিহাস নিয়ে দাঁড়িয়ে ১২০ ফুট উঁচু বেল টাওয়ার। ডালহৌসি স্কোয়ারের পূর্ব এবং দক্ষিণ কোণের সেই ভবনের অপূর্ব গঠনশৈলী আজও থমকে দেয় পথচারীকে। ওই চত্বরের সরকারি দফতরগুলির মধ্যে সেন্ট্রাল টেলিগ্রাফ অফিস (সিটিও) তার নিজস্ব গল্প বলে। সিটিও-র পুরনো ভবন, অর্থাৎ বেল টাওয়ার-সহ তিনতলা বাড়িটি তৈরি শুরু হয়েছিল ১৮৬৭ সালে। কাজ শেষ হয় ১৮৭৬ সালে। দ্বিতীয় বাড়িটি তৈরি হয় ১৯১৪ সালে।
পুরনো বেল টাওয়ার-সহ ভবনে বিদেশ থেকে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে আসা যাবতীয় চিঠি, পার্সেল বাছাই হত। সেখানে ঠাঁই পেত মৃত চিঠিরা। অর্থাৎ যে সব চিঠি বা পার্সেল সংশ্লিষ্ট ঠিকানার প্রাপকের কাছে পৌঁছতে পারত না, তাই ‘ডেড লেটার’ বলে গণ্য হত। ‘দি পোস্ট অফিস রুলস ২৫-২৭, ১৮৩৭’ প্রথম এ দেশে ‘ডেড লেটার’-এর ধারণা আনে। কোনও চিঠি বা পার্সেল তিন মাসের মধ্যেও প্রাপকের কাছে না পৌঁছলে তা ‘মৃত চিঠি’ বলে গণ্য হয়। ১৮৬৭ সালে ডেড লেটারের জন্য একটি স্থায়ী অফিস তৈরির কাজ শুরু হয়। যেখানে বেল টাওয়ার-সহ ভবনটি রয়েছে, এক দিন সেখানে ছিল বিশাল আয়তনের পুকুর। ১৮৭৬ সালে অবশ্য ভবনের সামনে আজকের বিবাদী বাগ বাস টার্মিনাস ছিল না। বর্তমানে সেই বাস টার্মিনাস সরানো হয়েছে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর কাজের জন্য। প্রথম থেকেই এর নামকরণ হয়েছিল ‘ডেড লেটার অফিস’। ১৯৭০ সালে নাম বদলে ‘রিটার্ন লেটার অফিস’ (আরএলও) হয়। শুরুতে ‘ডেড লেটার অফিস’ ছিল দেশের তিন প্রেসিডেন্সি বেঙ্গল, মাদ্রাজ এবং বোম্বেতে। বর্তমানে দেশের ২৩টি সার্কেলের প্রতিটিতেই আছে।
সব চিঠি বা পার্সেলই যে ঠিকানায় পৌঁছয় এমন নয়। হয়তো প্রেরকের লেখা অসম্পূর্ণ ঠিকানা, মর্মোদ্ধার করতে না পারা হস্তাক্ষর, সাঙ্কেতিক ঠিকানার কারণে অথবা প্রাপকের মৃত্যু হওয়ায় তা যথাস্থানে পৌঁছলো না। তখন স্থানীয় পোস্ট অফিস মারফত ফিরে যায় আরএলও দফতরে। তবে প্রেরকের ঠিকানা দেওয়া থাকলে, তা যায় তাঁর কাছেই। প্রেরক যদি নিতে অসম্মত হন, সেটি ‘ডেড লেটার’ হয়ে ফিরে আসে আরএলও দফতরে।
আরও পড়ুন: বেহাল ভূগর্ভ পথ, লাইন পেরোনো তাই ভবিতব্য
আরএলও দফতরে কর্মরত প্রত্যেক কর্মচারী ‘দি পোস্ট অফিস অ্যাক্ট’-এর ৩৮ (১) (বি) ধারা মেনে গোপনীয়তা রক্ষার শর্তে ফিরে আসা চিঠি বা পার্সেল খুলে তা পড়ে বা পরীক্ষা করে ঠিকানার সূত্র বার করার চেষ্টা করেন। এই দফতরের যোগ দেওয়ার সময়ে ম্যানেজার, অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার ও প্রত্যেক ক্লার্ক ‘আরএলও ১৭’ নম্বর ফর্মে গোপনীয়তা রক্ষায় বন্ড সই করেন।
“১৯৭৯ সাল। আমরা তখন কলকাতাতেই বাড়ি বদল করেছি। কাকিমা জলপাইগুড়ি থেকে সল্টলেকের বাসিন্দা তাঁর দিদিকে ইনল্যান্ড লেটার লিখছেন। চিঠির এক জায়গায় লিখলেন, ‘সোনাদিদিরা কলকাতায় বাসা বদল করিয়াছেন। তাঁহাদের নতুন ঠিকানা...।’ ভুল বা অসম্পূর্ণ ঠিকানা থাকায় চিঠি পৌঁছয়নি সল্টলেকে। কাকিমার ঠিকানা সেখানে না থাকায় চিঠি যায় আরএলও দফতরে। কর্মীরা তা খুলে সোনাদিদি, অর্থাৎ আমার মায়ের ঠিকানা উদ্ধার করে চিঠিটি পাঠান। সঙ্গে দফতরের তরফে চিঠি দিয়ে বিস্তারিত জানানো হয়।” নিজের এই অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন গৌতম ভট্টাচার্য, চিফ পোস্টমাস্টার জেনারেল, ওয়েস্ট বেঙ্গল সার্কেল। বিভিন্ন ভাষার লেখা পড়তে আরএলও দফতরে ভাষা জানা কর্মী নিয়োগে প্রাধান্য দেওয়া হয়।
আজব চিঠির সংখ্যা এক সময়ে কিন্তু কম ছিল না। যেমন, এক চিঠির ঠিকানার জায়গায় আঁকা শুধুই বেহালা বা বংশীধারী কৃষ্ণ। কোনওটি আবার সংখ্যাতত্ত্বের গোলকধাঁধায় ভরা। সে সব থেকে আসল ঠিকানা বার করা ছিল কর্মীদের বড় চ্যালেঞ্জ। তাও যে সব চিঠি পাঠানো যায় না, তা পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ঠিকানাবিহীন পার্সেলের মূল্যবান জিনিস নিলামে ডাকা হয়। সেই টাকা যায় সরকারের খাতে।
প্রযুক্তির ভারে হারানো চিঠির বোঝা হাল্কা হয়েছে। কমেছে কর্মীও। স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে মৃত চিঠির ঠিকানা, বেল টাওয়ার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy