অবশেষে: দেহ উদ্ধার করতে পাতকুয়োয় নামছেন মেঘনাদ সর্দার(ইনসেটে)। (ডান দিকে) পায়ে দড়ি বাঁধা অবস্থায় তুলে আনা হচ্ছে সম্রাটের দেহ। শনিবার। ছবি: সুমন বল্লভ
কলকাতা পুলিশ, বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী এবং দমকল মিলে আঠেরো ঘণ্টার চেষ্টাতেও যা করতে পারল না, শেষমেশ তা-ই করে দেখালেন এক পাতকুয়ো মিস্ত্রি। শুক্রবার দুপুরে বাঁশদ্রোণীর সোনালি পার্কের কুয়োয় পড়ে যাওয়া যুবক সম্রাট সরকারের (২৯) দেহ শনিবার সকালে উপরে তুলে আনলেন তিনিই। উদ্ধারের চেষ্টায় এক বার ব্যর্থ হওয়ার পরে মেঘনাদ সর্দার নামের সেই মিস্ত্রিকেই শুক্রবার রাতে ফিরিয়ে দিয়েছিল পুলিশ এবং দমকল। এই ঘটনার পরে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, কলকাতা পুলিশের বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী তবে আছে কেন?
দমকল এবং কলকাতা পুলিশের বিপর্যয় মোকাবিলার কর্তারা দায় এড়ালেও শুক্রবার বিকেল থেকে টানা ছ’ঘণ্টার চেষ্টায় সম্রাট ওরফে বাপি নামের ওই যুবককে পাতকুয়ো থেকে তুলতে না পারাটা প্রশাসনিক ব্যর্থতা বলেই মনে করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তাঁরা জানাচ্ছেন, শুক্রবার বিকেল থেকে যে উদ্ধারকাজ শুরু হয়, রাতের দিকে মেঘনাদ ঘটনাস্থলে আসায় তাতে গতি আসে। কিন্তু এক বার দড়ি ছিঁড়ে যাওয়ায় ওই কাজ থেকে মেঘনাদকে সরিয়ে দেওয়া হয়। কাজ অসমাপ্ত রেখেই চলে যায় তিন বাহিনী। স্থানীয়দের প্রশ্ন, কুয়ো থেকে এক জনকে তুলতেই যদি এতটা নাস্তানাবুদ হতে হয়, তবে এই বাহিনী কী ধরনের বিপদ সামলাবে? মৃতের মা লক্ষ্মীদেবীর মতে, ‘‘সরকারের প্রশিক্ষিত বাহিনী রয়েছে। তা সত্ত্বেও শুক্রবার রাতে ছেলেটাকে উদ্ধার না করে তারা ফিরে গেল! এটা তো ওদের ব্যর্থতা।’’
এই ঘটনাকে সরাসরি ব্যর্থতা বলে মানতে নারাজ বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত, কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (কমব্যাট ব্যাটেলিয়ন) নভেন্দ্র সিংহ পাল। তিনি বলেন, ‘‘ওই কুয়োর গড়ন নলাকার। তাই এতটা সময় লেগেছে। তা ছাড়া যে কোনও উদ্ধারকাজে তো সময় লাগবেই।’’ দমকলের ডিজি জগমোহনের বক্তব্য, ‘‘শীতের রাতে ঝুঁকি নেওয়া উচিত হত না। আরও প্রাণহানি হতে পারত। তাই উদ্ধারকাজ অসমাপ্ত রাখতে হয়েছিল।’’ ডিসি বলছেন, ‘‘আমাদের তত্ত্বাবধানে মেঘনাদকে মুখোশ পরিয়ে দড়ি দিয়ে কুয়োয় নামানো হয়। ওঁর যাতে বিপদ না হয়, তা-ও দেখতে হচ্ছিল। শুক্রবার বিকেল চারটে থেকে রাত দশটা পর্যন্ত চেষ্টা করা হয়েছে। বেশি রাতে বিপদ বাড়তে পারে বুঝেই মেঘনাদকে উঠে আসতে বলি।’’
যদিও এই ব্যাখ্যা মানতে রাজি নন খোদ মেঘনাদ। এ দিন তিনি বলেন, ‘‘বাপির মাথা কুয়োর ভিতরে ঢুকে গিয়েছিল। আমি হাতড়ে ওর পা-টা পেয়ে যাই। দড়িতে হুক লাগিয়ে প্রায় টেনেও আনি। কিন্তু ফস্কে যায়। তখন আমাকে উঠে আসতে বলা হল। আর এক বার চেষ্টা করলেই হয়ে যেত।’’
শুক্রবার দুপুরে স্নান করার সময়ে ঘরের সামনের কুয়োয় পড়ে যান সম্রাট। এ দিন সম্রাটদের ভাড়া বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে তাঁর মামা সুশীল রায় জানান, তাঁর বোন লক্ষ্মীদেবী সকালে রান্না করে আয়ার কাজে বেরিয়েছিলেন। দুপুরে সম্রাট ও তাঁর দিদিমা বকুল রায় ভাত খান। তার পরেই দিদিমাকে চৌকিতে কম্বল চাপা দিয়ে শুইয়ে সম্রাট স্নানে গিয়েছিলেন। এক বার কুয়োর ঠান্ডা জল গায়ে ঢালার পরেই সম্রাট মৃগীতে আক্রান্ত হন বলে সুশীলবাবুর অনুমান। প্রতিবেশী সবিতা দত্ত এবং ওই বাড়ির অন্য ভাড়াটে পারমিতা অধিকারী জানান, তাঁরা বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ সম্রাটকে কুয়োর ধারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলেন। হঠাৎ ভারী কিছু পড়ার শব্দ শুনে তাঁদের মনে হয়েছিল, ওই যুবকই সেখানে পড়ে গিয়েছেন।
পুলিশ সূত্রের খবর, প্রথমে পাড়ার লোকেরাই উদ্ধারকাজে হাত লাগান। তাঁরা ব্যর্থ হলে খবর যায় রিজেন্ট পার্ক থানায়। উদ্ধারে নামে কলকাতা পুলিশের বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী এবং দমকল। সূত্রের খবর, সঙ্কীর্ণ ওই কুয়োয় নেমে সম্রাটকে তুলতে বাহিনীর কর্মীরা বারবার ব্যর্থ হচ্ছেন দেখে প্রশাসনের একটি অংশ সিদ্ধান্ত নেয়, এলাকার পাতকুয়ো মিস্ত্রিদের কাজে লাগানো হবে। সেই মতো মেঘনাদকে খুঁজে আনেন কর্তারা। কুয়োয় নেমে মেঘনাদ টেনেও তুলেছিলেন সম্রাটকে। কিন্তু এক বার দড়ি ছিঁড়তেই ঠান্ডা এবং অন্ধকারের কথা বলে উদ্ধারকাজ স্থগিত করে দেওয়া হয়। শনিবার সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ সেই মেঘনাদকেই ফের ডেকে আনিয়ে তোলা হয় সম্রাটের দেহ।
এ দিন ওই এলাকারই এক অনুষ্ঠানে মেঘনাদকে পুরস্কৃত করার কথা ঘোষণা করেন রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। কলকাতা পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, তাঁকে সিভিক ভলান্টিয়ারের চাকরি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সূত্রের খবর, তাঁকে পুরস্কৃত করবেন দমকল কর্তারাও।
এ সবেও অবশ্য আফশোস মিটছে না মেঘনাদের। তাঁর কথায়, ‘‘রাতেই ছেলেটিকে উদ্ধার করতে পারতাম। আর এক বার সুযোগ পেলেই হয়ে যেত।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy