Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Mental Depression

গুরুত্বহীন বয়স্কেরা, আঁধারে ডুবছে স্মৃতি

২০০৮ সালে সার্ভে পার্কে পথ চলা শুরু হয়েছিল কলকাতার একমাত্র সেন্টারের। আসন মাত্র দশটি‌।

ব্ল্যাক ছবির একটি দৃশ্যে স্মৃতি হারানো বৃদ্ধের ভূমিকায় অমিতাভ বচ্চন।

ব্ল্যাক ছবির একটি দৃশ্যে স্মৃতি হারানো বৃদ্ধের ভূমিকায় অমিতাভ বচ্চন।

জয়তী রাহা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০২১ ০৬:১২
Share: Save:

বছর কয়েক আগে ধরা পড়েছিল তাঁর পারকিনসন্স ডিজ়িজ়। সঙ্গে ডিমেনশিয়া। সেই থেকেই বদলে গিয়েছিল ৮১ বছরের রেণুকা বসুকে ঘিরে থাকা জীবন। সল্টলেকের বাসিন্দা ওই বৃদ্ধার ছেলে বিদেশে থাকেন। দুই মেয়ে বিবাহিতা। নিঃসঙ্গ, অসুস্থ মায়ের দেখাশোনা করতে তাই তাঁর সঙ্গেই থাকেন ছোট মেয়ে। কর্মসূত্রে যাঁর স্বামী শিমলায় এবংমেয়ে মুম্বইয়ে থাকেন। অনেক খোঁজ করেও ২৪ ঘণ্টা তো দূর, এ শহরে কোনও ডে কেয়ার সেন্টারের সন্ধান পাননি বৃদ্ধার ছোট মেয়ে, পেশায় শিল্পী অর্পিতা বসু।

একই অবস্থা দমদমের বাসিন্দা, তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী সুদীপ্ত ভট্টাচার্যের। অ্যালঝাইমার্সে আক্রান্ত বাবাকে সামলান তিনিই। ৭৫ বছরের মায়ের ভরসায় বাবাকে রেখে যাওয়া উচিত নয় মনে করেই অফিস থেকে পাঠানো সুইৎজ়ারল্যান্ডের প্রজেক্টে না করে দিয়েছিলেন। সুদীপ্তের কথায়, “অনেক খোঁজ করে একটি ডে-কেয়ারের সন্ধান পেয়েছিলাম। কিন্তু সিট এতই কম যে, জায়গা পাইনি। ভেবেছিলাম, দিনের কয়েক ঘণ্টাও যদি বাবা ওখানে থাকেন, মায়ের চাপ কিছুটা কমবে। কারণ, এমন রোগীকে যে কোনও আয়ার ভরসায় রাখা যায় না। বিশেষ তদারকি জরুরি।”

প্রিয় মানুষটিকে কাছ থেকে দেখে সুদীপ্ত যে সারসত্য বুঝেছেন, তা বোঝেননি বেশির ভাগই। তাই শুধু এ শহর কেন, গোটা রাজ্যেই ডিমেনশিয়ায় আক্রান্তদের জন্য ২৪ ঘণ্টার তো কোন ছাড়, ডে-কেয়ারের কোনও সন্ধানই মিলবে না।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, সারা বিশ্বে পাঁচ কোটি মানুষ ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত। প্রতি বছর এক কোটি নতুন রোগীর সন্ধান
মিলছে। ‘অ্যালঝাইমার্স অ্যান্ড রিলেটেড ডিজ়অর্ডার সোসাইটি অব ইন্ডিয়া’র (এআরডিএসআই) তথ্য অনুযায়ী, শুধু এ রাজ্যেই ডিমেনশিয়া রোগীর সংখ্যা ৮০ হাজার। ডিমেনশিয়া কোনও রোগ নয়। উপসর্গ মাত্র। ওই উপসর্গের সাধারণ কারণ অ্যালঝাইমার্স। ডিমেনশিয়ায় আক্রান্তদের ৭০ শতাংশই অ্যালঝাইমার্সের শিকার। এ ছাড়াও রয়েছে স্ট্রোক-সহ একাধিক কারণ।

ডিমেনশিয়ার কোনও উপশম নেই। ক্রমশ অবনতি ঠেকাতে চিকিৎসকেরা ওষুধ দিয়ে থাকেন। সঙ্গে জরুরি শরীর ও মনের বিশেষ ব্যায়াম, রোগীর যত্ন। অথচ, সে সব এক ছাতার নীচে দেওয়ার ব্যবস্থা বলতে এআরডিএসআই পরিচালিত রাজ্যের একটি মাত্র ডে-কেয়ার সেন্টার‌। সারা দেশে সোসাইটির ডে-কেয়ার সেন্টার আটটি এবং ২৪ ঘণ্টা পরিষেবা কেন্দ্র আছে সাতটি, যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। যার মধ্যে শুধুমাত্র কেরলেই দু’টি ডে-কেয়ার এবং চারটি ২৪ ঘণ্টার কেন্দ্র আছে।

২০০৮ সালে সার্ভে পার্কে পথ চলা শুরু হয়েছিল কলকাতার একমাত্র সেন্টারের। আসন মাত্র দশটি‌। সোম থেকে শনিবার, সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টে পর্যন্ত খোলা থাকে সেটি। নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে রোগীর খাওয়া এবং দেখাশোনার দায়িত্ব সোসাইটির। সেখানে সাম্প্রতিক নানা ঘটনা নিয়ে আলোচনা এবং বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্তদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে উজ্জীবিত করা হয়।

এআরডিএসআই, কলকাতা চ্যাপ্টারের সেক্রেটারি নীলাঞ্জনা মৌলিক বললেন, “এ ছাড়া সোসাইটির নিজস্ব মেমোরি ক্লিনিক চলে চন্দননগরে। সোসাইটির তরফে বিভিন্ন জায়গায় সচেতনতা শিবির হয়। তবে রোগী রেখে দেখভালের কেন্দ্র রাজ্যে একটিই। আসন যথেষ্ট সীমিত। কারণ, পর্যাপ্ত আর্থিক এবং প্রয়োজনীয় দক্ষ কেয়ারগিভারের অভাব।”

সোসাইটির প্রেসিডেন্ট, স্নায়ুরোগ চিকিৎসক অমিতাভ ঘোষের আবার মত, “এই রোগীদের প্রশিক্ষিত লোকের অধীনে রেখে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে চিকিৎসা জরুরি। কিন্তু সেই দীর্ঘ প্রশিক্ষণ নেওয়া মানুষের একাগ্রতার অভাব আছে এখানে। আমরা কলকাতার আশপাশে জমি খুঁজছি। চন্দননগরে যে জায়গা আছে, সেখানে সরকারি সাহায্য নিয়ে কিছু করার বিষয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। তবে সে কাজে আরও গতি আসা দরকার।”

বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সের স্নায়ুরোগ চিকিৎসক অতনু বিশ্বাসের আক্ষেপ, “কেরলে সাধারণ মানুষের মধ্যে সামাজিক সেবার মানসিকতা রয়েছে। সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থাও যথেষ্ট উন্নত। ওখানে সাব ডিভিশনাল হাসপাতালে পর্যন্ত ডিমেনশিয়া ক্লিনিক থাকে। আমরা যেটা ভাবতে পারি না। কেরল এবং কর্নাটকে ডিমেনশিয়া রোগীদের পরিষেবা দেওয়ার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয়, কারণ সরকার গুরুত্ব দেয়।”

আমাদের রাজ্যে সরকার কেন পিছিয়ে?

স্বাস্থ্য ভবনের এক কর্তার কথায়, ‘‘প্রাথমিক স্বাস্থ্য নিয়েই এত হাবুডুবু খেতে হয় যে, মা ও শিশুর চিকিৎসা সামলে বয়স্কদের নিয়ে ভাবার মতো পরিকাঠামো গ্রামাঞ্চলে এখনও স্বপ্ন।”

তবে কি মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে স্মৃতির অন্ধকারে ডুববে রাজ্যের প্রবীণদের ভবিষ্যৎ?

অন্য বিষয়গুলি:

Mental Depression Old Age
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy