Advertisement
০৪ নভেম্বর ২০২৪

সজলের মৃত্যুতে কি আলোয় আসবে মডেলদের উপেক্ষা

মেট্রোর দরজায় হাত আটকে সজলকুমার কাঞ্জিলালের মর্মান্তিক মৃত্যু এখন মডেলদের এমন অজস্র করুণ জীবন-আলেখ্য উস্কে দিচ্ছে।

স্মৃতিটুকু: সজলকুমার কাঞ্জিলালকে মডেল করে তৈরি এই মূর্তি রয়েছে আর্ট কলেজের বাগানে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

স্মৃতিটুকু: সজলকুমার কাঞ্জিলালকে মডেল করে তৈরি এই মূর্তি রয়েছে আর্ট কলেজের বাগানে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

ঋজু বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ জুলাই ২০১৯ ০২:৪৭
Share: Save:

বিকাশ ভট্টাচার্যের বহু ক্যানভাসে এখনও বেঁচে আছেন মডেল জয়ন্তীলাল। উত্তরপ্রদেশজাত, পেটানো চেহারার পুরুষের শেষ জীবন কেটেছিল হতদরিদ্র দশায়। অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস চত্বরে কার্যত ভিখারির ভূমিকায় সাহায্যপ্রার্থী হিসেবে তাঁকে ঘুরতে দেখেছেন আজকের বহু চিত্রশিল্পী-ভাস্কর। কিংবা সরকারি আর্ট কলেজের প্রাক্তনী, বহু প্রবীণ শিল্পীর প্রিয় ‘সোনালিদি’র কথাই ধরা যাক! পায়ের উপর দিয়ে অটো চলে যাওয়ার পরে তাঁর শেষ জীবনটা চরম অসহায়তায় কেটেছিল বলে শোনা যায়।

মেট্রোর দরজায় হাত আটকে সজলকুমার কাঞ্জিলালের মর্মান্তিক মৃত্যু এখন মডেলদের এমন অজস্র করুণ জীবন-আলেখ্য উস্কে দিচ্ছে। ‘একুশে আইন আর গণেশ পাইন’-এর শহরে বছরভর ভাস্কর্য-চিত্র প্রদর্শনীর ছড়াছড়ি। কিন্তু শিল্পীকুলের শিল্পী হয়ে ওঠার সলতে পাকানো যাঁদের ভরসায়, আর্ট কলেজ বা অ্যাকাডেমি তল্লাটের সেই মডেলদের জীবন জুড়ে শুধুই উপেক্ষা আর অপমান।

‘‘সজল তো মনে হয়, নেই হয়েই প্রাণে বাঁচলেন! আমাদের জীবন, সংসারটা আর কত দিন টানব বলতে পারেন?’’— জাদুঘরের পাশে সরকারি আর্ট কলেজের বাগানে নারীকণ্ঠে ঝাঁঝালো ভঙ্গিতে এমন প্রশ্ন ধেয়ে এল। যিনি কথাগুলো বলছেন, কাঁধে ব্যাগ, চশমা-নাকে সিল্কের শাড়ির আটপৌরে সেই মহিলাকে দেখে প্রায় অবসরের বয়স ছুঁইছুঁই, বাসে-ট্রেনে কাঠখড় পোড়ানো ‘দিদিমণি’ বা ‘মাসিমা’র কথাই মনে হয়। তাঁর পাশে আরও দু’তিন জন। প্রসাধনহীন, মলিন শাড়ির সাজ। সরকারি আর্ট কলেজের জনা দশেক মডেলদের অন্যতম ওই প্রৌঢ়ারা। কলেজের ভাস্কর্য বিভাগের শিক্ষক তন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘‘মোটামুটি ১০-১৫ বছর হল, নতুন মডেল কেউ আসছেনই না।’’

জীবন দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে ঝুঁকলেও সামাজিক লজ্জা বা পোশাক খুলে শিল্পীর সামনে দাঁড়ানোর গ্লানি এখনও ছিটেফোঁটা কমেনি এই ২০১৯-এ। মাস্টারমশাই-শিল্পীরা পদে পদে সতর্ক করেন, ‘‘সাবধানে লিখবেন, ওঁদের বাড়িতেও কিছু জানে না। জানাজানি হলে কিন্তু ছেলেমেয়ের বিয়ে হবে না।’’ প্রৌঢ়া নারী বোঝাতে থাকেন, ‘‘কোমর-হাঁটুর ব্যথা নিয়ে মডেল হয়ে সকাল দশটা থেকে বিকেল চারটে পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকতে কেমন লাগে বোঝেন? আর কত টাকা পাই জানেন?’’ আর্ট কলেজের আজকের মডেলদের মধ্যে দু’জন রয়েছেন ১৯৭৪ ও ১৯৭৬ থেকে। তখন তাঁরা টেনেটুনে ১৪ কী ১৫ বছর। এক

বেলা মডেল হয়ে মিলত চার টাকা। তিন বছর হল, ধাপে ধাপে তা বেড়ে ১০০০ টাকা হয়েছে। তবে শরীরের কিছুটা ঢাকা থাকলে ৮৫০ টাকা। দমদমের ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজ বা রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে কিন্তু সিটিংপিছু ৪০০ ও ৫০০ টাকার বেশি মেলে না। সরকারি আর্ট কলেজের মডেলরা বলছিলেন, গত বছরের পুজোর আগের টাকা পাওয়া গিয়েছে চলতি বছরের মার্চে! এখনও ন’-দশ মাসের বকেয়া বাকি।

ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজে চিত্রকলার শিক্ষক শমীন্দ্রনাথ মজুমদার বা রবীন্দ্রভারতীর ভাস্কর্য বিভাগের দেবাশিস ভট্টাচার্যদের বক্তব্য, ‘‘ছাত্রেরা অনেকেই এক মডেল নিয়ে কাজ করতে বিরক্ত হন। কিন্তু উপায় কী?’’ নতুন সিমেস্টার-ভিত্তিক পাঠ্যক্রমেও আর্ট কলেজগুলোতে মডেল নিয়ে কাজের সুযোগ ক্রমশ কমছে। বছরে টেনেটুনে ২০-৪০ দিন কাজ পান এক জন মডেল। আর্ট কলেজের এক প্রৌঢ়া মডেল বলেন, ‘‘কয়েক মাস আগে কালীঘাটে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে দেখা করে সব বলতে গিয়েছিলাম। উনি আমায় ডাকলেনও। আমার কেসটা দেখতে বললেন অফিসারদের। কিন্তু তার পরে কী হল? একটা পাকা চাকরি, নিদেনপক্ষে এই বয়সে পেনশনের টাকাও কি প্রাপ্য ছিল না?’’ আর্ট কলেজের অধ্যক্ষ ছত্রপতি দত্ত সমস্যাটা বোঝেন। তাঁর আশা, ‘‘সজলবাবুর সূত্রে তা-ও হয়তো মডেলদের আর্থিক দুরবস্থার বিষয়ে সকলের চোখ খুলবে।’’

আর্ট কলেজের বাগানে ফাইবার গ্লাস, প্লাস্টার অব প্যারিসের আধারে নানা ভঙ্গিতে মূর্তি হয়ে এখনও দাঁড়িয়ে সজল কাঞ্জিলাল। গরিব হয়েও প্রখর মর্যাদাবোধসম্পন্ন সেই মডেলকে ঘিরে দীর্ঘশ্বাস জমাট বাঁধে। ‘‘মডেলদের দেহের আদলে শিল্প হয়। পর্নোগ্রাফি বা অশ্লীল ছবি নয়।’’— বলছিলেন প্রবীণ ভাস্কর বিমল কুন্ডু। ‘‘চিন্তামণি কর সেই কবে প্যারিস থেকে ফিরে মডেলদের মর্যাদা-সম্মান নিয়ে লিখেছিলেন। কিন্তু আমাদের সমাজে তাঁদের মর্যাদা ফিরল না। আর সেটা ছাড়া, মডেলদের অর্থনৈতিক হাল ফেরাও মুশকিল।’’— সজলবাবুকে হারানোর বিষাদেও এই প্রত্যয়েই স্থিত হন শিল্পীরা।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE