(বাঁ দিকে) জয়ন্ত সিংহ। সৌগত রায় (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।
পুলিশ-প্রশাসন সবই যেন ‘তুচ্ছ’ তার কাছে। তাই, চোর সন্দেহে এক পুরুষ ও মহিলাকে তুলে আনা হয়েছিল আড়িয়াদহের ‘ত্রাস’ জয়ন্ত সিংহ ওরফে ‘জায়ান্টের আদালত’-এ। সেখানে চ্যাংদোলা করে যুবককে লাঠিপেটা করার ভিডিয়ো (আনন্দবাজার পত্রিকা সত্যতা যাচাই করেনি) সোমবার রাতে প্রকাশ্যে আসতেই উত্তাল রাজ্য রাজনীতি। তার অভিঘাতে এত দিন কার্যত হাত গুটিয়ে থাকা পুলিশ-প্রশাসনও নড়েচড়ে বসেছে। তবে শেষ পর্যন্ত ফল কী হবে, তা নিয়ে সন্দিহান অনেকেই। কারণ এর মধ্যেই জয়ন্তকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা না করলে খুন করে দেওয়া হবে, এই মর্মে হুমকি ফোন পেলেন সাংসদ সৌগত রায়।
বুধবার ব্যারাকপুরের নগরপাল অলোক রাজোরিয়া সাংবাদিক বৈঠক করে জয়ন্তকে ‘হিস্ট্রি শিটার’ (যার দীর্ঘ অপরাধের রেকর্ড রয়েছে) বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি জানান, মারধরের ভিডিয়োটি ২০২১-এর। তা থেকে জয়ন্তের আট শাগরেদকে চিহ্নিত করা হয়েছে। আরও যাদের ভিডিয়োতে দেখা যাচ্ছে না, তাদের অন্যান্য বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। ঘটনাটিতে বেলঘরিয়া থানা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৪১ (বলপূর্বক আটকে রাখা), ৩৫৪ (শ্লীলতাহানি), ৩২৬ (অস্ত্র দিয়ে মারধর), ৩০৮ (খুনের মতো করে মারধর), ৫০৬ (ভয় দেখানো) এবং ৩৪ নম্বর (একই উদ্দেশ্যে জড়ো হওয়া) ধারায় মামলা দায়ের করেছে। যে হেতু ভিডিয়োগুলি বছর কয়েক আগের, তাই পুরনো আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন নগরপাল। তিনি বলেন, ‘‘ওই মারধরের ঘটনায় ছ’জন গ্রেফতার হয়েছে। বাকিদেরও ধরা হবে।’’
আড়িয়াদহে ছেলে ও মাকে রাস্তায় ফেলে পেটানোর ঘটনায় জয়ন্ত, সৈকত মান্না ওরফে জঙ্ঘা, সুদীপ সাহা ওরফে গুড্ডু আগেই গ্রেফতার হয়েছে। তাদের মারধরের ঘটনায় যুক্ত করার পাশাপাশি নতুন করে অভিষেক বর্মণ ওরফে ছোট্টু, সুভাষ বেরা, সুমন দে-কে মঙ্গলবারই গ্রেফতার করা হয়েছে। ছ’জনকে এ দিন মারধরের মামলায় ব্যারাকপুর আদালতে তোলা হলে বিচারক ছ’দিনের পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দেন। পুলিশ জানাচ্ছে, ২০২১ সালে আড়িয়াদহের বাসিন্দা রাহুল গুপ্তের বাড়িতে চুরি হয়। তাতে জড়িত সন্দেহে ওই যুবক ও যুবতীকে জয়ন্তের ‘আদালত’ তালতলা ক্লাবে নিয়ে এসেছিল রাহুলই। জয়ন্তের শাগরেদরা যুবককে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে ‘বিচার’ শুরু করেছিল। প্রশ্ন হল, কাউকে চোর সন্দেহ হলে, তা খতিয়ে দেখার জন্য তো পুলিশ রয়েছে। তা হলে ক্লাবে কেন আনা হয়েছিল?
স্থানীয়েরা বলছেন, ‘‘আড়িয়াদহে তো জয়ন্তই পুলিশ, আদালত। ওর দলবলই সব ঘটনায় বিচারসভা বসাত।’’ এ দিন নগরপাল জানান, ওই যুবক ও যুবতীকে চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। অন্য দিকে, ক্লাব সংলগ্ন বন্ধ বাজারে রাতে জয়ন্তের শাগরেদ তন্ময় ধর ওরফে বাপ্পার রিভলভার প্রশিক্ষণ দেওয়ার ভিডিয়োও মঙ্গলবার প্রকাশ্যে এসেছে। বাপ্পাও এখন পুলিশের জালে। আর একটি ভিডিয়োও ওই দিন প্রকাশ্যে আসে। তাতে চোর সন্দেহে এক নাবালকের যৌনাঙ্গে সাঁড়াশি চেপে ধরতে দেখা গিয়েছিল জয়ন্তের শাগরেদ প্রসেনজিৎ দাস ওরফে লাল্টুকে। ওই ঘটনাতেও স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৪১, ৩২৫ (মারাত্মক ভাবে জখম), ৩০৮ ধারায় মামলা দায়ের হয়েছে। নগরপাল বলেন, ‘‘ওই অভিযুক্তেরও খোঁজ চলছে। যে যত বড় মাতব্বরই হোক, কাউকে রেয়াত করা হবে না।’’
কিন্তু ক্রমশ ‘জায়ান্ট’ হয়ে ওঠা বছর পঁয়ত্রিশের যুবকের ‘মাতব্বরি’র খবর এত দিন পুলিশ পায়নি কেন? তা হলে কি রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের মদতেই সাত খুন মাফ? প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। কারণ, মঙ্গলবার রাত ৩টের সময়ে ‘জায়ান্ট’কে ছাড়িয়ে আনা না হলে গুলি করে খুনের হুমকি দেওয়া হয়েছে সাংসদ সৌগত রায়কে। তিনি জানান, অচেনা নম্বর থেকে ফোন করে বাংলা-হিন্দি মিলিয়ে অশ্রাব্য ভাষায় জয়ন্তকে ছাড়িয়ে আনার জন্য বলা হয়। তা না করলে আড়িয়াদহে ঢুকলে ‘বিপদ’-এর হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়। সৌগত বলেন, ‘‘ঠিক সাত মিনিট পরে আর একটি অচেনা নম্বর থেকে ফোন করে একই হুমকি দেয় কেউ। নগরপালকে নম্বর দু’টি পাঠিয়েছি। আমি এতে বিচলিত নই। আজও কামারহাটি গিয়েছিলাম।’’ নম্বর দু’টি চিহ্নিত করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
এর পাশাপাশি, বুধবার ফের একটি ভিডিয়ো প্রকাশ্যে এসেছে। যেখানে গত বছর গভীর রাতে এক যুবকের বাড়ি লক্ষ্য করে ইট ছুড়ে জানলার কাচ ভাঙতে দেখা যাচ্ছে জয়ন্তের শাগরেদদের। দলে রয়েছে এক তরুণীও। ওই যুবক পুরনো বাড়ি ভাঙার কাজ করতেন। সেই কাজ জয়ন্তের সিন্ডিকেটে থেকে করার চাপের কাছে নতিস্বীকার করতে চাননি তিনি। তাঁর মা এ দিন বলেন, ‘‘রাত প্রায় ৩টের সময়ে জয়ন্তের দলের লোকজন এসে ছেলের নাম করে ডাকে। তার পরেই ইট ছুড়ে কাচ ভাঙতে থাকে। আমি ছাদে উঠে লুকিয়ে ভিডিয়ো করেছিলাম।’’ অভিযোগ, ভিডিয়ো-সহ দক্ষিণেশ্বর থানায় এফআইআর দায়ের করলেও কিছুই হয়নি।
স্থানীয়েরা বলছেন, ‘‘এমন ‘অত্যাচার’-এর ভিডিয়ো আরও কত সামনে আসে, সেটাই দেখার।’’ পুলিশ বলছে, দীর্ঘ অপরাধে অভিযুক্তদের বন্ড দিয়ে ভদ্র আচরণ করার স্বীকারোক্তি দিতে হয়। জয়ন্তও দিয়েছিল। তা ভঙ্গ হওয়ায় সিআরপিসি-র ১১০ নম্বর ধারাতেও তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। বাসিন্দারা বলছেন, ‘‘পুলিশ আগে কড়া হলে হয়তো জয়ন্তের এত বাড়াবাড়ি হত না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy