‘আনন্দবাজার পত্রিকা শাবাশ বাংলা’ আয়োজিত আলোচনাসভায় রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য ও অপরাজিতা দাশগুপ্ত। শুক্রবার। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী
এক জন বিদ্যাসাগরের মধ্যে মিশে রয়েছেন কত জন বিদ্যাসাগর? নারী-শিক্ষা, বিধবা বিবাহের প্রসারে ব্রতী সমাজ সংস্কারক বিদ্যাসাগর? না বাংলা ভাষার সংস্কারের দিশারী বিদ্যাসাগর? শুক্রবার সন্ধ্যায় জবাব খুঁজল বইমেলার মাঠ। ‘আনন্দবাজার পত্রিকা শাবাশ বাংলা’র সহায়তায় কলকাতা সাহিত্য উৎসবের আসর মগ্ন হল বিদ্যাসাগরের দ্বিশতবর্ষের উদ্যাপনে।
বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়নের কথা উঠল অনিবার্য ভাবেই। দর্শন, ইতিহাসের গবেষক-প্রাবন্ধিক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য মনে করালেন, বিদ্যাসাগরের চরিত্রের নির্যাস হিসেবে ‘অক্ষয় পৌরুষের’ কথা বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। আবার বাংলা ভাষার সঙ্গে বিদ্যাসাগরের ‘নাড়ির যোগের’ কথাও বলেছেন। কিন্তু ভাষা সংস্কারক বিদ্যাসাগরও কি সেই পৌরুষের ধারাই বহন করছেন না? রামকৃষ্ণবাবুর কথায়, ‘‘প্রাক্ বিদ্যাসাগর যুগে বাংলা ভাষায় অন্বয় স্থিরতা ছিল না। বিদ্যাসাগরের হাতে বাংলা গদ্যেরও তাল খুলল। জন ড্রাইডেন যাকে, ‘আদার হারমনি অব প্রোজ়’ বলেছিলেন।’’
পশ্চিমবঙ্গ পুস্তক পরিষদের মুখ্য কার্যনির্বাহী আধিকারিক তথা রাজ্য ঐতিহ্য আয়োগের সদস্য অপরাজিতা দাশগুপ্ত আবার বিদ্যাসাগরের সামাজিক সংস্কারের অভিঘাতের প্রসঙ্গে কথা বলছিলেন। ‘‘পতি বিয়োগ হলেই নারী শরীর পাষাণবৎ হয় না— এটা বুঝিয়েই বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহের পক্ষে তাঁর যুক্তি সাজিয়েছিলেন।’’— বললেন অপরাজিতা। তাঁর মতে, কুন্দনন্দিনীর রূপকার বঙ্কিমচন্দ্র বরং ‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসে ঢের মোলায়েম স্বরে সমাজের সমালোচনা সেরেছিলেন। ‘‘বিধবা বিবাহ নিয়ে বিদ্যাসাগরের লেখা তৎকালীন সমাজের ভণ্ডামির গায়ে চপেটাঘাত।’’
কিন্তু ১৮৫৬-১৯১১ পর্যন্ত সাকুল্যে ৫০০-র কিছু বেশি বিধবা বিবাহ হয়েছিল। তবে বিদ্যাসাগর মেয়েদের জন্য ১২০০টির বেশি প্রাথমিক স্কুলই প্রতিষ্ঠা করেন। অপরাজিতার মন্তব্য, ‘‘আজকের জেন্ডার ইকুয়ালিটি বা লিঙ্গ সাম্যের ধারণারও বিদ্যাসাগরের হাতেই গড়ে ওঠা শুরু।’’
রবীন্দ্রনাথের দ্বারা নন্দিত বিদ্যাসাগর আবার কখনও রবীন্দ্রনাথকেও ছাপিয়ে গিয়েছেন, মত রামকৃষ্ণবাবুর। বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’-তে রয়েছে, বিদ্যাসাগরের ‘সীতার বনবাস’-এর বহুচর্চিত অংশের মুখস্থ শ্রুতিলিখন নিয়ে অপুর মুগ্ধতার কথা। ‘এই সেই জনস্থানমধ্যবর্তী প্রস্রবণ গিরি।’ রামকৃষ্ণবাবুর মতে, সহজপাঠ কিন্তু বর্ণপরিচয়ের মতো সর্বজনীন হয়নি।
বিদ্যাসাগরের ব্যক্তিজীবনের প্রসঙ্গও উহ্য থাকেনি। সঞ্চালক-সাংবাদিক চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের প্রশ্ন, বিদ্যাসাগরের পরিবারের নারীদের সঙ্গে সম্পর্ক কতটা খাপ খেয়েছে মেয়েদের জন্য মেলে ধরা তাঁর আদর্শের সঙ্গে? বিদ্যাসাগরের পারিবারিক জীবন, স্ত্রী, সন্তানদের সম্পর্ক মোটেও নিটোল ছিল না। কিন্তু তার ভিত্তিতে বিদ্যাসাগরের মূল্যায়ন যথাযথ নয় বলেই মত অপরাজিতার। তিনি বললেন, ‘‘সত্যের জন্য একলা চলার স্পর্ধায় বিদ্যাসাগর কখনও কোনও ফাঁক রাখেননি।’’
আজ যখন আমরা কে কোন দিকে বা দলে আছে বলে সবাইকেই সন্দেহ করি, বিদ্যাসাগর তখন নিঃসঙ্গ একলা অনন্যই থেকে গিয়েছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy