বাড়ি ফেরার আগে হাসপাতালে মঞ্জু দত্ত। নিজস্ব চিত্র।
বৃষ্টির মধ্যে বাড়ির উঠোনে পড়ে গিয়ে মাথায় চোট পেয়েছিলেন ৬৩ বছরের প্রৌঢ়া। প্রায় এক মাস কোমায় থাকার পরে জ্ঞান ফিরলেও, গভীর ভাবে আচ্ছন্ন ছিলেন। মাঝেমধ্যে পায়ের আঙুলটা শুধু নড়ে উঠত। রবীন্দ্রসঙ্গীত ও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ছন্দেই তাঁর আচ্ছন্নতা কাটাল এসএসকেএম হাসপাতাল। পাঁচ মাসের হাসপাতাল-বাস শেষে সোমবার বাড়ি ফিরে গিয়েছেন প্রৌঢ়া।
প্রৌঢ়ার পরিজনেরা বলছেন, ‘‘দুই বেসরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে চিকিৎসায় কয়েক লক্ষ টাকা খরচ হলেও, অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম।’’ সেখানে দিনের পর দিন জোরালো আলো ফেলে (লাইট থেরাপি) চোখ খোলানো থেকে শুরু করে প্রায় পাঁচ মাসের চিকিৎসায় নিজে থেকে উঠে বসা, দাঁড়ানো, কথা বলা, খাবার খাওয়ার মতো অবস্থায় আবার প্রৌঢ়াকে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছেন এসএসকেএমের চিকিৎসকেরা।
কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা জিতেন্দ্রনাথ দত্ত জানাচ্ছেন, গত ৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় তিনি বাড়ি ফিরে দেখেন, উঠোনে জমা জলে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন স্ত্রী মঞ্জু দত্ত। স্থানীয় একটি হাসপাতালে ৪ সেপ্টেম্বর তাঁকে ভেন্টিলেশনে দেওয়া হয়। কিন্তু এক সপ্তাহ পরেও অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় কোমায় থাকা মঞ্জুদেবীকে স্থানান্তরিত করা হয় বাইপাসের একটি বেসরকারি হাসপাতালে।
কয়েক দিন পরে মঞ্জুদেবীর জ্ঞান ফিরলে তাঁকে ভেন্টিলেশন থেকে বার করে আইসিইউ-তে রাখা হয়। দীর্ঘ দিন রাইলস টিউব ও ট্র্যাকিয়োস্টমি নল পরানো থাকার কারণে বার বার ফুসফুসে সংক্রমণ হয়ে সেপসিসে আক্রান্ত হচ্ছিলেন প্রৌঢ়া। তাঁর বোনঝি রুনু দত্ত সেন বলেন, ‘‘জ্ঞান ফিরলেও উনি গভীর ভাবে আচ্ছন্ন ছিলেন। উন্নতি বলতে শুধু পায়ের একটা আঙুল নাড়ানো এবং চোখ খোলার চেষ্টা। প্রায় ২০ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছিল। খরচও আর টানতে পারছিলাম না।’’ শেষে গত বছরের ২২ অক্টোবর রাইলস টিউব পরানো ও ট্র্যাকিয়োস্টমি করা অবস্থাতেই মঞ্জুদেবীকে পিজি-র ফিজ়িক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন (পিএমআর) বিভাগে ভর্তি করেন পরিজনেরা। বিভাগীয় প্রধান চিকিৎসক রাজেশ প্রামাণিক বলেন, ‘‘রোগীকে দেখে প্রথমেই মনে হয়েছিল, আইসিইউ-তে রাখার প্রয়োজন নেই। সাধারণ ওয়ার্ডে রেখে বিভিন্ন ধাপের চিকিৎসা ও থেরাপি দিয়েই ওঁকে আগের জীবনে ফেরানো সম্ভব।’’
চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, মাথায় আঘাতের কারণে প্রৌঢ়ার চোখের স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তাই চেষ্টা করেও চোখ খুলতে পারছিলেন না। তার জন্য শুরু হয় লাইট থেরাপি। একই সঙ্গে মস্তিষ্ক সচল করতে চলতে থাকে মিউজ়িক থেরাপি। বেশ কিছু দিন এমন চলার পরে আচ্ছন্ন ভাব কাটে মঞ্জুদেবীর। এর পরে তাঁর পেটে ফুটো করে ‘পেগ টিউব’ (ওই নলের মাধ্যমে তরল খাবার দেওয়া হয়) লাগানো হয় এবং রাইলস টিউব খোলা হয়। একই সঙ্গে ট্র্যাকিয়োস্টমি করার জন্য গলায় করা ফুটোর ক্ষত শুকোনো এবং শ্বাসনালি পরিষ্কার রাখার চেষ্টাও চালিয়ে যান চিকিৎসকেরা। তাঁদের কথায়, ‘‘রাইলস টিউব খুলে দেওয়ায় প্রৌঢ়ার ফুসফুসের সংক্রমণ কমতে থাকে। ফিজ়িয়োথেরাপি করে ফুসফুসের কর্মক্ষমতাও বাড়ানো হচ্ছিল।’’ এই চিকিৎসা চলাকালীন মঞ্জুদেবী করোনায় আক্রান্ত হন। অগত্যা তাঁকে বাড়িতে কোয়রান্টিনে পাঠানো হয়। জিতেন্দ্রবাবু বলেন, ‘‘অল্প কথা বলতে পারলেও উঠে বসার ক্ষমতা বা নিজে খাওয়ার ক্ষমতা ছিল না। ওঁকে দেখে খুব কষ্ট হত।’’
১ ফেব্রুয়ারি ফের মঞ্জুদেবীকে পিজি-তে ভর্তি করানো হয়। নিজে মুখে খাবার খাওয়ার সময়ে খাদ্যনালিতে কোথায় তা বাধা পাচ্ছে, পরীক্ষায় সেটা চিহ্নিত করে ঠিক করতেই নিজের হাতে খেতে শুরু করেন মঞ্জুদেবী। তখন ‘পেগ টিউব’ও খুলে দেওয়া হয়। রাজেশবাবুর কথায়, ‘‘দীর্ঘ দিন রাইলস টিউব-নির্ভর থাকলে ফুসফুসের সমস্যা বাড়তে থাকে। এতে সংক্রমণ আরও দ্রুত শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে।’’ বিভিন্ন চিকিৎসার পাশাপাশি চলেছে ফিজ়িয়োথেরাপি ও অকুপেশনাল থেরাপি। নিউরো-থেরাপির মাধ্যমে এখন প্রৌঢ়ার মস্তিষ্কও অনেক সচল করা সম্ভব হয়েছে। মাঝেমধ্যে একটু অসংলগ্ন কথা বললেও, তা আস্তে আস্তে ঠিক হবে বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy