—প্রতীকী চিত্র
পেটের দায়ে কর্তব্যে জড়িয়েছি। এ ছাড়া আর কী বলব বলুন? সেই টানেই গত ১৫ বছর ধরে নারায়ণপুর গ্রাম থেকে পার্ক স্ট্রিটের এক হাসপাতালে যাতায়াত করে চলেছি। তাই কোভিড-যোদ্ধা নয়, বরং জীবন-যোদ্ধা বললেই নিজেকে চিনতে পারব। যুদ্ধে টিকে থাকার লড়াইয়ে যার যার মুখোমুখি হব, তাকে সামলে চলতে আমি বাধ্য। এই যার যার-ই একটি হল কোভিড।
বরাবরই টাকার অভাব ছিল বড্ড বেশি। তাই মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করতে পেরেছিলাম। বছর সাতাশির বাবা, স্ত্রী আর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ছেলে রয়েছে বাড়িতে। সব মুখগুলো আমারই ভরসায় চেয়ে। তাই শখ-আহ্লাদ জলাঞ্জলি দিয়ে অনেক ঘুরে শেষে এখানে নোঙর ফেলেছি বছর পনেরো হল। রোগীকে খাইয়ে দেওয়া, তাঁদের গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে একটু স্বস্তি দেওয়া, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে অন্য ফ্লোরে নিয়ে যাওয়া, রোগীর প্রয়োজন মতো অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা, আর ভারী চেহারার রোগী হলে তাঁকে ওঠাতে মহিলা ওয়ার্ডেও ছুটে যাওয়া— এ সব নিয়ে থাকার মাঝেই ভয়াবহ সংক্রমণ এসে পড়ল। সেই সব কাজ এখনও আছে, তবে বেড়ে গিয়েছে ক্ষিপ্রতা। একই সঙ্গে খুব সতর্ক থেকে ডিউটি করতে হচ্ছে। ছোঁয়াচ থেকে সুরক্ষিত থাকতে পিপিই, মাস্ক, ফেসশিল্ড পরছি। বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটের জন্য বেরোলেও মাস্ক ছাড়া থাকি না। সংক্রমণ থেকে বাঁচতে নিয়মগুলো খাওয়া-ঘুমের মতোই জুড়ে নিয়েছি জীবনের সঙ্গে। যে কারণে হয়তো এখনও আমি সুস্থ আছি। অথচ কোভিডের সঙ্গেই দিনরাত ওঠা-বসা!
আমার বাড়ি কুলতলি থানা এলাকার সিদ্ধিবেড়িয়ার নারায়ণপুর গ্রামে। বাড়ি থেকে খানিকটা হেঁটে বাস ধরে আধ ঘণ্টা লাগে লক্ষ্মীকান্তপুর স্টেশনে আসতে। সেখান থেকে হাতে গোনা স্টাফ স্পেশ্যাল ট্রেন ছাড়া এখন আর কিছু পাওয়া যায় না। তাই অনেক হিসেব কষে বেরোতে হয়। এর পরে বালিগঞ্জ থেকে ঘণ্টাখানেক হেঁটে পৌঁছে যাই পার্ক স্ট্রিটের নাইটেঙ্গল হাসপাতালে। বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে সেই যে দুটো মাস্ক পরি, রাস্তায় তা এক বারের জন্যও মুখ থেকে সরাই না। ডিউটি শুরু হওয়ার আগে হাসপাতালের ক্যান্টিনে দুপুরের খাবার খেয়ে নিই। কারণ খালি পেটে কাজ করা এই ক্ষেত্রে বিপজ্জনক।
ওয়ার্ড বয়ের টানা ডিউটিতে নিজেকে আর রোগীদের চাঙ্গা রাখতে শখ নিয়েই বেঁচে আছি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে হেমন্ত, মান্না, মানবেন্দ্র, শ্যামল, সতীনাথ আর পান্নালালের গান আমার গলায় শুনে খুশি হন অনেক অক্সিজেন নেওয়া রোগীও। এমনও হয়েছে, ভেন্টিলেশনের রোগীদের অক্সিজেনের মাত্রা বাড়াতে সেন্ট্রাল লাইন ঠিক করতে গিয়েছি, তখন ফোনে ডাক পড়েছে আমার— ‘প্রদীপদা একটু তাড়াতাড়ি এসো। অমুক বেডের পেশেন্ট গান শুনতে চাইছেন।’ তখন নিজেকে খুব তৃপ্ত লাগে। এর বেশি কিছু ওঁদের জন্য করার মতো বিদ্যেবুদ্ধি তো আমার নেই। তাই এ টুকু খুশি অন্তত মানুষকে দিতে পারলেই আমার শান্তি। রোগী দেখার ফাঁকে বড় বড় ডাক্তারবাবুরাও কখনও দু’কলি শুনে ফেললে ডেকে আবার গান ধরতে বলেন। তখন এই হেলাফেলার জীবন নিয়েও বড় গর্ব হয়।
পাড়াগাঁয়ে জন্ম, বেড়ে ওঠা। যাত্রা-নাটকের প্রতি একটু বেশিই ভালবাসা আমার। এক সময়ে চুটিয়ে অভিনয় করতাম। তবে বাবার এ সব মোটে পছন্দ ছিল না, রাগারাগি করতেন। তাই নেশা মনের কোণেই রয়ে গিয়েছে। পালা করতে না পারলেও দল গড়ে দিতাম। এখন অবশ্য সে কাজও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। রোজ বাড়ি ঢুকে এক বন্ধুর সঙ্গে বসে পালা পাঠ আর গানের চর্চা মনকে সতেজ করে দেয়। ৫০ পার করেও রোজ সকালে দৌড়ই আর স্কিপিং করি।
প্রতিদিন মৃত্যু দেখতে দেখতে ক্লান্তি নিয়ে চলতে হবে এখন। পালানোর পথ নেই, তাই ভাল থাকার রসদ খুঁজতেই হবে।
(লেখক একজন ওয়ার্ড বয়)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy