অনুষ্ঠানে অমিতাভ ঘোষ ও সুপ্রিয়া চৌধুরি। শনিবার। —নিজস্ব চিত্র।
শুধু কুকিরাই মাদক-সন্ত্রাস চালান না! শনিবার বিকেলে মধ্য কলকাতার পাঁচতারা হোটেলে অধ্যাপক সুপ্রিয়া চৌধুরীর এক প্রশ্নের উত্তরে লেখক অমিতাভ ঘোষ বলছিলেন, ‘‘কোনও নির্দিষ্ট জনজাতি নয়, মণিপুরে অনেকেই এই মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকেন। নইলে দুই তরফেই এত অস্ত্র এল কোথা থেকে?’’ তার পরই আন্তর্জাতিক ঘটনার প্রেক্ষিতে সেই পর্যবেক্ষণকে জুড়ে দিলেন তিনি, ‘‘ইউক্রেনকেও অনেকে অস্ত্রসাহায্য করার চেষ্টায় ছিল। কিন্তু সেই অস্ত্র এখন লাতিন আমেরিকার মাদকচক্রের হাতে।’’ টাটা স্টিল কলকাতা লিটারারি মিট-এ এই আলোচনার পরই আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রকাশিত হল জ্ঞানপীঠ পুরস্কারে সম্মানিত লেখকের নতুন বই ‘স্মোক অ্যান্ড অ্যাশেজ়।’
চিন ও ব্রিটেনের আফিম যুদ্ধের প্রেক্ষিতে তাঁর তিন খণ্ডের ‘আইবিস ট্রিলজি’র জন্য গবেষণা করতে গিয়ে যে সব তথ্য পেয়েছেন, সেই সব নথি ও তার অভিজ্ঞতা নিয়েই এই নতুন নিবন্ধগ্রন্থ। সেই বইয়ের শুরু কলকাতাকে দিয়েই। ২০১০ সালে ম্যাকাওতে গিয়ে লেখক আবিষ্কার করলেন, তাঁর হোটেলের মালকিন চমৎকার বাংলা, ইংরেজি ও ক্যান্টোনিজ় বলতে পারেন। কিন্তু মূল চিনা ভূভাগের ‘ম্যান্ডারিন’ ভাষা জানেন না। ভদ্রমহিলার ছেলেবেলা কলকাতায় কেটেছে। ১৯৬২ সালের চিন-ভারত যুদ্ধের সময় শত্রু দেশের নাগরিক সন্দেহে স্থানীয় চিনাদের ওপর যখন হরেক অত্যাচার নেমে আসে, এই পরিবারটিও দেশছাড়া হয়। ষাট-সত্তর দশকে এই চিনারাই দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পুঁজি ও পরিশ্রম বিনিয়োগ করে সেখানকার অর্থনীতি বদলে দেন, আক্ষেপ করেছেন কলকাতার ছেলে। ওই আইবিস ট্রিলজির প্রথম খণ্ড ‘সি অব পপিজ’-এই তো তিনি জানিয়েছিলেন, গাজিপুরের দিতি, কালুয়াদের কী ভাবে কলকাতার জাহাজঘাটা থেকে মরিশাস ও অন্যত্র শ্রমিক হিসেবে পাঠানো হত!
ইতিহাস বদলে যায়। কোভিড-পূর্ব পৃথিবীতে কলকাতায় ওই বইয়ের আনুষ্ঠানিক প্রকাশ ঘটেছিল গঙ্গায় ভাসমান ফ্লোটেলে। আর সেই বই লেখার গবেষণা ও হরেক অভিজ্ঞতা এ দিনের পাঁচতারা হোটেলে। জেমস মিচনারের ‘হাওয়াই’ বা নয়পলের ‘আ বেন্ড ইন দ্য রিভার’ উপন্যাস রচনার হরেক নথি আজও মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে অটুট।
কিন্তু আফিমের এই ইতিহাস তো শুধু উপন্যাস রচনার দলিল নয়, আরও অনেক বেশি। আমাদের আলোকপ্রাপ্তিকে প্রশ্ন করে সে পরিষ্কার দেখায়, ইউরোপের শিল্পবিপ্লব আফিম ব্যবসার টাকায়। অমিতাভ আরও দেখান, জর্জ অরওয়েলের বাবা আফিম ব্যবসার কর্মী ছিলেন। রুডইয়ার্ড কিপলিং ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দু’জনেই গাজিপুরে বৃহত্তম আফিম কারখানার কথা জানতেন। দ্বারকানাথ ঠাকুর আফিম-ব্যবসায় ছিলেন অনেকেই জানেন। কিন্তু অমিতাভের এই নতুন বই ছাড়া কে জানাত, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের ঠাকুরদাও আফিমের ব্যবসাতেই ফুলেফেঁপে ওঠেন!
টানা কয়েক বছর ধরে এই ভাবেই পৃথিবীর ইতিহাসকে দেখেছেন অমিতাভ। মোগল বাদশাহরা আফিম খেতেন, কিন্তু গ্রামকে গ্রাম উজাড় করে সেই চাষে মদত দেননি। ওটি আধুনিকতার অবদান। আফিম ব্যবসাতে তখন সাহেবদের অধীনে বেশির ভাগই বাঙালি। ‘বিবাদী বাগে এখন যেখানে এইচএসবিসির অফিস, সেখানেই ছিল আফিম ব্যবসার সদর দফতর,’ জানালেন লেখক।
শুধু কলকাতা নয়। অমিতাভের ওই উপন্যাসেই ব্রিটিশরা জানিয়েছিল, মুক্ত বাণিজ্য ও গণতন্ত্রের জন্যই তারা চিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে। আফিম থেকে আজকের আফগানিস্তান সর্বত্র এক কথা। আফিম যত দিন ওষুধ হিসাবে ব্যবহৃত হত, অসুবিধা ছিল না। ‘‘শিশুদের উডওয়ার্ডস গ্রাইপ ওয়াটারেও আফিম জরুরি’’, বলছিলেন লেখক। কিন্তু গত দু’তিনশো বছর অন্য রকম। জংলি আফিম নয়, চাষ-করা আফিম যুদ্ধের রমরমা বাড়িয়েছে, বলছিলেন লেখক। মানুষের আলোকপ্রাপ্তি এবং প্রগতির ছকটাই সব নয়, তার আড়ালে রয়ে গিয়েছে লোভের এই দুর্বিষহ কাহিনি।
গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি নিবন্ধেও বরাবর আলোকপ্রাপ্তিকে এ ভাবেই প্রশ্ন করেন অমিতাভ। প্রথম নিবন্ধগ্রন্থ ‘ইমাম অ্যান্ড দি ইন্ডিয়ান’-এ মিশরে তাঁর ও এক গ্রাম্য ইমামের ঝগড়া। ইমাম বলেন, ভারতীয়দের থেকে ইউরোপীয় সাহেবরা উন্নত। ওদের বোমা, অস্ত্র সব ভাল। অমিতাভ বলেন, আমরা ভারতীয়রাও আজকাল পরমাণু বোমা বানাতে পারি। তার পরই খেয়াল হয়, তাঁরা প্রাচীন মিশরীয় ও ভারতীয় সভ্যতার দুই প্রতিনিধিই হিংসা এবং প্রগতির কথা বলছেন। ‘ডান্সিং ইন কাম্বোডিয়া’তে দেখিয়েছিলেন, কাম্বোডিয়ার রাজা প্যারিসে নর্তকীদের দল পাঠিয়েছিলেন। সেই নর্তকীদের এক জন আবার অত্যাচারী পল পটের আত্মীয়া, পল পটও ফ্রান্সে শিক্ষিত। পাশ্চাত্য সভ্যতা যে সবাইকে শিক্ষিত ও মুক্তমনা করে তুলবে, সেগুড়ে বালি। সেই সব অভিজ্ঞতা পেরিয়ে এখন আফিমের ধোঁয়া ও ছাইয়ের আড়ালে থাকা প্রগতিতে বীতশ্রদ্ধ তিনি। বলা বাহুল্য, অমিতাভের এই বই-ই জানায়, ‘স্বাধীনতা’ ও ‘সাম্য’ মার্কিন জনজাতিদের প্রাচীন ধারণা। ইউরোপ সেটিও আত্মসাৎ করেছিল।
এটাই ক্ষমতার আফিম, প্রগতির মৌতাত!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy