প্রতীকী ছবি।
ঘূর্ণিঝড় কেড়ে নিয়েছে অনেক কিছুই। আবার সবটা পারেওনি।
আমপানের দিন কয়েক বাদে কুলতলির ধ্বস্ত বাঁধের আশপাশে বা মৌসুনি দ্বীপের কাছাকাছি পৌঁছে এটাই মনে হচ্ছিল প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূতত্ত্বের প্রাক্তনী তথা সমাজকর্মী অরিজিৎ চক্রবর্তী এবং তাঁর কয়েক জন বন্ধুর। যে গ্রামীণ মানুষগুলোর জীবনে খাদ্য-পানীয় জলের নিশ্চয়তা নেই, তাঁদের ছেলেমেয়েরা এখনও ছেঁড়া বইখাতা নিয়ে ভাঙাচোরা রাস্তায় হেঁটে গৃহশিক্ষকের কাছে পড়তে যাচ্ছে! ভাবনার সুতোটা তখন থেকেই দানা বাঁধার শুরু। একটা হেঁটে-চলে বেড়ানো গ্রন্থাগার কি ওই দুর্গম এলাকাগুলিতেও পৌঁছতে পারে না? ‘সুন্দরবনের শিশু-কিশোরদের জন্য বই দিন’ আর্জি জানিয়ে গ্রন্থাগার গড়ার ডাক এর পরেই ছড়িয়ে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।
অরিজিৎ বলছিলেন, “পড়াশোনা করেও চাকরি নেই, এই বোধ থেকে গ্রামবাংলার অনেক কিশোর-তরুণ পড়াশোনায় আগ্রহ হারায় বলে দেখেছি। তেমনই কেউ কেউ আবার পড়তেও চায়। তুলনায় মেয়েরা কম বাইরে কাজে যান। সুতরাং মেয়েদের মধ্যেই পড়াশোনার প্রবণতা বেশি মনে হয়।”
কুলতলির কাছে হাঁসচরা গ্রামের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে রাত শেষে কলকাতার তরুণ-বাহিনী তাজ্জব! বাঁধ ভাঙা নোনাজলে বিষাক্ত মাটির এই গ্রামেও কোন মেয়ে সাতসকালে গানের রেওয়াজে বসেছে! কিংবা মথুরাপুরের পূর্ব রানাঘাটায় টোটোচালকের ছেলে, পরিবারের প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া, বিদ্যাসাগর কলেজে অঙ্ক অনার্সের ছাত্র আজিজুল হালদারকে দেখেও মনে হয়েছে, অখ্যাত জনপদে লুকনো কত না সম্ভাবনার কথা। কয়েক দশকের রাজনীতিমনস্ক ওই এলাকায় বিদেশে উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্ত দুই যুবকের বাড়ির খবরও মিলেছে। আবার মৌসুনি দ্বীপের পথে পাতিবুনিয়াঘাটের কাছে ঝড়ধ্বস্ত একটি আদিবাসী পাড়ায় ঢুকেও কলকাতার কয়েক জন মুগ্ধ— শতচ্ছিন্ন দারিদ্র্যের মধ্যেও পড়াশোনা শেখার কী বিপুল আগ্রহ! কলকাতার কাছে হয়েও দুর্গম, নিতান্তই প্রান্তিক জনপদের মানুষগুলোর কাছে কাজে-অকাজে পড়ার বই পৌঁছবে কী ভাবে? পর্বত যদি মহম্মদের কাছে যেতে না-পারে, তবে তো মহম্মদকেই পর্বতের কাছে যেতে হবে!
বাঘা যতীনের বাসিন্দা, হাওড়ার পাঁচলার কলেজশিক্ষিকা সঙ্ঘমিত্রা দাস এমনই একটি গ্রন্থাগারকে বয়ে বেড়াচ্ছেন তাঁর কলেজের এলাকা কিংবা বাড়ির আশপাশেও। নানা জনের বাড়িতে থাকা বিভূতিভূষণ-শরৎচন্দ্রের বই থেকে স্কুলকলেজের কেতাব জড়ো করে বেশ কয়েক জন পাঠককে তাঁর সদস্য করেছিলেন সঙ্ঘমিত্রা। সেই গ্রন্থাগারকেই মডেল করে এগোচ্ছেন অরিজিতেরা। পাশে রয়েছেন সঙ্ঘমিত্রা। বিভিন্ন এলাকায় কথা বলে তাঁরা দেখেছেন, স্থানীয় প্রবীণদের অনেকেই এলাকায় গ্রন্থাগার তৈরি নিয়ে উৎসাহী। এক-একবারে কারও এক জনের বাড়িতে বেশ কিছু বই রেখে কিছু দিন অন্তর বই পাল্টে গ্রন্থাগারটি সচল রাখার কথা ভাবা হচ্ছে। পরিকল্পনা রয়েছে, ওই সব এলাকায় ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগারটি ঢুকলেই গল্পপাঠ, গান-কবিতা-নাটকের কর্মশালাও করা হবে। তাতে নতুন বোধের জানলা খুলবে প্রথম বা দ্বিতীয় প্রজন্মের পড়ুয়াদের সামনে।
উদ্যোগটিকে বই বা পরিকাঠামোগত সাহায্য দিতে এগিয়ে এসেছে অনলাইন মাধ্যমে সক্রিয় কলেজ স্ট্রিটে ঘাঁটিগাড়া প্রকাশনা-মঞ্চ ‘গুরুচণ্ডালীও’। দরকারে তাদের স্টলেও বই জমা নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। অরিজিতের বন্ধু, আইএসআইয়ে গবেষণারত সৌম্য চট্টোপাধ্যায় বা বেলঘরিয়ার
কলেজের শিক্ষিকা মুনমুন বিশ্বাসদের মতো কারও কারও আবার বাসন্তী কলোনির অগ্নিকাণ্ডের বিপদের পরে স্থানীয় পড়ুয়াদের পাশে দাঁড়ানোর অভিজ্ঞতা ছিল। তাঁরাও শামিল সুন্দরবনের কাছে বই পৌঁছে দেওয়ার কর্মকাণ্ডে। আপাতত ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপে চেনাজানাদের মধ্যে খবর ছড়িয়েই গ্রন্থাগারের আহ্বায়কেরা, কলকাতার উত্তরে কিংবা দক্ষিণে কোনও একটা নির্দিষ্ট দিন বই সংগ্রহের ডাক দিচ্ছেন। প্রান্তিক পাঠককে হাতছানি দিচ্ছে সেই জড়ো করা বইগুলিই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy