Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

বালি-ইটে শেষ নয়, রক্ষীও সিন্ডিকেটে

ইচ্ছে থাকুক-না থাকুক, বাড়ি বানাতে হলে ইট-বালি-সিমেন্ট কিনতে হবে সিন্ডিকেটের কাছ থেকে। তাতেও রেহাই নেই। নিজের গাঁটের কড়ি খরচ করে বানানো নতুন বাড়ির দরজায় পাহারাদার বসাতে গেলেও সিন্ডিকেটের হুকুম মেনে চলতে হবে! কারণ সিন্ডিকেট-ই ঠিক করে দেবে, তার এলাকার কোনও বাড়িতে রক্ষীর চাকরি কে পাবে!

গার্গী গুহঠাকুরতা
শেষ আপডেট: ২৭ অগস্ট ২০১৪ ০২:৪৯
Share: Save:

ইচ্ছে থাকুক-না থাকুক, বাড়ি বানাতে হলে ইট-বালি-সিমেন্ট কিনতে হবে সিন্ডিকেটের কাছ থেকে। তাতেও রেহাই নেই। নিজের গাঁটের কড়ি খরচ করে বানানো নতুন বাড়ির দরজায় পাহারাদার বসাতে গেলেও সিন্ডিকেটের হুকুম মেনে চলতে হবে! কারণ সিন্ডিকেট-ই ঠিক করে দেবে, তার এলাকার কোনও বাড়িতে রক্ষীর চাকরি কে পাবে!

কেউ যদি সিন্ডিকেটের ফরমান না-শোনেন? নিজের পছন্দের লোককে রক্ষীর কাজে বহাল করেন?

পরিণাম সুখকর না-হওয়ারই সম্ভাবনা। অন্তত স্থানীয় এক ব্যবসায়ীর অভিজ্ঞতা তেমনই বলছে। সিন্ডিকেটের হুকুম অগ্রাহ্য করার ফল তিনি পেয়ে গিয়েছেন হাতেনাতে। সিন্ডিকেটের ‘বাহুবলীরা’ তাঁর লোককে মেরেধরে তাড়িয়েছে। আর মালিককে চোখ রাঙিয়ে বলে গিয়েছে, ভবিষ্যতে এমন সাহস যেন না-দেখান। সাধের বাড়িতে বসবাস শুরু করার আগেই এ হেন বিপত্তিতে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছেন ওই ব্যবসায়ী। “এ বার কি আমার বাড়িতে কে রান্না করবে, কে বাসন মাজবে, কোন মালি বাগান করবে, কাকে ড্রাইভার রাখব, এ সবও সিন্ডিকেট ঠিক করে দেবে?” প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।

করবে না, এমন নিশ্চয়তা কেউ ওঁকে দিতে পারেনি। অতএব তিনি রাজারহাটের নতুন বাড়িতে এসে থাকার পরিকল্পনা আপাতত শিকেয় তুলে রেখেছেন। ঝুটঝামেলার ভয়ে পুলিশের কাছেও যাননি।

সিন্ডিকেটের দাপট রাজারহাটে নতুন কিছু নয়। বিশেষত আবাসন নির্মাতারা বহু দিন ধরেই ভুক্তভোগী। ইমারতি পণ্য কেনা থেকে কর্মী নিয়োগ সর্বক্ষেত্রেই। নতুন যেটা, সেটা হল আবাসনের বাইরে ব্যক্তি-মালিকানার বাড়িতেও কর্মী নিয়োগের ব্যাপারে সিন্ডিকেটের এই হুকুমদারি। যার জেরে বেশ কিছু সম্পন্ন মানুষ রাজারহাটে বাড়ি করেও সেখানে সংসার পাততে ভয় পাচ্ছেন। কেউ বা সিন্ডিকেটের জুলুম সয়ে বাড়ি বানিয়ে বসবাস শুরু করেও পাট গুটিয়েছেন। কারণ, জুলুমের শেষ হয়নি।

এবং নানা চেহারায় তা প্রকট। সম্প্রতি এক প্রবীণ দম্পতি যা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। ছেলেমেয়ে বিদেশে। অবসরের পরে সারা জীবনের সঞ্চয় ঢেলে মনের মতো করে বাড়ি করেছিলেন, নিশ্চিন্তে থাকবেন বলে। স্বপ্ন ধাক্কা খেল, যখন হঠাৎ এক রাতে দরজায় এসে থামল মোটরবাইকের মিছিল। “সব সিন্ডিকেটের ছেলে। বলল, কার নাকি মায়ের অসুখ, হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। হাজার টাকা সাহায্য চাই।” জানাচ্ছেন বৃদ্ধ। কোনও প্রশ্ন করার সাহস পাননি। টাকা দিয়ে দিয়েছিলেন। তার পরে প্রায় প্রতি সপ্তাহে এক ঘটনা। কখনও কারও অন্ত্যেষ্টি, কখনও কারও বাচ্চার অসুখ, কখনও বা দুঃস্থ মেধাবীর জন্য বই কেনা। নানা অছিলায় টাকা আদায় চলতে থাকে। দু’-এক বার আপত্তি যে করেননি, তা নয়। প্রচ্ছন্ন শাসানি শুনে গুটিয়েও গিয়েছেন।

শেষমেশ ওঁরা রাজারহাট ছেড়ে খাস কলকাতায় ভাড়াবাড়িতে উঠে যেতে বাধ্য হয়েছেন। থানা-পুলিশের পথ মাড়াননি। “একা বুড়ো-বুড়ি থাকি। কোনও ঝামেলায় যেতে চাই না।” বলছেন গৃহকর্ত্রী। ওঁদের মতো বিভিন্ন পরিবারের অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপটে নির্মাণ-শিল্পমহলও অশনি সঙ্কেত দেখছে। তাদের আশঙ্কা, সমস্যার সুরাহা না-হলে সাধারণ মধ্যবিত্ত-উচ্চ মধ্যবিত্তের কাছে রাজারহাটের বাসযোগ্যতা ক্রমশ কমবে। সে ক্ষেত্রে ফ্ল্যাটবাড়ির দাম চড়া হারে না-ও বাড়তে পারে। অর্থাৎ চাহিদা কমতে পারে। তখন চাহিদা ও সরবরাহে ভারসাম্য থাকবে না। মুনাফা কমার ভয়ে মুখ ফেরাবে বড় নির্মাণ সংস্থাগুলি।

যেমন ফিরিয়েছে কেপেল ম্যাগাস। সূত্রের খবর: সিঙ্গাপুরের কোম্পানিটি রাজারহাটে বিলাসবহুল আবাসন নির্মাণে হাত দিয়েছিল। পরে স্থানীয় অংশীদারদের নিজের মালিকানা বিক্রি করে প্রকল্প থেকে বেরিয়ে যায়। বিদেশি সংস্থাটির ব্যাখ্যা ছিল, প্রকল্পের মুনাফাযোগ্যতা তাদের প্রত্যাশা ছুঁতে ব্যর্থ হয়েছে।

এই ‘ব্যর্থতা’র পিছনে সিন্ডিকেটের জবরদস্তিরই বড় ভূমিকা দেখছেন নির্মাণ-শিল্পমহলের একাংশ। তা সমর্থন করেছেন রাজারহাটে আবাসন নির্মাতা একাধিক সংস্থার কর্তারা। ওঁরা জানিয়েছেন, হাউসিং কমপ্লেক্সগুলোয় যত নিরাপত্তারক্ষী ও রক্ষণাবেক্ষণ কর্মী লাগে, তার একটি নির্দিষ্ট শতাংশ সিন্ডিকেট থেকে নিতেই হয়। এটাই নিয়মে দাঁড়িয়েছে, যার অন্যথা হলেই অশান্তি। নির্মাতারাও ঝামেলায় যেতে চান না। কার্যত গুণমানে কিছুটা আপস করেই তাঁরা সিন্ডিকেটের লোক নিয়ে নেন। এক সংস্থার কর্তার স্বীকারোক্তি, “পেশাদার ও নামী সিকিওরিটি এজেন্সির লোকের যে ট্রেনিং থাকে, এদের তা থাকবে কী করে? আমরাই কোনও মতে শিখিয়ে-পড়িয়ে কাজ চালিয়ে নিই।”

আপসের খেসারতও কি দিতে হচ্ছে না?

গত সেপ্টেম্বরে নিউ টাউন বাসস্ট্যান্ডের কাছে এক আবাসনের ফ্ল্যাটে ভরদুপুরে বৃদ্ধাকে বন্দুক দেখিয়ে লুঠপাট চালায় দুষ্কৃতীরা। তখন জানা যায়, এজেন্সির লোককে সরিয়ে ওখানে স্থানীয় রক্ষী মোতায়েন করা হয়েছিল। প্রশ্ন ওঠে, সিন্ডিকেটের চাপেই কি ওই পরিবর্তন? ঘটনার পরে নিউ টাউনের সমস্ত বহুতল ও বিভিন্ন এজেন্সির রক্ষীদের নিয়ে বিধাননগর কমিশনারেট বৈঠক করেছিল। সেখানে কয়েকটি এজেন্সির তরফে পুলিশকে মৌখিক ভাবে অভিযোগ করা হয়, স্থানীয় লোক নিয়োগ না-করলে নানা হুজ্জুতির মুখে পড়তে হচ্ছে। পুলিশকর্তারা তখন পরিষ্কার বলে দিয়েছিলেন, আবাসনে রক্ষী মোতায়েনের ক্ষেত্রে স্থানীয় কোনও ‘চাপ’ বরদাস্ত করা হবে না। এমন কিছু ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে জানাতে হবে।

তার পরে অবশ্য সে রকম অভিযোগ এ পর্যন্ত পুলিশ পায়নি বলে জানিয়েছেন বিধাননগর কমিশনারেটের এডিসিপি সন্তোষ নিম্বলকর। তিনি বলেন,“কেউ অভিযোগ করলে পুলিশ পাঠিয়ে দেখা হবে। কাউকে রেয়াত করা হবে না।” নিউটাউন থানার এক পদস্থ অফিসারের আশ্বাস, “এখন বহু সংস্থা ও বহুতলে বাইরের নিরাপত্তারক্ষীরা কাজ করছেন।

কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। তবু কেউ যদি নাম গোপন রেখেও অভিযোগ করতে চান, আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেব।”

পুলিশ আশ্বাস দিলেও ভুক্তভোগীদের ভরসা ফিরবে কি?

প্রশ্নটা থেকে যাচ্ছে। কারণ, অতীতের অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতা বলছে, ওই তল্লাটে রাজ্যের ‘শো-কেস’ যে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প, তা-ও তোলাবাজির হাত থেকে ছাড় পায়নি। রাজারহাটে ৪৫ একর জুড়ে রয়েছে আইটি শিল্পের বিশেষ আর্থিক অঞ্চল ইউনিটেক ইনফোস্পেস। যেখানে রয়েছে এইচসিএল, টিসিএস, অ্যাকসেনচার, জেনপ্যাক্ট, কগনিজেন্ট, ক্যাপজেমিনি-সহ বেশ কিছু নামজাদা আইটি সংস্থা, সব মিলিয়ে হাজার বিশেক কর্মী। দু’বছর আগে তোলাবাজির ঠেলায় অতিষ্ঠ হয়ে কয়েকটি সংস্থা তথ্যপ্রযুক্তি দফতরে চিঠি দিয়েছিল। হিডকো ও পুলিশকেও লিখিতনালিশ করেছিল। তাতে অফিসে ঢুকে চাকরির দাবি থেকে শুরু করে যাতায়াতের পথে কর্মীদের শাসানি, এমনকী ডেবিট কার্ড কেড়ে জবরদস্তি টাকা তোলানোর মতো ঘটনার উল্লেখও ছিল। কিন্তু অভিযোগ, কাজ বিশেষ কিছু হয়নি। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও রাজারহাট-নিউটাউনে তোলাবাজি ও সিন্ডিকেট-রাজে রাশ দেওয়া যায়নি।

যার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ ওই ব্যবসায়ী। যিনি বলছেন, “কুমিরের সঙ্গে বিবাদ করে জলে বাস করার সাহস আমার নেই। বাড়ি পড়ে থাক। আমি ঢুকছি না।”

সহ প্রতিবেদন: আর্যভট্ট খান

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE