হকারদের স্বার্থরক্ষায় মুখ্যমন্ত্রী ‘কল্পতরু’ হওয়ায় নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য কতটা সুরক্ষিত থাকবে, তা নিয়ে শহরবাসীর পাশাপাশি ঘোর সংশয়ে প্রশাসনও। শুক্রবার মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার ২৪ ঘণ্টা পরেও তাই ওই হকার নীতির পুরোটা বুঝে উঠতে পারেননি সরকারি অফিসারেরা।
ন্যায্য কর দিয়ে নিউ মার্কেট-গড়িয়াহাট-হাতিবাগান কিংবা শহরের অন্যত্র দোকান বসিয়েছেন যে সব ব্যবসায়ী, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হকার নীতি তাঁদের কাছেও একটা বড় ধাঁধা! তাঁদের সংশয়, কার্যত ঢাকা পড়ে যাওয়া দোকানের মুখ তো এর পরে আর গ্রাহকদের চোখেও পড়বে না। সরকারি তরফে এর কোনও জবাব মেলেনি। মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া, “মুখ্যমন্ত্রী আবেদন করেছেন। এর বেশি আমার কিছু বলার নেই!”
প্রবীণ সিপিএম নেতা তথা ‘অপারেশন সানসাইনের’ কাণ্ডারী কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় মনে করেন, এই হকার নীতির মধ্যে ভারসাম্য নেই। হকারদের লাইসেন্স দেওয়ার কথা বলা হলেও নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্যের দিকটি নজরের বাইরেই রাখা হয়েছে। এতে হকাররা বেপরোয়া হবে। কে কোথায় বসবে, কী ভাবে জায়গা চিহ্নিত হবে তা নিয়ে ধন্দ থেকেই যাচ্ছে। আবার রাজ্যের প্রবীণ মন্ত্রী ও শ্রমিক নেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের দাবি, “কলকাতার মতো শহরে হকার সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে পারে মুখ্যমন্ত্রীর এই হকার নীতি। এ জন্য পুলিশকেই মুখ্য ভূমিকা নিতে হবে।”
সরকারি সূত্রের খবর, পাকা দালানের স্থায়ী দোকান ঘিরে থাকা হকারদের কী ভাবে সরানো হবে, তার কোনও রূপরেখাই তৈরি হয়নি। ফলে সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার প্রতিফলন ঠিক কী ভাবে করা যায়, তার উপায় খুঁজে বার করতে কালঘাম ছুটছে রাজ্য প্রশাসনের কর্তাদের।
কেন এই সমস্যা?
নবান্নের একাংশ মনে করে, রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামে যে নীতির কথা ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী, তা বাস্তবায়ন করা কঠিন। তাঁদের যুক্তি, হকারদের নাম নথিভুক্ত করাই এক মাত্র কাজ নয়, তাঁদের যে আর্থিক সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, তা সরকারের কোনও প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত করা যাচ্ছে না। শ্রম দফতরের এক অফিসারের কথায়, অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য কেন্দ্রের একটি প্রকল্প রয়েছে। নাম, স্টেট অ্যাসিস্ট্যান্স স্কিম অন প্রভিডেন্ড ফান্ড ফর আনঅর্গানাইজড ওয়াকার্স (সাসফু)। তাতে বলা আছে, কোনও শ্রমিক মাসে ২৫ টাকা করে জমা দিলে, তাঁর হয়ে সরকার দেবে ৩০ টাকা। ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত ওই ভাবে টাকা জমা হলে তবেই তাঁকে এককালীন আড়াই লক্ষ টাকা দেওয়া যাবে। অথচ মমতা বলেছেন, কোনও হকার সারা জীবনে মাত্র এক বার ৩০ টাকা দিলেই ৬০ বছর বয়সের পরে আড়াই লক্ষ টাকা পাবেন! তা হলে যে হকারের বয়স ৫০ বা ৫৫ বছর, তিনি কি এক বার ৩০ টাকা জমা দিয়ে ৫-১০ বছর পরেই আড়াই লক্ষ টাকা পাবেন? জবাব দিতে দিশেহারা পুরসভা বা নবান্নের অফিসারেরা। তাঁদের বক্তব্য, যে প্রকল্পের অস্তিত্বই নেই, তা কী ভাবে কার্যকর করা হবে?
মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, রাস্তায় কোনও হকার থাকতে পারবেন না। তা হলে, এখন যাঁরা রাস্তায় পসরা সাজান, তাঁদের কি সরিয়ে দেওয়া হবে? সরানো হলে কে সেই দায়িত্ব পালন করবে এবং কবে? তাঁদের পুনর্বাসনের কোনও ব্যবস্থা সরকার করবে কি না, মমতার ঘোষণা থেকে অন্তত তা বোঝা যায়নি। পুরভোটের আগে হকার ‘ভাই-বোনেদের’ সুখবর শোনাতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেছেন, “শুক্রবার (অর্থাৎ ঘোষণার দিন) পর্যন্ত যে সব হকার রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় বসে রয়েছেন, তাঁদের হিসেব ধরে লাইসেন্স দেওয়া হবে।” প্রশ্ন উঠেছে, রাজ্যে কত হকার রয়েছে? এর কোনও সদুত্তর প্রশাসনের তরফে না মিললেও কলকাতা পুলিশের দাবি শহরের ফুটপাথ-রাস্তা আটকে থাকা হকারের সংখ্যা কম করেও ২৫ হাজার। যদিও হকারদের বিভিন্ন ইউনিয়নের দাবি, শুধু কলকাতাতেই হকারের সংখ্যা তিন লক্ষ ছাড়িয়ে। রাজ্য জুড়ে আরও কয়েক লক্ষ। তা হলে কারা লাইসেন্স পাবেন, সেই প্রশ্নও তুলেছেন হকার ইউনিয়নের নেতারা।
হকারদের ‘দৌরাত্ম্যের’ প্রতিবাদে নিউ মার্কেট চত্বরের ৯টি বাজারের ব্যবসায়ীরা তিন দিনের বন্ধ ডেকেছিলেন। ভাল সাড়াও মেলে ওই বন্ধে। তাঁদের দাবি ছিল, স্থায়ী দোকান ঘিরে বসে থাকা হকারদের সরাতে হবে, রাস্তা থেকে হকার তুলতে হবে। বন্ধে সামিল ব্যবসায়ীদের কিন্তু কোনও আশার বাণী শোনায়নি সরকার। মুখ্যমন্ত্রী স্থায়ী দোকান ঘিরে বা তার মুখ আটকে হকারদের বসতে বারণ করেছেন। কিন্তু এই ঘোষণার ২৪ ঘণ্টা পরেও তার কোনও প্রভাব নিউ মার্কেট এলাকায় দেখা যায়নি। এই পরিস্থিতিতে জয়েন্ট ট্রেডার্স ফেডারেশনের সম্পাদক রাজীব সিংহ হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, “দাবি পূরণ না হলে আমরা ফের আন্দোলনে নামব।”
পুরভোটের মুখে মুখ্যমন্ত্রী কেন এই ঘোষণা করলেন, তা নিয়েও চাপান-উতোর শুরু হয়েছে। পুরসভার অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ অফিসারেরা জানিয়েছেন, প্রায় উনিশ বছর আগে ১৯৯৬ সালের ২৪ নভেম্বর রাতে মূলত কলকাতার হাতিবাগান ও গড়িয়াহাট এলাকায় ‘অপারেশন সানসাইন’ চালানো হয়। এর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল শহরের ব্যস্ততম ২১টি রাস্তা থেকে হকার সরিয়ে ফুটপাথকে দখলমুক্ত করা। পাশাপাশি, হকারদেরও অন্যত্র পুনর্বাসন দেওয়া। শুক্রবার মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পর ফুটপাথ আদৌ দখলমুক্ত হয়ে পথচারীর চলাচলের জন্য সুগম হবে কি না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা।
বাম আমলে ‘অপারেশন সানসাইন’-এর অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন প্রয়াত সিপিএম নেতা সুভাষ চক্রবর্তী। সেই অভিযানের অন্যতম কাণ্ডারী ছিলেন কলকাতা পুরসভার তৎকালীন মেয়র পারিষদ (জঞ্জাল অপসারণ) কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়। এ দিন তাঁর বক্তব্য, ফুটপাথ তো বটেই, ফুটপাথ ছাড়িয়ে রাস্তার উপরে যত্রতত্র হকার বসে যাওয়ায় পথচারীদের যাতায়াত বন্ধ হওয়ার জোগাড় হয়েছিল। অনেক ক্ষেত্রে যানবাহনের গতিও শ্লথ হয়ে যাচ্ছিল। বিভিন্ন বাজারে ঢোকা দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছিল। সেই কারণেই ওই অভিযানের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। কান্তিবাবুর অভিযোগ, “ভুল প্রচার চালিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়রা তখন মানুষকে এমনই বিভ্রান্ত করেছিলেন, যে অভিযান বন্ধ করে দিতে হয়!”
রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় এই প্রসঙ্গে বলেন, “কান্তিবাবুরা সে সময় যে জায়গায় হকারদের পুনর্বাসন দেন, সে সব অন্যদের বিক্রি করে দিয়ে বহু হকারই ফের আগের জায়গায় ফিরে এসেছেন।” সুব্রতবাবুর সংযোজন, “আমিও মেয়র থাকাকালীন গড়িয়াহাটের মোড় থেকে হকার সরিয়ে কাছেই একটি বাড়ি তৈরি করে ওঁদের পুনবার্সন দিয়েছিলাম। কিন্তু কিছু দিন পরে দেখলাম, গড়িয়াহাট এলাকা ফের ভরে গিয়েছে।” তাই সুব্রতবাবুর মতে, হকারেরা যে যেখানে রয়েছেন, সেখানে তাঁদের স্থান নির্দিষ্ট করে দেওয়াটাই সুষ্ঠু সমাধান। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষিত হকার নীতির এটাই মূলকথা বলে দাবি তাঁর। তৃণমূলের হকার নেতা প্রমথেশ সেন বলেন, “এত বড় একটা প্রাপ্তির পরেও হকারেরা যদি স্থায়ী দোকানের সামনে থেকে সরে না যায়, বা রাস্তা থেকে না ওঠে, তা হলে আমরাও তাঁদের সহায়তা বন্ধ করব।”
আবার সিটু নেতা অনাদি সাউয়ের দাবি, “২০১৪ সালে কেন্দ্রীয় সরকার হকার আইন তৈরি করে লাইসেন্স দেওয়ার কথা বলে। মুখ্যমন্ত্রী এখন কেন্দ্রীয় আইনকেই নিজের বলে চালাতে চাইছেন।” কিন্তু কেন্দ্রের আইন রাজ্যে কার্যকর করতে হলে বিধানসভায় বিল পাশ করাতে হয়। অনাদিবাবুর প্রশ্ন, “আমরা ডিসেম্বর মাসে তাঁকে ডেপুটেশন দিয়েছিলাম। মুখ্যমন্ত্রী কেন আজও এই বিল আনেননি?” মুখ্যমন্ত্রী হকারদের জন্য যে সামজিক সুরক্ষার কথা ঘোষণা করেছেন, ২০০১ সালে বামফ্রন্ট সরকার তা চালু করেছিল বলে দাবি করে অনাদিবাবু বলেন, “লক্ষাধিক হকার এই আইনের আওতায় সামাজিক সুরক্ষা পাচ্ছেন। কিন্তু তৃণমূল সরকার ওয়েলফেয়ার ফান্ডে ঠিক মতো টাকাই দিচ্ছে না।” পুরকর্তারা জানান, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তৈরি জাতীয় হকার নীতির সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার অনেকটাই মিল রয়েছে। তবে জাতীয় নীতিতে আর্থিক সুবিধার কোনও নিদান নেই। মুখ্যমন্ত্রী তা দেবেন বলে জানিয়েছেন। কিন্তু তা কী ভাবে দেওয়া হবে, তা কেউই জানেন না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy