শোকার্ত: পরিজনেদের সঙ্গে সঞ্জয়ের মা টুম্পা এবং বাবা নীলরতন বনু ।
রোজ সকালে বাড়ি বাড়ি সাইকেল চড়ে খবরের কাগজ দিত ছেলে। সেই সাইকেলেই যে তাঁর মৃত্যু হয়েছে, তা ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পরেও মেনে নিতে পারছেন না চিংড়িঘাটায় মৃত সঞ্জয় বনুর মা। রবিবার কান্নাভেজা গলায় সন্তানহারা মা বলেন, ‘‘এমনটা যেন আর কারও সঙ্গে না হয়। আমার ছেলেটা বাঁচতে চেয়েছিল। রাস্তায় পড়ে গিয়ে হাত দেখিয়ে বাসটাকে থামানোর জন্য বলেছিল। কেউ শুনল না কেন? কেন তার পরেও বাস চালিয়ে দেওয়া হল!’’
শনিবার চিংড়িঘাটা মোড়ে বন্ধুর দাদার বিয়ের মিষ্টি আনার সময়ে বাসের চাকায় পিষ্ট হন সঞ্জয় এবং তাঁর বন্ধু বিশ্বজিৎ ভুঁইয়া।
দু’জনেই চিংড়িঘাটার শান্তিনগরের বাসিন্দা। পাড়ায় তাঁদের পরিচিতি অভিন্নহৃদয় বন্ধু হিসেবে। প্রতিবেশীরা জানাচ্ছেন, ফুটবল মাঠের সহ-খেলোয়াড়ও তাঁরা। তবে ইদানীং পায়ে চোট লাগায় মাঠে নামতে পারছিলেন না বিশ্বজিৎ।
এ দিন তাঁদের এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, ভাড়াবাড়ি ছেড়ে শোকে পাথর সঞ্জয়ের পরিবারকে এনে রাখা হয়েছে কাছেই এক আত্মীয়ের বাড়িতে। সেখানে বসে ছেলের কথা বলছিলেন সঞ্জয়ের মা টুম্পা। পাশে বসা সঞ্জয়ের বাবা নীলরতন জানালেন, ওই দিন সকালে কাগজ দিয়ে ফিরে বন্ধুর দাদার বিয়েতে যাবে বলে বেরিয়েছিলেন ছেলে। দুপুর ১২টা নাগাদ তাঁদের কাছে দুর্ঘটনার খবর আসে। শুনেই ছুটে যান তাঁরা। সঞ্জয়ের মা বলেন, ‘‘বলেছিলাম, বাড়িতে খাবি না নিশ্চই? বলল ফিরে এসে পরোটা খাবে। ফিরলই না। আর কেউ পরোটা খেতেও চাইবে না!’’
আরও পড়ুন: ‘তারিখটা মনে থাকবে কষ্টের সঙ্গে’
বিশ্বজিতের বাবা-মা সুশীল ও পূর্ণিমা ভুঁইয়া। রবিবার।
ছেলের নতুন ঘরে থাকার ইচ্ছাপূরণও আর হল না বলে জানালেন বনু দম্পতি। নীলরতন জানান, চার বছর ধরে তাঁদের বাড়ির কাজ আটকে রয়েছে। প্রোমোটারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, ‘‘ছেলের আর নতুন ঘরে থাকা হল না। প্রোমোটার কাজ শেষ করেনি। আমার দাদারা নিজেদের খরচে কাজ শেষ করে নতুন ঘরে ঢুকে গিয়েছেন। আমরা গরিব, তাই এখনও ঢুকতে পারিনি।’’ নীলরতন জানান, তাঁদের পৈত্রিক বাড়ি ভেঙে একটি বহুতল তৈরির কাজ নিয়েছিলেন প্রোমোটার। কথা ছিল, তিনতলা এবং একতলার ফ্ল্যাট পাবেন সঞ্জয়েরা। প্রোমোটারই তাঁদের ভাড়ার বাড়িতে থাকতে দিয়েছিলেন। ভাড়াও তিনিই দিতেন। তবে গত দু’বছরেরও বেশি, প্রোমোটার আর ভাড়া দেন না। ফলে বাড়ির ভাড়া এবং সংসার চালানোর খরচ জোগাড় করতে লোকের বাড়ি খবরের কাগজ দেওয়া শুরু করেছিলেন অঙ্কের মেধাবী ছাত্র সঞ্জয়। এ দিন ওই প্রোমোটারকে বারবার ফোন করা হলেও তিনি অবশ্য ফোন ধরেননি। এসএমএসেরও উত্তর দেননি।
পাকা ঘরে থাকার ইচ্ছাপূরণ হয়নি বিশ্বজিতেরও। তাঁর পরিজনেরা জানালেন, গত ডিসেম্বরে বিশ্বজিতদের বাড়ি তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। ঠিক ছিল একতলার একটি ফ্ল্যাট পাবেন ওঁরা। নিজের ছবি দিয়ে সাজাবেন ওই ঘর, বাড়িতে বলে রেখেছিলেন বিশ্বজিৎ। তাঁর এক দাদা বললেন, ‘‘ওর বেশ কিছু ভাল ছবি তুলে দিয়েছিলাম। সেগুলোই ঘরে সাজাবে বলে ঠিক করেছিল ও। সে সব আর হবে না।’’
বিশ্বজিতের বাবা সুশীল ভুঁইয়া অবশ্য কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। প্রতিবেশীদের অভিযোগ, পুত্রশোকের মধ্যেই তাঁকে পুলিশ লাঠিপেটা করেছে। লোক দেখলেই কেঁদে উঠছেন তিনি। কান্নাভাঙা গলায় বললেন, ‘‘কিছু বলার নেই। কোথায় গেল? আর ফিরবে না!’’ বিশ্বজিতের মা পূর্ণিমা জানালেন, এক সাইকেলে বেরিয়েছিল দুই বন্ধু। তাঁর কথায়, ‘‘বলেছিলাম, এক সাইকেলে যাচ্ছিস সাবধান। বুঝিনি ওটাই সত্যি হবে। এ বার আর রবিবার এলে কেউ বলবে না, মাংস খাব!’’
ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy