মগ্ন। সোমবার বেহালার একটি প্রচারসভায় মুখ্যমন্ত্রী। ছবি: রণজিৎ নন্দী।
ইঙ্গিত এক মাস আগেই ছিল। পুরভোটের আগে এবিপি আনন্দ-এসি নিয়েলসেনের চূড়ান্ত জনমত সমীক্ষা আরও স্পষ্ট করে আভাস দিল, কলকাতা শহর জুড়ে জোড়াফুল ফোটার সম্ভাবনাই প্রবল। এই এক মাসের মধ্যে শাসক দলের ভোট ও আসন-সংখ্যা, অল্প হলেও দুই-ই বাড়ার ইঙ্গিত মিলেছে। উল্টো দিকে, গত লোকসভা ভোটে শহরে যে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছিল বিজেপি, তা তারা ধরে রাখতে পারবে না বলেই জানাচ্ছে সমীক্ষা। বরং নতুন করে বহরে বাড়ার ইঙ্গিত দিয়েছে বামেরা।
কলকাতার পুরভোটের জন্য আগের যৌথ জনমত সমীক্ষা যখন চালানো হয়েছিল, তখনও কোনও দলের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা হয়নি। পরের দফার সমীক্ষার জন্য কলকাতার ৭২টি ওয়ার্ডে ১৩ হাজার ২৭৫ জন মানুষের সঙ্গে ২৬ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিলের মধ্যে যখন কথা বলেছেন সমীক্ষকেরা, তত দিনে শহরবাসী পুর-প্রার্থীদের নাম জেনে গিয়েছেন। যুযুধান দলগুলির মধ্যে তৃণমূল ও বামেদের নির্বাচনী ইস্তাহারও দেখে নিয়েছেন। তার পরেও সমীক্ষার রায় বলছে, কলকাতার ছোট লাল বাড়ির দখল থাকছে শোভন চট্টোপাধ্যায়ের বাহিনীর হাতেই। তবে তাত্পর্যপূর্ণ ভাবে সোমবার প্রকাশিত সমীক্ষা দেখাচ্ছে, এক মাসের ব্যবধানে বিজেপির ভোট আরও কমতে চলেছে। সমীক্ষায় ইঙ্গিত, তাদের হারানো ৩% ভোটের এক ভাগ যেতে পারে তৃণমূলের দিকে, বাকি দু’ভাগ বামেদের বাক্সে। লোকসভা ভোটের সময় থেকেই এ রাজ্যে বিজেপির শ্রীবৃদ্ধি হচ্ছিল বামেদের ভোট ভাঙিয়ে। পুরভোটে এ বার কিন্তু সেই প্রবণতা থমকে যেতে পারে বলেই ইঙ্গিত মিলেছে। বিজেপি গত বছর লোকসভা নির্বাচনে কলকাতায় পেয়েছিল ২৩.৬% ভোট। তা প্রায় ৮% কমে ১৫%-এ নেমে আসতে পারে বলে দেখিয়েছিল গত মাসের সমীক্ষা। এ বারের সমীক্ষায় সেই ভোট আরও কমে ১২%-এ নামার ইঙ্গিত রয়েছে। সে ক্ষেত্রে বিজেপি জিততে পারে ৬টি ওয়ার্ডে।
এবিপি আনন্দ-এসি নিয়েলসেনের চূড়ান্ত সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, তৃণমূল এক মাস আগেকার সমীক্ষার তুলনায় আরও ১% ভোট বেশি পেয়ে মোট ১০৩টি ওয়ার্ড দখল করতে চলেছে। বামেরাই থাকছে দ্বিতীয় স্থানে। তাদের ভোট এক মাসে আরও ২% বেড়ে হতে পারে ৩০% এবং তারা জিততে পারে ৩১টি ওয়ার্ড। যা পাঁচ বছর আগে বামেদের জেতা ৩২টি ওয়ার্ডের সঙ্গে প্রায় তুল্যমূল্য। গত লোকসভা ভোটে শহরে তারা প্রায় ২৫% ভোট পেয়েছিল। সেই সময় থেকেই বিজেপির হাতে রক্তক্ষরণ বামেদের ধ্বস্ত করে ফেলেছিল। এ বার যদি তারা গেরুয়া বাহিনীকে অনেকটা পিছনে ফেলে ৩০% পৌঁছতে পারে, বিধানসভা ভোটের আগে সেটা তাদের চাঙ্গা করবে বলেই মনে করা হচ্ছে। এ বারের সমীক্ষা অনুযায়ী, আর এক বিরোধী দল কংগ্রেস পেতে পারে ৪টি ওয়ার্ড এবং ৯% ভোট। আর অন্যান্য দল কোনও আসন না পেলেও মিলেজুলে পেতে পারে ৫% ভোট।
এ কথা ঠিকই যে, জনমত সমীক্ষা সব সময় বাস্তবের হুবহু প্রতিফলন হয় না। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে সমীক্ষার ইঙ্গিত ভোটের ফলে মিলে গিয়েছে, এমন উদাহরণই বেশি। সামগ্রিক ভাবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং ভোটারদের ভাবনার আভাস হিসেবে এই ধরনের সমীক্ষার গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। এ বার কলকাতার পুর-প্রচারে ধারে-ভারে তৃণমূলই এগিয়ে। তারা যে ক্ষমতা ধরে রাখতে চলেছে, প্রচার চলাকালীন জনমানসে সাধারণ ধারণা সে রকমই। জনমত সমীক্ষা এক অর্থে সেই ধারণাকেই আরও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হল, শাসক দলের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে যেখানে দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে, সিবিআই তদন্তে দলের নেতা-মন্ত্রীদের জেলে যেতে হচ্ছে, প্রশ্ন উঠেছে নেত্রীর ছবি বিক্রি নিয়ে, সেখানে তাদের ভোট ও আসন বাড়ানোর ইঙ্গিত মিলছে কী ভাবে? রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারদা তদন্তের প্রভাব যে ভোট বাক্সে বড় একটা পড়বে না, তা বোঝা গিয়েছিল দু’মাস আগে বনগাঁ ও কৃষ্ণগঞ্জের উপনির্বাচনেই। তবে এ বার ভোট খোদ কলকাতায়, বাংলার রাজনীতি তো বটেই, সংস্কৃতির পীঠস্থানে। সেখানে কি সারদা থেকে রোজভ্যালি, কোনও বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থা সংক্রান্ত তদন্তের প্রভাব পড়বে না? পোড় খাওয়া রাজনীতিকদের অনেকেই বলছেন, দুর্নীতি তদন্তের প্রভাব যে সব সময় ভোট বাক্সে পড়বেই, তার কোনও মানে নেই। জরুরি অবস্থার পরে ইন্দিরা গাঁধীকে হারিয়ে ক্ষমতায় এসেই ১৯৭৭ সালে জনতা পার্টির সরকার শাহ কমিশন বসিয়েছিল। জরুরি অবস্থার সময় ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রমাণও মিলেছিল সেই কমিশনের রিপোর্টে। কিন্তু তার কোনও প্রভাব পড়েনি ১৯৮০ সালের লোকসভা ভোটে। জনতা পার্টির সরকারকে ভোটে হারিয়ে ফের ক্ষমতা দখল করেছিলেন ইন্দিরা।
এ দিন এবিপি আনন্দ-এসি নিয়েলসেন যে সমীক্ষা চালিয়েছে, তাতেও দেখা যাচ্ছে, শহরের মানুষ দুর্নীতি প্রশ্নে ভোট দেওয়া নিয়ে আড়াআড়ি বিভক্ত। সারদা বা রোজভ্যালির মতো কেলেঙ্কারি ভোট দেওয়ার সময় তাঁদের সিদ্ধান্তে কি প্রভাব ফেলবে— এই প্রশ্নের জবাবে ৪৫% যেমন ‘হ্যাঁ’ বলেছেন, তেমনই উল্টো দিকে ‘না’ বলেছেন ৪৫% মানুষ। ভোট দেওয়ার সময় তাঁরা কোন কোন বিষয়ের উপরে বেশি জোর দেবেন— এই প্রশ্নের জবাবে মানুষ পানীয় জল, পরিচ্ছন্নতা, নিকাশি ও বৃষ্টিতে জল দাঁড়িয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। কেউ সারদা কেলেঙ্কারি বা নেত্রীর ছবি বিক্রি সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগগুলি সামনে আনেননি।
রাজনীতিকদের একাংশ এ-ও বলছেন যে, প্রচারের ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত বিজেপি শুধু নিজের যাত্রাভঙ্গই করেনি, উল্টে সুবিধা করে দিয়েছে শাসক দলের। যেমন, দুর্নীতির মতো প্রচারের মূল বিষয়গুলি নিয়ে বলার বদলে সিদ্ধার্থনাথ সিংহের মতো নেতারা বেশি করে তুলে আনতে চেয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর ভাইপো অভিষেকের ‘ভুয়ো ডিগ্রি’র প্রসঙ্গ। এর ফলে জোর হারিয়েছে তাঁদের প্রচার। উপরন্তু, পুরভোটের প্রার্থী বাছাই নিয়ে বিজেপির নিজেদের মধ্যে মারামারি, লাঠিচালনার ঘটনা জনমানসেও তাদের ভাবমূর্তির ক্ষতি করছে।
অথচ দুর্নীতি প্রসঙ্গে তৃণমূল নেতৃত্ব কতটা চাপে রয়েছেন, সেটা বোঝা গিয়েছে খোদ মমতার বক্তৃতাতেই। গত কয়েক দিনে তিনি দু’বার নিজের ছবি বিক্রির প্রসঙ্গ তুলে বিরোধীদের জবাব দিতে চেয়েছেন, আর তাতে টাকার অঙ্কে বিস্তর তফাত দেখা গিয়েছে। শুক্রবার তিনি বলেছিলেন ২ কোটি টাকায় বিক্রি হয়েছে তাঁর ছবি। দু’দিনের মধ্যে তা পাল্টে হিসেব দেন, ছবি বেচে পেয়েছেন ৯ কোটি টাকা!
সোমবার অবশ্য এই নিয়ে আর মুখ খোলেননি মমতা। বরং সিবিআইকে বিজেপি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে ব্যবহার করছে— এই অভিযোগ তুলে সরব হয়েছেন। হঠাৎ ছবি বিক্রি নিয়ে কেন চুপ করে গেলেন মমতা? দলের এক শীর্ষ নেতার ব্যাখ্যা, ‘‘আমরা নিজেদের স্বচ্ছ বলে জাহির করছি, আর আমরাই ছবি বিক্রির বিষয়ে রক্ষণাত্মক হতে গিয়ে বিভিন্ন হিসেব দিচ্ছি— এ দু’টো কি মেলে? এর ফলে মানুষের কাছেও ভুল বার্তা যাচ্ছে।’’
স্থানীয় বিষয়ভিত্তিক পুরভোটে কংগ্রেসের অবস্থা আরও শোচনীয়। আর খাতায়-কলমে প্রধান বিরোধী বামেরা ক্ষমতা হারানোর পরে এখনও সংগঠন গুছিয়ে উঠতে পারেনি। যদিও গত এক মাসে তারা খানিকটা আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিয়ে পথে নামার চেষ্টা করছে। বাম নেতৃত্বের মতে, জনমত সমীক্ষায় তাঁদের সামান্য হলেও যে জমি ফিরে পাওয়ার ইঙ্গিত আছে, তা এই সক্রিয় ভূমিকার জন্যই। এবং এই সক্রিয় ভূমিকার জন্যই পুরভোটের মুখে বামেদের সঙ্গে তৃণমূলের সংঘাত বাড়ছে।
নিজেদের সম্ভাব্য সাফল্যের পরিপ্রেক্ষিত ব্যাখ্যা করে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও বলছেন, ‘‘উন্নয়নের কথা বলছি আমরা। পুরভোটে মানুষ জানতে চান, একটা দল ক্ষমতা পেলে কী করবে? কিন্তু আমাদের বিরোধীরা সন্ত্রাস আর দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে বাজার গরম করতেই ব্যস্ত!’’ পার্থবাবুরা অবশ্য আশা করছেন, এই সমীক্ষার আভাসের চেয়েও বেশি আসন তাঁরা ঘরে তুলতে পারবেন। একই সঙ্গে পার্থবাবুর আরও বিশ্বাস, ‘‘পুরভোটে সামান্য হলেও বিজেপির চেয়ে বামেরা বেশি ভোট পাবে। আমাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী তারাই।’’
কী বলছেন বিরোধীরা? সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিমের বক্তব্য, ‘‘দ্বিতীয় সমীক্ষা যখন হয়েছে, তার পরেও কলকাতায় ভোটের দু’সপ্তাহ বাকি। এর মধ্যে বিজেপির হাওয়া আরও কমবে। তৃণমূলও ধাক্কা খাবে। কারণ, শাসক দলের আয়-ব্যয়ের হিসেব নিয়ে কেলেঙ্কারি, অডিটে গোলমাল, ভুয়ো সংস্থার অনুদান— এ সব এখন আর শুধু আমাদের অভিযোগ নয়। তদন্তে এগুলো উঠে আসছে, মানুষ দেখছেন।’’ তবে পার্থবাবুর যুক্তি খণ্ডন করে সেলিম বলছেন, উন্নয়নের বদলে টাকা নয়ছয়ে কী ভাবে জড়িয়ে পড়েছে তৃণমূল, সে কথাই তাঁরা প্রচারে বলছেন। আর তাতে অস্বস্তি বাড়ছে বলেই শাসক দলের। সন্ত্রাসও বাড়ছে।
রাজ্য বিজেপির অন্যতম সাধারণ সম্পাদক এবং বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য তাঁর এক মাসের আগের মতেই অনড় আছেন। এ বারও তাঁর বক্তব্য, ‘‘এই সমীক্ষার কোনও প্রতিফলন বাস্তবে ঘটবে না। লোকসভার চেয়ে পুরভোটে তৃণমূলের ফল খারাপ হতে বাধ্য। আর বিজেপি-র ফলও হবে চমকে দেওয়ার মতো। মানুষই তা করে দেখাবেন!’’ মানুষ নির্বিঘ্নে সর্বত্র ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবেন কি না, তা নিয়ে অবশ্য ঘোর সংশয়ে সেলিম-শমীকেরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy