Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
Corona Vaccine

বিকেল থেকে লাইন দিয়ে প্রতিষেধক পরের সকালে

কৈলাস বসু স্ট্রিটের আদি মহাকালী পাঠশালায় শিক্ষকতা করি। মাকে ওয়ার্ড অফিসে ঢুকিয়ে নিশ্চিন্তে সম্পাদ্য আর উপপাদ্যের সমাধানে ডুব দিয়েছিলাম।

প্রতীক্ষা: (বাঁ দিকে) প্রতিষেধকের দ্বিতীয় ডোজ় নিতে সোমবার রাত থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে বয়স্কেরা। (ডান দিকে) সকালে ওয়ার্ড অফিস খোলার পরে ভিতরে এসে বসতে পেরেছেন অপেক্ষারত প্রবীণেরা। মঙ্গলবার, গড়িয়ার ১১০ নম্বর ওয়ার্ড অফিসের সামনে। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

প্রতীক্ষা: (বাঁ দিকে) প্রতিষেধকের দ্বিতীয় ডোজ় নিতে সোমবার রাত থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে বয়স্কেরা। (ডান দিকে) সকালে ওয়ার্ড অফিস খোলার পরে ভিতরে এসে বসতে পেরেছেন অপেক্ষারত প্রবীণেরা। মঙ্গলবার, গড়িয়ার ১১০ নম্বর ওয়ার্ড অফিসের সামনে। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

বিনীতা দেবনাথ (শিক্ষিকা)
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ মে ২০২১ ০৫:৩১
Share: Save:

গাছের নীচে বসে ক্লাসও নিয়ে নিলাম! তা-ও জীবনে প্রথম বার। কংক্রিটের জঙ্গলে বসে বৈশাখী দুপুরে দশম শ্রেণির পড়ুয়াদের অনলাইনে জ্যামিতি বোঝাতে বোঝাতে সে কথাই ওদের বলছিলাম, আর হাসছিলাম। এই অভিজ্ঞতার পিছনে কৃতিত্বের দাবিদার অবশ্যই প্রতিষেধক প্রতিযোগিতা। কৈলাস বসু স্ট্রিটের আদি মহাকালী পাঠশালায় শিক্ষকতা করি। মাকে ওয়ার্ড অফিসে ঢুকিয়ে নিশ্চিন্তে সম্পাদ্য আর উপপাদ্যের সমাধানে ডুব দিয়েছিলাম। নিশ্চিন্ত, কারণ প্রাপক তালিকার দু’নম্বরে নাম থাকায় মা যে এ যাত্রায় প্রতিষেধক পাবেনই, তা জানতাম।

এই নিশ্চিন্ত হতে গত আট দিনে চার বার চক্কর কেটেছি। চক্কর বললেও তা কম বলা হবে। বলা ভাল, ঘানিতে তেল পেষাইয়ের মতো নিজেকে নিংড়ে নিয়েছি। না-হলে মঙ্গলবারেও আমার মা, বছর পঁয়ষট্টির রেবা দেবনাথ প্রতিষেধকের দ্বিতীয় ডোজ় পেতেন না। কলকাতা পুরসভার ১১০ নম্বর ওয়ার্ডে গড়িয়ার সবুজ দল পার্কের কাছে আমাদের বাড়ি। মা আর আমার মেয়েকে নিয়ে তিন জনে থাকি। ভাই কর্মসূত্রে রাঁচীর বাসিন্দা।

তাই দ্বিতীয় ডোজ়ের জন্য আমি গত সপ্তাহের মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৬টায় ওয়ার্ড অফিসে লাইন দিতে যাই। ওয়ার্ড অফিস খুলতেই সে দিন জানিয়ে দেওয়া হয়, শুধুমাত্র ৩৫ জনকেই দেওয়া হবে। অগত্যা ৫৫ নম্বরে দাঁড়িয়ে থেকেও ফিরে আসতে হল। দ্বিতীয় দিনে একই সময়ে গিয়েও দাঁড়ালাম ৮৪ নম্বরে। তৃতীয় দিন, সোমবার রাত ৩টেয় উঠে গেলাম। আশ্চর্য! সে দিনও ৮৫ নম্বর! যদিও তখন সামনে দাঁড়িয়ে গুটিকয়েক মানুষ। প্রশ্ন করলাম, ৮৪ জন কোথায়? এখানে তো আপনারা কয়েক জন। উত্তর এল, ‘ওই গলিতে, ওই বাড়ির দোতলায়, ওই ফ্ল্যাটের পাঁচতলায়...।’ সে দিনও ওয়ার্ড অফিস খুলতেই ফিরিয়ে দেওয়া হল আমার মতো অনেককে। যাঁদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন লাঠি ধরে আসা বয়স্ক মানুষ।

সে দিন আমার জেদ চেপে গেল। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে যেমনটা হয় আর কী। হাতে আর মাত্র এক দিন, মঙ্গলবার। না পারলে বাতিল হবে মায়ের দ্বিতীয় ডোজ়। ঠিক করলাম,

আমরাও জোট বাঁধব। ১৫ জনকে পেলাম। সোমবার বিকেল ৪টে থেকে লাইন দেব মঙ্গলবারের জন্য। সবাই মিলে নয়। তিন-চার জন একসঙ্গে পালা করে থাকব। আমি ছিলাম ৪টে থেকে রাত ৯টা, রাত ১০টা থেকে ১২টা এবং ভোর ৪টে থেকে পুরো শেষ পর্যন্ত। মাকে শেষ মুহূর্তে নিয়ে এলাম। এ দিন ৭০ জনকে দেওয়া হয়েছে দ্বিতীয় ডোজ়। আমি নিজে নাম লিখে দিয়েছি সকাল ৮টায় আসা বয়স্ক মানুষদের। তাঁরাও পেয়েছেন। তার মানে সোজা পথে চললে আমার মায়েরও আগেই প্রতিষেধক পেয়ে যাওয়া উচিত ছিল।

এই চার দিনের অভিজ্ঞতায় ভয় হল একটা জিনিস দেখে। করোনার উপসর্গ নিয়ে আসা রোগীরা যেখানে কোভিড পরীক্ষা করাচ্ছেন, সেখানে পৌঁছতে প্রতিষেধকের লাইন পেরোতে হচ্ছে। ফলে বয়স্ক, অশীতিপর এবং কোমর্বিডিটি থাকা বহু মানুষ সেই চরম ঝুঁকির মুখোমুখি হচ্ছেন। অন্য কোথাও কী হয় জানি না, কিন্তু আমার ওয়ার্ডের এই ছবি দেখে সত্যিই সকলে ভীত।

আরও একটা জিনিস উপলব্ধি করলাম। প্রতিষেধক নিয়ে এই হেনস্থা হত না, যদি পুর

কর্তৃপক্ষ সচেতন হতেন। অন্তত ওয়ার্ডের অলিগলিতে পৌঁছে পরদিন প্রতিষেধক নেওয়ার সম্ভাব্য নাম লিখিয়ে আসার সময় প্রচার করা হোক। নাম লেখানোর কাজ কয়েক দফায় হলে অযথা ভিড় হয় না। সেই নামের তালিকা ঝুলিয়ে দেওয়া হোক ওয়ার্ড অফিসের সামনে। তাতে অন্তত এই পরিস্থিতি হবে না। মায়ের জন্য আমি ছিলাম। কিন্তু বহু বয়স্ক আছেন, যাঁদের পাশে কেউ নেই। সেই সব বয়স্ক, অসুস্থ মানুষের কথা কি পুরসভা মানবিকতার সঙ্গে ভাববে না?

অন্য বিষয়গুলি:

Corona Vaccine
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy