বেআইনি নির্মাণ এবং অসাধু প্রোমোটার রাজ রোখার জন্য দলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একাধিক বার বার্তা দিয়েছেন দলীয় মহলে। তা উদ্বুদ্ধ করেছিল দলেরই কিছু নেতা এবং কাউন্সিলরকে। যার ফল, কলকাতায় বেআইনি নির্মাণ নিয়ে ক্ষোভ বাড়ছে তৃণমূলেরই কিছু কাউন্সিলর এবং নেতাদের। ক্ষোভের সেই আঁচ পৌঁছচ্ছে নবান্নেও। যেমন, দক্ষিণ কলকাতার ১০৮ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর শ্যামল বন্দ্যোপাধ্যায় বেআইনি নির্মাণের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। তা পাঠিয়েছেন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের কাছেও।
শুধু শ্যামলবাবু নন, পূর্ব ও দক্ষিণ কলকাতার জনা আটেক তৃণমূল কাউন্সিলর এবং কয়েকজন নেতা বেআইনি নির্মাণের বিপক্ষে অভিযোগ জানিয়েছেন মেয়রের অফিসে। ওই অফিস সূত্রে খবর, গত কয়েক মাসে শ’খানেক বেআইনি নির্মাণ নিয়ে লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে।
কী ধরনের অভিযোগ? ১০৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শ্যামল বন্দ্যোপাধ্যায়ের লিখিত অভিযোগে উঠে এসেছে, শুধু বেআইনি নির্মাণ নয়, তা আবার গড়ে উঠেছে জলাশয় বুজিয়ে। যা আরও এক অবৈধ কাজ। মুখ্যমন্ত্রীকে লেখা ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, বাইপাসের ধারে মাদুরদহ মৌজার জে এল নম্বর ১২ ঠিকানায় এক বিদ্যাপীঠের কাছে জলাভূমি ভরাট করে বেআইনি নির্মাণ চলছে। বিষয়টি যে স্থানীয় আনন্দপুর থানার পুলিশকে জানানো হয়েছে, তারও উল্লেখ রয়েছে চিঠিতে। সঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দাদের স্বাক্ষর করা পিটিশনও দাখিল করার কথা বলা হয়েছে। চিঠির শেষ ছত্রে সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের সুবিধার কথা ভেবে এ বিষয়ে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে বলা হয়েছে, যে জলাভূমি বুজিয়ে নির্মাণকাজ করা হচ্ছে তা ফের আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়া হোক।
কিন্তু এখনও তা হয়নি বলে পুরসভা সূত্রে খবর।
এ দিকে, কসবা-নিউ বালিগঞ্জেও বেআইনি নির্মাণ নিয়ে ক্ষুব্ধ তৃণমূলের একাধিক নেতা। বেশ কয়েক বার অভিযোগ জমা পড়েছে পুরসভার বিল্ডিং দফতরে। তবে কিছুই হচ্ছে না বলে জানান তাঁরা। অভিযোগ, বেআইনি নির্মাণের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছে পুরসভার ১০৮ নম্বর ওয়ার্ড। সেখানকার বিধায়কের ঘনিষ্ঠ একাধিক কাউন্সিলরই ওই কাজে মদত দিচ্ছেন বলে অভিযোগ।
মধ্য কলকাতার ৪৬ নম্বর ওয়ার্ডে বেআইনি নির্মাণের অভিযোগ উঠেছে প্রায় এক ডজন ক্ষেত্রে। এখানে আবার অভিযোগকারী তৃণমূলের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা। ওই ওয়ার্ডের গ্রান্ট স্ট্রিট, ওয়েস্টন স্ট্রিট, নীলমণি হালদার লেন, বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট, ক্রুকেড লেন, লেনিন সরণি এবং ম্যাডান স্ট্রিট-সহ একাধিক স্থানে বাড়ছে বেআইনি নির্মাণের সংখ্যা। এলাকার এক তৃণমূল কংগ্রেস পদাধিকারীর অভিযোগ, ‘‘গোটা ১৩ বাড়িতে বেআইনি নির্মাণ চলছে প্রকাশ্যেই। পুলিশের কাছে অভিযোগও জানানো হয়েছে।’’ তিনি জানান, সব মিলিয়ে প্রায় ৪২ হাজার বর্গফুট বেআইনি নির্মাণ হয়েছে। হাজার টাকা বর্গফুট হিসেবে টাকা ‘ধরিয়ে’ ওই সব বেআইনি কারবারিরা খালাস পেয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ ওই তৃণমূল নেতার।
দক্ষিণ কলকাতার তিলজলা, তপসিয়া-সহ মেটিয়াবুরুজ, খিদিরপুর, গার্ডেনরিচ এবং বন্দর এলাকা বেআইনি নির্মাণের ‘মুক্তাঞ্চল’ বাম আমল থেকেই। সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে। পুরসভার এক পদস্থ কর্তা জানান, দক্ষিণ কলকাতা সংসদ এলাকার বিধায়ক তথা রাজ্যের এক মন্ত্রী বেআইনি নির্মাণ বন্ধ করা নিয়ে পুরসভাকে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধও জানিয়েছেন। তাতেও কিছু বন্ধ হয়নি। পুরসভার হিসেব বলছে, ওই এলাকাগুলিতে বেআইনি নির্মাণ সবচেয়ে বেশি। জরিমানা দিয়ে তা বৈধ করার আইন গত বছরই চালু করেছে পুরসভা। তবে তা একেবারেই প্রয়োগ হয়নি ওই সব এলাকায়। পুর নথি বলছে, জরিমানা দিয়ে বেআইনি নির্মাণ বৈধ করার ভাঁড়ারে ওই সব এলাকা থেকে টাকা জমার ঘর ‘শূন্য’।
এ দিকে, বেলেঘাটা, ট্যাংরা, ফুলবাগান এলাকাতেও বেশ কয়েকটি বেআইনি নির্মাণের অভিযোগ জমা পড়েছে পুরসভায়। এক তৃণমূল কাউন্সিলরের কথায়, ২০টির বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে পুরসভায়। বেশিরভাগই স্থানীয় বাসিন্দাদের।’’ নিজেও একাধিক লিখিত অভিযোগ পুর-প্রশাসনের কাছে পাঠিয়েছেন বলে জানান তিনি। যদিও অভিযোগ দিয়েও কাজ হয়নি বলে তাঁর দাবি।
৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে শিলিগুড়ি ভবনের কাছে বেলেঘাটা মেন রোডেও পুকুর ভরাট করে বেআইনি নির্মাণের লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে বেলেঘাটা থানায়। পুজোর আগেই। সেই খবর দেওয়া হয়েছে পুরকর্তাদের কানেও। তবু কারও ভ্রূক্ষেপ নেই বলে অভিযোগ স্থানীয় একাধিক বাসিন্দার।
সত্যিই কি অভিযোগে কাজ হয়? কী বলছেন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়?
তাঁর কথায়, ‘‘এটা ঠিক যে বেআইনি নির্মাণ নিয়ে আমার দফতরে লিখিত অভিযোগ জমা পড়ে। তবে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়।’’ তিনি জানান, এমনও দেখা গিয়েছে বেআইনি নির্মাণের শুরুতে কোনও কাউন্সিলর বা নেতা অভিযোগ জানিয়েছেন। তার প্রেক্ষিতে পুর-প্রশাসন আইনি প্রক্রিয়াও শুরু করে দেয়। পরে দেখা যায় তাঁদেরই কেউ কেউ আবার ওই বেআইনি নির্মাণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার জন্য তদ্বির করে থাকেন। ততক্ষণে অবশ্য পুরসভার কিছু করণীয় থাকে না।
কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়?
মেয়র জানালেন, অভিযোগের সত্যতা থাকলে বিল্ডিং দফতর সংশ্লিষ্ট প্রোমোটার, বা বাড়ির মালিককে শুনানির জন্য ডেকে পাঠায়। যদি সঠিক জবাব না মেলে, তা হলে বেআইনি অংশ ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়। আর উপযুক্ত কারণ থাকলে জরিমানা (রিটেনশন ফি) নিয়ে তা আইনি করা হয়। তবে মাদুরদহের ঘটনা প্রসঙ্গে মেয়র বলেন, ‘‘ওই এলাকার এ সব সমস্যা রয়েছে। খুব শীঘ্রই ওই এলাকা নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ করা হবে।’’
পুরসভার এক আমলার কথায়, জরিমানা দেওয়ার প্রবণতা সাধারণের ক্ষেত্রে বেশি। যাঁরা ক্ষমতাবান, তাঁরা পুরসভার ‘বিশেষ’ কারও কারও ‘হাত ভরে’ দিয়ে অবাধে বেআইনি নির্মাণ চালিয়ে যাচ্ছেন। এ সব ক্ষেত্রে একাধিক নেতা ও কাউন্সিলরের নামও উঠে এসেছে বেআইনি নির্মাণের কারবারিতে। উত্তর থেকে দক্ষিণ কলকাতার অন্তত গোটা পঁচিশেক ওয়ার্ডে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy