থমকে যাওয়া জীবনকে ছন্দে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সংকেত দিল মেট্রোর চাকার আওয়াজ। নিজস্ব চিত্র।
২১ মার্চ থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর। ১৭৭ দিনের মাথায় ফের চাকা গড়াল কলকাতা মেট্রোর। প্রায় ছ’মাস পরে চেনা মেট্রোর কামরায় উঠে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন অনেক অফিস যাত্রী। তাঁদের অনেকের কাছেই কোভিডে থমকে যাওয়া জীবনকে ছন্দে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সংকেত দিল মেট্রোর চাকার আওয়াজ।
সোমবারের চূড়ান্ত পরীক্ষার আগে রবিবারই সর্বভারতীয় মেডিক্যাল প্রবেশিকা পরীক্ষার (নিট) পরীক্ষার্থী এবং তাঁদের সঙ্গী অভিভাবকদের নিয়ে ‘সেমিফাইনাল পর্ব’ মসৃণ ভাবেই উতরে দিয়েছিলেন মেট্রো কর্তৃপক্ষ। আগেই ঘোষণা করা হয়েছিল, স্টেশনে ঢোকার জন্য আগে থেকে যাত্রীদের নিতে হবে ই-পাস। সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত পরিষেবা চালু থাকবে। এই ১২ ঘণ্টাকে ভাগ করা হয়েছে ১ ঘণ্টার ১২টি স্লটে। সেই স্লট বুক করে আগে যাত্রীদের ই-পাস জোগাড় করতে হবে বলে জানিয়েছিলেন মেট্রো কর্তৃপক্ষ।
রবিবার রাত ৮টায়, প্রথম মেট্রো পরিষেবার ঠিক ১২ ঘণ্টা আগে রাজ্য সরকারের পরিবহণ বিভাগের ‘পথদিশা’ অ্যাপে চালু করা হয় ই-পাস বুকিং। প্রথমে প্রায় ৪৫ মিনিট সেই অ্যাপে পাস বুক করতে ব্যর্থ হন অনেকেই। তবে তারপর থেকে মসৃণ ভাবেই কাজ করেছে অ্যাপ। বোঝার সুবিধার জন্য ১২টি স্লটের ই-পাস করা হয়েছে আলাদা আলাদা রঙের।
সেই পাস মোবাইলে নিয়ে সোমবার সকাল ৭টার আগে থেকেই দমদম মেট্রো স্টেশনে দেখা গেল অফিস যাত্রীদের লাইন।
দূর্বাদল চক্রবর্তীর বাড়ি দমদম এলাকাতেই। রাতেই বেশ কসরত করে সকাল ৮-৯টার স্লটে নাম সংরক্ষণ করে ই-পাস জোগাড় করেছেন। সকালে বেশ তাড়াতাড়িই পৌঁছে গিয়েছেন দমদম মেট্রো স্টেশনে। অনেক দিন পর ফের গোটা স্টেশন চত্বরে ব্যস্ততা। যাত্রীরা পৌঁছনোর আগেই চলে এসেছিলেন মেট্রো কর্মী, স্থানীয় থানার পুলিশ এবং রেলওয়ে প্রোটেকশন ফোর্স (আরপিএফ)-এর জওয়ানরা। মেট্রো আধিকারিকরা তাঁদের প্রথমে একদফা বুঝিয়ে দেন, কী ভাবে যাত্রীদের পরীক্ষা করতে হবে। কোন স্লটের জন্য কী রঙের পাস। এর পর একে একে যাত্রীদের ই-পাস পরীক্ষা শুরু হয়। সকালে দমদম থেকে সকাল ৮-৯টার স্লটের ই-পাসের রং যেমন ছিল উজ্জ্বল হলুদ। মোবাইলে সেই পাস দেখানোর পর পুলিশকর্মীরা যাত্রীদের দেহের তাপমাত্রা মেপে তবেই স্টেশন চত্বরে ঢুকতে দেন।
ই-পাস দেখছেন নিরাপত্তাকর্মীরা। নিজস্ব চিত্র।
এর পর অবশ্য পুরনো নিয়মেই স্মার্ট গেটে স্মার্ট কার্ড ঠেকিয়ে প্ল্যাটফর্মে পৌঁছনো। তবে তার আগে বাধ্যতামূলক দেওয়ালে লাগানো পেল্লায় জীবাণুনাশক তরলে (স্যানিটাইজার) নিজের হাত ধুয়ে নেওয়া। তবে তার আগে অনেককেই দেখা গেল নিজের স্মার্ট কার্ড এখনও সচল আছে কি না, তা নিয়ে সংশয়ী হতে। মেট্রোর নিয়মিত যাত্রী গৌতম মন্ডল। ডাক বিভাগে কাজ করেন। যাবেন যতীন দাস পার্ক। রবিবার রাতেই অনলাইনে স্মার্ট কার্ডে রিচার্জ করেছিলেন। কিন্তু সেই রিচার্জ আদৌ হয়েছে কি না তা বুঝতে পারছেন না। সরাসরি মেট্রো কর্মীদের প্রশ্ন করছেন তিনি। কর্মীরা দেখিয়ে দিয়েছেন স্টেশনে কার্ডের ব্যালান্স জানার মেশিন।
কিন্তু সেখানেই আপত্তি গৌতমবাবুদের। অরিন্দম খাস্তগীর নামে এক যাত্রী যেমন প্রশ্ন তুললেন,‘‘কেন মোবাইল রিচার্জের মতো আমার মোবাইলেই ব্যালান্স দেখা যাবে না। আমি কেন ওই মেশিন ব্যবহার করব যেটা সবাই ব্যবহার করছে?” অনেকের ক্ষেত্রেই দেখা গেল, ব্যাঙ্ক টাকা কেটে নিয়েছে। কিন্তু স্মার্ট কার্ডে পর্যাপ্ত ব্যালান্স দেখা যাচ্ছে না। স্টেশন ম্যানেজার অবশ্য ওই যাত্রীদের শান্ত করে বললেন, ‘‘কোথাও অনলাইন প্রক্রিয়ায় গণ্ডগোল হয়েছে।’’ স্মার্ট কার্ড রিচার্জ সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের জন্য যাত্রীদের দেওয়া হল ০৩৩-২২২৬-৪৮১৭ নম্বর। অনেকেরই এখনও ই-পাসের বিষয়টি পুরো বোধগম্য হয়নি। দমদমের বাসিন্দা সীমা ভট্টাচার্য যেমন জানেন, স্মার্ট কার্ড থাকলেই মেট্রো চড়া যাবে! মেট্রো কর্মীদের বেশ কসরত করে মধ্যবয়সী সীমাকে বোঝাতে হল ই-পাসের বিষয়টি। যদিও স্টেশনের বাইরে ই-পাস এবং অনলাইনে স্মার্ট কার্ড রিচার্জ করার পদ্ধতি জানিয়ে পোস্টার সাঁটা আছে। তবে নতুন পদ্ধতিতে অনেকেরই সড়গড় হতে একটু সময় লাগবে বলে মনে হল।
এ সব টুকরো অসুবিধা, অনুযোগের মধ্যেই কাঁটায় কাঁটায় সকাল ৭টা ৫৬ মিনিটে প্ল্যাটফর্মে হাজির হল কলকাতার ‘লাইফ লাইন’ মেট্রো। প্রসঙ্গত, মূল রুটের পাশাপাশি এ দিন চালু হয়েছে ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রো পরিষেবাও। তবে সেখানে ভিড় এমনিতেই কম। তাই সেখানে ই-পাসের বালাই নেই।
দমদম থেকে ৪ মিনিট পর সকাল ৮টায় চাকা গড়াল প্রথম মেট্রোর।
কামরায় উঠেই নাকে এল স্যানিটাইজারের ঝাঁঝালো গন্ধ। বোঝা যাচ্ছিল আগেই সমস্ত কামরা জীবাণুমুক্ত করা হয়েছে। সামাজিক দূরত্ববিধি মাথায় রেখে একজন অন্তর একজনের বসার ব্যবস্থা। সাতজনের সিটে বসতে পারবেন চারজন। সিটের মাঝে মাঝে ‘ক্রস’ চিহ্ন দিয়ে নির্দিষ্ট করা হয়েছে কোথায় যাত্রী বসা নিষেধ।
দমদম ছাড়িয়ে পর পর বেলগাছিয়া, শ্যামবাজার, শোভাবাজার স্টেশন। প্রথম মেট্রোয় হাতে গোনা যাত্রীদের ওঠানামা। তার মধ্যেই গিরিশ পার্ক থেকে উঠলেন বেসরকারি সংস্থার কর্মী রুনা। যাবেন পার্ক স্ট্রিট। আসনে বসার পরেই তাঁর চোখেমুখে স্বস্তির ছাপ। নিজেই বললেন,‘‘ অনেকটা ইজি লাগছে। ফের চেনা যাতাযাতের পথ। মনে হচ্ছে আবার জীবনটা আগের মতো হচ্ছে।” একই রকম স্বস্তির হাসি পুলিশকর্মী সান্ত্বনার গলাতেও। এতদিন বাসে করেই যাতায়াত করতে হচ্ছিল। বাড়িতে চার বছরের শিশুকন্যা। ফলে বাসে সামাজিক দূরত্বের অবকাশ না থাকায় তিনি কন্যাকে নিয়ে উদ্বেগে ছিলেন। মেট্রোর কঠোর নিয়মে কামরায় পর্যাপ্ত দূরত্ব স্বস্তি জুগিয়েছে তাঁকে। সান্ত্বনার কথায়,‘‘ একে তো ভিড় বাসে জ্যাম ঠেলে যাতায়াত থেকে রেহাই পাব। তারপর এই ব্যবস্থা থাকলে এ যাত্রায় হয়তো কোভিড থেকেও বাঁচব!”
সামাজিক দূরত্ব মেনেই বসানো হচ্ছে মেট্রোতে। নিজস্ব চিত্র।
এ দিন মেট্রোর অনেক আধিকারিকই উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন বড় স্টেশনে। তাঁদের মধ্যে একজন বললেন, ‘‘রবিবার রাতে প্রায় ৬ হাজার ই-পাস ইস্যু করা হয়েছে।’’ তাঁদের দাবি, অনেকদিন পর মেট্রো চালু হল। ফলে সকলে নয়া ব্যবস্থায় সড়গড় হননি। তাই প্রথমদিন ভিড় কম। ক’দিন গেলেই যাত্রী বাড়বে। তবে আপাতত অতিরিক্ত ভিড় এড়াতে যে এই ব্যবস্থাই চালু থাকবে, সেটিও তাঁরা জানিয়ে দিয়েছেন। ভিড় বাড়লে এই ব্যবস্থা কি এ দিনের মতো মসৃণ ভাবে চালানো সম্ভব হবে? সংশয় আছে। তবে এক মেট্রো কর্তা বললেন,‘‘ পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যবস্থা করতে হবে।’’
কবি সুভাষ গামী প্রথম মেট্রো ততক্ষণে সেন্ট্রাল স্টেশন ছাড়িয়েছে। কামরার ভিতরে ঘোষণা— পরবর্তী স্টেশন চাঁদনি চক। আশপাশের যাত্রীদের অনেকের চোখ হাতের মোবাইলের স্ক্রিনে। চেনা ছবি। চেনা নাগরিক জীবনের চেনা ছন্দ। চাঁদনি স্টেশনে নামতেই এক আরপিএফ কর্মী দেখিয়ে দিলেন বাইরে বেরনোর গেট। একটি গেট প্রবেশের। অন্য একটি প্রস্থানের।
নাম না জানা জওয়ানের গলাতেও স্বস্তি, ‘‘অনেক দিন পর স্টেশনের সবক’টা আলো জ্বলল। এতদিন তো ফাঁকা স্টেশনে পাহারা দিতে হত।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy