মর্মান্তিক: সুড়ঙ্গ থেকে উদ্ধার করার পরে সজলকুমার কাঞ্জিলালের দেহ। শনিবার সন্ধ্যায়, পার্ক স্ট্রিট স্টেশনে। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
তখন সবে কামরার দরজাটা বন্ধ হয়েছে। পরের মুহূর্তেই শুনতে পেলাম, কয়েক জন যাত্রী চিৎকার করে বলছেন, ‘হাতের মুঠোটা খুলে দিন! তা হলে হাতটা বেরিয়ে যাবে!’
কবি সুভাষমুখী এসি মেট্রোটা তখন পার্ক স্ট্রিট স্টেশন ছাড়তে চলেছে। সাড়ে ছ’টা নাগাদ ধর্মতলা থেকে ভিড়ে ঠাসা মেট্রোয় উঠেছিলাম টালিগঞ্জ যাওয়ার জন্য। অন্য যাত্রীদের সঙ্গে গুঁতোগুঁতি করে কোনও মতে পৌঁছে গিয়েছিলাম উল্টো দিকের দরজার কাছাকাছি। পার্ক স্ট্রিট পৌঁছতেই জানলা দিয়ে দেখলাম, প্ল্যাটফর্মে গিজগিজ করছে লোক। মেট্রোর দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে উঠে পড়েছেন বহু যাত্রী। তার পরেই ওই চিৎকার।
কী ঘটল? বুঝতে না পেরে ভিড়ের ভিতর থেকেই কোনও মতে মুখটা বার করে দেখলাম, কামরার দু’টি দরজার মাঝে আটকে রয়েছে একটি হাতের মুঠো। ট্রেন তত ক্ষণে প্ল্যাটফর্ম ছাড়তে শুরু করেছে। আমরা, কামরার সমস্ত যাত্রী চিৎকার করতে লাগলাম। কিন্তু এসি মেট্রোর বাইরে সেই আওয়াজ পৌঁছচ্ছিল না। জানলা দিয়ে দেখা গেল, দরজায় হাত আটকানো অবস্থাতেই এক ব্যক্তি প্ল্যাটফর্ম ধরে দৌড়চ্ছেন। কয়েক জন যাত্রী ওই ব্যক্তির হাতের মুঠো খোলার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। বড়সড় বিপদ হতে চলেছে বুঝতে পেরে আমি কামরার কোথায় ট্রেনের চালকের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেনটি রয়েছে, খুঁজতে শুরু করলাম। আমার মতো আরও কয়েক জন তখন একই চেষ্টা করছেন। কিন্তু চেন মিলল না। তখনই চোখে পড়ল, মেট্রোর কামরার দেওয়ালে থাকা লাল রঙের একটি বোতাম। আর এক সহযাত্রী সেই আপৎকালীন অ্যালার্মের বোতাম টিপতে শুরু করলেন, কিন্তু কিছুই হল না। কয়েক জন আবার জরুরি নম্বরে ফোন করার চেষ্টা করতে লাগলেন। তাতেও কিছু হল না। চিৎকার করে ওই যাত্রীরা বলতে শুরু করলেন, ‘ফোন লাগছে না তো!’
ট্রেন তখন সুড়ঙ্গে ঢুকতে শুরু করেছে। জানলা দিয়েও আর দেখা যাচ্ছে না ওই ব্যক্তিকে। কিন্তু হাতের মুঠোটা রয়েছে দরজার ফাঁকে। কয়েক জন যাত্রী দরজা-জানলায় ধাক্কা মারতে শুরু করলেন। আমরা ছিলাম তৃতীয় কামরার তৃতীয় দরজার কাছে। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না দেখে কয়েক জন অল্পবয়সী যাত্রী ভিড় ঠেলে দৌড়তে শুরু করলেন চালকের কামরার দিকে। ও দিকে, ক্রমাগত হাতের মুঠোয় ধাক্কা মারতে থাকায় এক সময়ে আঙুলগুলি খুলে যায়। মেট্রোর টোকেনটা পড়ে যায় কামরার ভিতরে। মুঠো খুলে যেতেই হাতটি বেরিয়ে যায় দু’টি দরজার ফাঁক থেকে।
এই এসি মেট্রোর কামরাতেই আটকে গিয়েছিল তাঁর হাত। শনিবার সন্ধ্যায়, পার্ক স্ট্রিট স্টেশনে। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
এর পরে দু’বার ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল ট্রেন। বন্ধ হয়ে গেল নতুন রেকের এসিও। পোড়া গন্ধে ভরে গেল গোটা কামরা। ঠাসা ভিড়ে হাঁসফাঁস করা গরম, তার সঙ্গে একরাশ আতঙ্ক, উদ্বেগ গ্রাস করতে শুরু করল গোটা কামরার যাত্রীদের। কয়েকটি শিশু ভয়ে কান্নাকাটি জুড়ে দিল। কী ভাবে বেরোব, ওই যাত্রীরই বা কী হল, কিছুই বুঝতে পারছি না। দরদর করে ঘামতে শুরু করলাম। তত ক্ষণে প্রায় কুড়ি মিনিট কেটে গিয়েছে। আচমকাই কামরায় ঘোষণা হল, মেট্রোর একেবারে পিছনে থাকা গার্ডের কামরার দরজা দিয়ে প্রত্যেক যাত্রীকে নেমে যেতে অনুরোধ করা হচ্ছে। সেই মতো আমরাও নামতে শুরু করলাম।
ট্রেন থেকে নেমে দেখি, প্ল্যাটফর্ম লোকে ভর্তি। সকলেই ‘আমাদের গর্ব মেট্রো’ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ তুলছেন। জানতে পারলাম, হাতের মুঠো খুলে সুড়ঙ্গে পড়ে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে গিয়েছেন ওই ব্যক্তি। প্ল্যাটফর্মের একপাশে সরে দাঁড়ালাম। ভাবতে লাগলাম, এই তা হলে আমাদের গর্বের মেট্রোর আসল চেহারা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy