স্মৃতি: আমরি হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডের সময়ে চলছে উদ্ধারকাজ। ফাইল চিত্র
বাড়ি থেকে কাজে বেরোনোর পরে ফের নিরাপদে বাড়ি ফেরা যাবে, না কি কোনও অগ্নি-বলয়ের গ্রাসে ঝলসে যেতে হবে, এ শহর এখনও সেটা জানে না। যেমনটা জানে না, প্রতি বার অগ্নিকাণ্ডের পরে জবাবদিহি চাইতে কার কাছে যেতে হবে!
কারণ, প্রতি বারই মন্ত্রী-নেতাদের মুখে ‘প্রতিটা মৃত্যুই দুর্ভাগ্যজনক’ বা ‘মৃতদের জন্য ক্ষতিপূরণের ঘোষণা’-র মতো কিছু ক্লিশে মন্তব্য থাকে। কিন্তু যে পরিবারের লোকেরা তাঁদের প্রিয়জনকে হারাচ্ছেন, শুধুমাত্র আর্থিক সহায়তা করে কি তাঁদের প্রিয়জনকে হারানোর যে বেদনা, সেই ক্ষতে প্রলেপ দেওয়া সম্ভব? স্ট্র্যান্ড রোডে নিউ কয়লাঘাট ভবনে আগুন এবং তাতে ন’জনের প্রাণহানির ঘটনা ফের বহুল চর্চিত এই প্রশ্নগুলোকেই সামনে তুলে এনেছে।
যে প্রশ্নগুলির উত্তর গত এক দশকেও পাওয়া যায়নি। অথচ, সেই সময়সীমার মধ্যে শহরের বড় অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারিয়েছেন দেড়শোরও বেশি মানুষ। সেই মানুষগুলি বাড়ি থেকে কাজ বা চিকিৎসায় আরোগ্য লাভের জন্য বেরিয়ে আর ফিরতে পারেননি। কখনও স্টিফেন কোর্ট, কখনও আমরি হাসপাতাল, আবার কখনও শিয়ালদহের সূর্য সেন মার্কেটের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তাঁদের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।
কিন্তু নিউ কয়লাঘাট ভবনে অগ্নিকাণ্ডের পরে সাধারণ মানুষের একাংশের মনে এই প্রশ্নই দেখা গিয়েছে, অতর্কিতে আগুনে ঝলসে যাওয়াই কি ক্রমশ ভবিতব্য হয়ে উঠছে শহরের? না হলে ১১ বছর আগে স্টিফেন কোর্টের অগ্নিকাণ্ডের পরে সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়—‘বহুতলে আগুনের গ্রাস’। আবার, ২০১১ সালে আমরি হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডের পরে সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়—‘মৃত্যু নিকেতন’!
রাজ্য প্রশাসনের অবসরপ্রাপ্ত এক উচ্চপদস্থ আমলা জানাচ্ছেন, কেউ যদি শুধু গত ১১ বছরের বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলি নিয়ে সমীক্ষা করেন, তা হলে দেখা যাবে, কী ভাবে প্রতিটা দুর্ঘটনার পরে সরকার বা দমকলের ভূমিকা একই থেকে গিয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘প্রতি বারই একই ধরনের প্রশ্ন উঠেছে। অথচ উত্তর পাওয়া যায়নি।’’
অনেকে মনে করছেন, বিষয়টা অনেকটা এমন দাঁড়াচ্ছে যে, সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো কোথাও পুরনো তারের জট, কোথাও দাহ্য বস্তু অথবা মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়া অগ্নি-নির্বাপণ ব্যবস্থা নিয়ে ঘুমন্ত অগ্নিস্তূপ হয়ে রয়েছে শহরের এমন অগুনতি ভবন, যেখানে জীবিকার প্রয়োজনে প্রতিদিন সাধারণ মানুষকে যেতে হয়। কিন্তু সেখান থেকে বেঁচে ফেরা ক্রমশই ‘ভাগ্য-নির্ভর’ হয়ে পড়ছে। হয়তো তাই। না হলে কী ভাবে আমরি হাসপাতালের ঘটনার পরে যখন সংবাদপত্রে লেখা হয়—‘অগ্নিবিধি না মেনেও মেলে ছাড়’, তার সঙ্গে ১০ বছর পরে নিউ কয়লাঘাট ভবনে অগ্নিকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে সংবাদপত্রের শিরোনাম—‘অগ্নি পরীক্ষা ছাড়াই চলছিল রেল ভবন’!— এ ভাবে মিলে যায়!
প্রশাসনের এক কর্তা জানাচ্ছেন, সমস্যা হল, এটাই গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। যতক্ষণ না প্রশাসনিক বা অন্য গাফিলতির কারণে কেন
প্রাণহানি হবে— এই প্রশ্নটা সমাজের সব স্তর থেকে উঠবে, যত ক্ষণ না সাধারণ মানুষের প্রাণের মূল্য বোঝা যাবে, এটা বোঝা যাবে যে আর্থিক ক্ষতিপূরণই শেষ কথা নয়— তত ক্ষণ অগ্নি-সুরক্ষা বিধি সংক্রান্ত অনিয়মের ধারাবাহিকতা এ ভাবেই বজায় থাকবে এই শহরে।
নন্দরাম মার্কেট, স্টিফেন কোর্টে অগ্নিকাণ্ডের সময়ে কলকাতার মেয়রের দায়িত্বে ছিলেন বাম নেতা বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য। তাঁর কথায়, ‘‘দমকল দফতরের আধুনিকীকরণের প্রয়োজন। স্টিফেন কোর্টের পরে তার জন্য চেষ্টাও করা হয়েছিল। কিন্তু পরে হয়তো তার রক্ষণাবেক্ষণে ঘাটতি থেকে গিয়েছে।’’ আবার আমরি হাসপাতাল ও শিয়ালদহের সূর্য সেন মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের সময়ে দমকলমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন তৃণমূল নেতা জাভেদ খান। তিনি বলছেন, ‘‘খুব কম বাড়ি বা ভবনে অগ্নি-নির্বাপণ যন্ত্র দেখতে পাওয়া যায়। এখন আগুন লাগলে তা ছড়িয়ে পড়তে ১২-১৩ মিনিট সময় লাগে। ১০ মিনিটের মধ্যে নেভানো গেলে তা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।’’
কিন্তু গত ১১ বছরের অভিজ্ঞতা বলছে, আগুনকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়নি। যার মূল্য দিতে হয়েছে ১৬৫ জনকে। তবু বোধোদয় হয়নি!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy