স্মৃতি: জ্বলছে পার্ক স্ট্রিটের স্টিফেন কোর্ট। ফাইল চিত্র
নয় নয় করে দশ বছর কেটে গেল। কিন্তু, এখনও দগদগে হয়ে রয়েছে বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখা ক্ষত।
ঠিক দশ বছর আগে, ২০১০ সালের ২৩ মার্চ দুপুরে সর্বগ্রাসী আগুন গিলে নিয়েছিল অভিজাত পার্ক স্ট্রিটের গোটা বাড়িটাকে। সেই স্টিফেন কোর্ট থেকে কেউ পালিয়ে বেঁচেছিলেন। কেউ বেঁচেছিলেন ঝাঁপ দিয়ে। আবার ঝাঁপ দিতে গিয়ে এবং বদ্ধ সিঁড়িতে আটকে পুড়ে মারা গিয়েছিলেন ৪৩ জন। আহতের সংখ্যা ছিল কয়েকশো।
পুত্র-কন্যা-স্বামী-স্বজনহারা সেই মানুষগুলো তার পর থেকে প্রতি বছর মাথা নিচু করে গিয়ে হাজির হতেন স্টিফেন কোর্টের সামনে। প্রিয়জনের ছবি নিয়ে, মোমবাতি জ্বালিয়ে চুপ করে কিছু ক্ষণ সময় কাটিয়ে, দমবন্ধ করা যন্ত্রণা নিয়ে ফিরে যেতেন যে যার মতো। আর থাকত পুঞ্জীভূত ক্ষোভ।
সরকার সেই সময়ে এককালীন যতটুকু সাহায্য করেছিল, তার বাইরে এগিয়ে আসেনি আর কেউই। সন্তানেরা যে সংস্থায় কাজ করত, তারা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আশ্বাস দিলেও সেই টাকা আসেনি। ‘দিদিকে বলো’-তে ফোন করাটাই শুধু সার হয়েছে।
প্রতি বছর ২৩ মার্চ স্টিফেন কোর্টের সামনের হাজিরাটাও ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসতে থাকে। প্রথম পাঁচ বছর পরে ২৩ মার্চ তারিখে আর দশটা সাধারণ দিনের মতো জনস্রোত বয়ে যায় বাড়িটার সামনে দিয়ে। সামনে আর স্বজনহারাদের জমায়েত দেখা যায় না। সঞ্জয় সেনগুপ্ত, শৈলেন বারিক, সাধনা সেনগুপ্তেরা অবশ্য ঠিক করেছিলেন, দশ বছর বলে এ বার যাবেন স্টিফেন কোর্টের সামনে। সেই অভিশপ্ত দিনে স্বামী সত্যজিৎকে হারিয়েছিলেন সাধনা। তাঁর কথায়, ‘‘চার দিকে সব কিছু বন্ধ করে দিচ্ছে সরকার। এই অবস্থায় ছেলেকে নিয়ে বেরোনোটা ঠিক হবে না। আর যাবই বা কী করে।’’ স্টিফেন কোর্টে নিজের অফিস খুলেছিলেন সত্যজিৎ। সেই ঘর বা তার পরিবর্তে টাকা ফেরত পাননি সাধনা।
দশ বছরে ক্ষোভ এতটুকু কমেনি শৈলেন বারিকেরও। তাঁর ২২ বছরের ছেলে সৌরভ মারা গিয়েছিলেন সে দিন। যে বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করতেন সৌরভ, তারা টাকা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা হয়নি। একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিলেন শৈলেনবাবুর স্ত্রী কবিতা। পরে এক সন্তানকে দত্তক নেন বারিক দম্পতি। ক্ষতিপূরণ পেতে দরজায় দরজায় ঘুরেও লাভ হয়নি। শৈলেনবাবুর কথায়, ‘‘ছেলে যে সংস্থায় চাকরি করত, তা পরে স্থান বদলে ফুলবাগানে চলে এসেছিল। আমি ফুলবাগান থানাতেও অভিযোগ জানিয়েছি। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি।’’
ভয়াল সেই আগুনে সঞ্জয়বাবুও হারিয়েছেন ২২ বছরের পুত্র সায়নকে। সায়ন যে বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করতেন, সেখান থেকে একটি টাকাও ক্ষতিপূরণ মেলেনি। দুর্ঘটনার পরে পুলিশ জানিয়েছিল, আগুন নিয়ন্ত্রণ করার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিল না স্টিফেন কোর্টে। সেই অপ্রতুলতা নিয়েই অসংখ্য ছোট ছোট অফিস ও ফ্ল্যাট ছিল সেখানে। স্বজনহারাদের প্রশ্ন, যাঁদের গাফিলতিতে এতগুলো প্রাণ চলে গেল, তাঁদেরও তো সাজা হল না।
দশ বছর পরে সেই প্রশ্নটা হয়তো স্টিফেন কোর্টের দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে হারিয়ে যাবে ঝলমলে পার্ক স্ট্রিটের নিয়ন আলোর মাঝে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy