Advertisement
১০ জানুয়ারি ২০২৫

পায়ে হেঁটেই চিনেছি এই শহরকে

কোনও এক সময় বাবার হাত ধরেই এই কলকাতা শহরে আসা। ঠিক মনে নেই কবে প্রথম। আমার জীবনে প্রথম দেখা এই শহর ছিল ভীষণ গতিময়। সেখানে হাজার হাজার অচেনা মানুষের আনাগোনা। ঠিক যেন এক মেলা। শান্তিনিকেতনে বড় হয়ে ওঠা এই আমি নিজেকে খুব ক্ষুদ্র মনে করতাম সেই সময়ের অচেনা এই নগরে। গড়িয়াহাট ছিল সেই সময়ের সব থেকে বেশি যাতায়াতের জায়গা। বাবার বাল্যবন্ধু গোবিন্দন কুট্টির বাড়ি ছিল আমাদের গন্তব্যস্থল। রাতে ঘুমের ঘোরে কানে আসত হাতে টানা রিকশার ক্লান্ত টুংটাং শব্দ।

সুচিত্রা মিত্রের সঙ্গে

সুচিত্রা মিত্রের সঙ্গে

মনোজ মুরলি নায়ার
শেষ আপডেট: ২১ অগস্ট ২০১৪ ০০:০৬
Share: Save:

কোনও এক সময় বাবার হাত ধরেই এই কলকাতা শহরে আসা। ঠিক মনে নেই কবে প্রথম। আমার জীবনে প্রথম দেখা এই শহর ছিল ভীষণ গতিময়। সেখানে হাজার হাজার অচেনা মানুষের আনাগোনা। ঠিক যেন এক মেলা। শান্তিনিকেতনে বড় হয়ে ওঠা এই আমি নিজেকে খুব ক্ষুদ্র মনে করতাম সেই সময়ের অচেনা এই নগরে।

গড়িয়াহাট ছিল সেই সময়ের সব থেকে বেশি যাতায়াতের জায়গা। বাবার বাল্যবন্ধু গোবিন্দন কুট্টির বাড়ি ছিল আমাদের গন্তব্যস্থল। রাতে ঘুমের ঘোরে কানে আসত হাতে টানা রিকশার ক্লান্ত টুংটাং শব্দ। ট্যাক্সির অকারণ বেসুরো হর্ন। খড়খড়ি দেওয়া জানালার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিত বাইরের ব্যস্ত জীবন। কখনও কি ভেবেছিলাম যে, আমিও এক দিন এই ছুটন্ত শহরের ব্যস্ত নাগরিক হয়ে যাব?

আজ এই শহর একান্তই আমার। আমার সুখ-দুঃখের আশ্রয়। কাজের শেষে সে আমাকে টেনে নেয় নিশ্চিন্ত ঘুমের জগতে। স্বপ্ন বোনে পরের দিনের। আমার আগের দেখা সেই শহর আজ অনেক আধুনিক। তার গায়ে লেগেছে বৈভবের ছোঁয়া। আর মুখে উঠেছে শীতলতার মুখোশ। তবুও সে আমার।


কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে

সেই সময় বাসে উঠে টিকিট কেটে কান পেতে শোনার চেষ্টায় থাকতাম যে, আমার গন্তব্যে কোনও সহযাত্রী আছেন কিনা। সন্ধান পেলে নিশ্চিন্ত হতাম। সত্যি কথা বলতে কী, পায়ে হেঁটেই চেনা আমার কলকাতাকে। অবাক লাগে এই ভেবে যে, কখন যেন এই অচেনা রাস্তাগুলি আমার চেনা হয়ে উঠল। গাড়ি চালানো শেখাও এই শহরে। এক বার একটি অনুষ্ঠানের শেষে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার আগেই অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে বাড়ি পৌঁছনোর সাহস দেখিয়েছি। উনি কিন্তু গোটা রাস্তা আমার সঙ্গে পাড়ি দিলেন নিশ্চিন্তে গল্প করতে করতে। যদিও আজ আমার মনে হয়, সে দিন একটু বেশি-ই ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছিলাম।

সেই ২০০০ সাল থেকে নিয়মিত কলকাতায় যাতায়াত। এখনও আমার প্রিয় জায়গা রবীন্দ্রসদন চত্বর। তবে গড়ের মাঠে বৃষ্টিতে ভিজতে না পারার আক্ষেপ এখনও রয়ে গিয়েছে। সহজ বাঙালিয়ানার মতো রাস্তাঘাটের ট্রাফিকও যদি সহজ হত! এত চোখ রাঙানি থেকে রেহাই পেতাম। ‘ওয়ান ওয়ে, নো এন্ট্রি’ ভাল লাগে না। আর উফ্! অটো যদি শহরের রাস্তায় একটু কম চলত। বড় বেমানান সে এই অভিজাত শহরের দরবারে।


পণ্ডিত রবিশঙ্কর এবং...


রমা মণ্ডল ও মনোজ

উত্তর কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলেও সেই আমার বড় প্রিয়। দুর্গাপুজোর সময়ে বাগবাজারের মাতৃমূর্তি দেখার পরে আর কিছু দেখতে মন চায় না। পুরনো সময়ের একচিলতে আভাস লেগে থাকে দুর্গাপুজোর কলকাতার অলিগলিতে। তার আভাস পেয়েছি জোড়াসাঁকোর ইতিহাসে, অনেকের কাছে শোনা গল্পেও।

চিত্রতারকা না হয়েও যখন অনুষ্ঠানের ফ্লেক্স-এ নিজেকে দেখি এই শহরের ক্যানভাসে, তখন অবাক হয়ে ভাবি, ‘এই কি আমি?’ এই শহরের মানুষের এত ভালবাসা, আশীর্বাদ, স্নেহ, ভরসা, সম্মান ও সম্পর্ক আর কোথাও পাইনি। কাছে টেনে নেওয়ার এক সুন্দর প্রবণতা আছে কলকাতার। ট্রামলাইনের উপর দিয়ে যখন অন্য গাড়ির দাপট দেখি, তখন মনে হয় ট্রাম তো অন্য কারও জায়গা দখল করে না। সে তো তার নিজের পথেই খুশি। তাই কলকাতার রাস্তায় নিরীহ ট্রামকে চাই-ই চাই। জানেন তো, লেক মার্কেটের বিভিন্ন দোকানের মশলার গন্ধ আমার শৈশবের দিনগুলির সঙ্গে কেমন যেন মিশে গিয়েছে। কিন্তু হায়! এখন তা হারিয়ে গেছে মল-এর দামি সুরভিতে।


উষা উত্থুপ এবং শিল্পী


সঙ্গে তসলিমা নাসরিন

আমার জীবনসঙ্গিনীকেও খুঁজে পেয়েছি এই শহরে। সে আমায় নিয়ে এক বার কলকাতা চেনাতে বেরিয়েছিল। আমি শান্তিনিকেতনের প্রান্তিক সোনাঝুরিতে সাইকেলে ঘুরতে অভ্যস্ত ছিলাম। সে আমার হাতে ক্যানড কোক ধরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল আর্ট কলেজ, ভিক্টোরিয়া, বিড়লা মন্দির ও জাদুঘর। কলকাতার সেই বাঙালি মেয়েটি আমার সঙ্গী।

শান্তিনিকেতনের প্রান্তরের সেই খোলা আকাশ আজ নেই ঠিকই। কিন্তু আমার ঘরের জানলার বাইরে খুঁজে পাই আমার নানান রঙের আকাশকে। এক বার শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় আসছি। ট্রেনে খুব ভিড়। লাগেজ রাখার জায়গায় উঠে বসে দেখি আগের দিনের একটি আনন্দবাজার পত্রিকা পড়ে আছে। সেখানে প্রকাশিত একটি বিজ্ঞাপন দেখে আমার গাওয়া তিনটি গানের ক্যাসেট জমা দিয়েছিলাম তথ্যকেন্দ্রে। সেই জমা দেওয়া গান থেকেই আমার জীবনে এসে গেল ‘শ্রেষ্ঠ সম্ভাব্য গায়ক’এর পুরস্কার। রবীন্দ্রসদনে সেই প্রথম গান গাওয়ার সুযোগ পেলাম।


শিবকুমার শর্মা

আজ আমি নিজেকে পুরোপুরি কলকাতার বাঙালি বলে মনে করি। ষাট থেকে পঁয়ষট্টিটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের অ্যালবাম করার সুযোগ পেয়েছি। বাংলা আমার মা। গর্ব হয় যে এই শহর রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, সুকুমার রায়, সত্যজিৎ রায়ের। সেই শহরে আমিও আছি রবীন্দ্রনাথকে আঁকড়ে ধরে। দ্বিতীয় হুগলি সেতুর উপর দিয়ে যখন কলকাতার দিকে এগিয়ে চলি, তখন প্রতি বার অবাক হয়ে দেখি আমার শহর হাত মেলে আছে আমারই জন্য।

আমিও নিশ্চিন্তে মিশে যাই কলকাতার বুকে। বড় নিরাপদ লাগে।

লেখক: রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী

অন্য বিষয়গুলি:

manojmurali nayar tarader chokhe
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy