মহাদেব দাস। হুগলি জেলা তৃণমূল যুব কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক। জমি সমস্যা নিয়ে উলটপূরাণ এখন তাঁর মুখেও।— নিজস্ব চিত্র।
মাইলের পর মাইল ছুটে চলা পাঁচিলটার চার পাশে সারা দিন কেমন একটা পরিত্যক্ত, ভূতুড়ে আবহ। পাঁচিলের ভিতরে পড়ে রয়েছে একরের পর একর নিষ্ফলা জমি। ঝোপঝাড় আর আগাছার অপার রাজত্ব। হাজার একরের বিশাল এলাকাকে ধীরে ধীরে এমন ভূতের আড্ডায় পরিণত হতে দেখে সিঙ্গুরে এখন যত্রতত্র শোনা যাচ্ছে ভূতের মুখে রামনাম। বোধোদয়? নাকি অনেক প্রাপ্তির দোরগোড়ায় পৌঁছেও সব হারানোর যন্ত্রণা?
২০০৬ সালে যে কৃষিজমি রক্ষা কমিটি তৈরি হয়েছিল, আজও তার নেতা অশীতিপর মাস্টারমশাই রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। সিঙ্গুরের তিন বারের বিধায়ক তিনি। রাজ্যের মন্ত্রীও। কিন্তু মাস্টারমশাই নাকি দলনেত্রীর পায়ে এখন অস্বস্তির কাঁটা হয়ে বিঁধছেন। সিঙ্গুরজুড়ে জল্পনা এখন সে রকমই। এ জল্পনা অবশ্য নতুন নয়। যে পর্বে কৃষির মতো গুরুত্বপূর্ণ দফতর কেড়ে নিয়ে মাস্টারমশাইকে প্রায় বেকার পরিসংখ্যান ও পরিকল্পনা রূপায়ণ দফতরে পাঠিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী, তখন থেকেই জল্পনার শুরু। মাস্টারমশাইয়ের কিছু সোজাসাপটা মন্তব্য সেই আগুনে আরও অক্সিজেন জুগিয়েছে। তার পর সিঙ্গুরের কোনও এক ‘প্রিয় নেত্রী’ নাকি রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের পরিবারের মধ্যেই নিজের নজরদার বসিয়ে দিয়েছেন। বাসুবাটিতে গুঞ্জন অন্তত সে রকমই। এই গ্রামেই বাড়ি রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের। বাসুবাটির গুঞ্জনে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, ‘প্রিয় নেত্রী’র কাছ থেকে নির্দেশ পৌঁছেছে মাস্টারমশাইয়ের পুত্রবধূর কাছে— শ্বশুরমশাইকে একটু সামলে রাখো। তার পর থেকে বউমা’র অনুমতি ছাড়া শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে নাকি দেখা করতে পারছে না কোনও মিডিয়া। পছন্দের মিডিয়া না হলে বউমা আবডাল করে দিচ্ছেন শ্বশুরকে। পাছে মাস্টারমশাই আবার ‘বেফাঁস’ কিছু বলেন। পাছে স্বপ্নভঙ্গের কথা বলে ফেলে অস্বস্তি বাড়ান ‘প্রিয় নেত্রী’র!
বড় চমক অপেক্ষা করছিল খাসেরভেড়ি গ্রামেও। শাসক তৃণমূলের অন্দরে উলটপূরাণ সেখানেও বেশ স্পষ্ট। কৃষিজমি রক্ষা কমিটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মহাদেব দাসের কথা শুনলে রীতিমতো চমকে উঠতে হচ্ছে। মহাদেব যা বলে বসলেন, তার সারকথা হল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যত রকম স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন সিঙ্গুরবাসীকে, তার প্রায় কিছুই পূরণ হয়নি সাড়ে চার বছরে! মহাদেববাবু কিন্তু হুগলি জেলা তৃণমূল যুব কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদকও। সে সব মাথায় রেখেও মহাদেব দাসের সাফ কথা, ‘‘অধিগ্রহণের সময় জমি নিয়ে আমরা যে রকম ভেবেছিলেন, আজকের পরিস্থিতিতে সেই ভাবনা বদলে গিয়েছে।’’ আজকের পরিস্থিতিতে ঠিক কী ভাবছেন মহাদেবরা? কণ্ঠস্বরে গভীর খেদ। মহাদেব দাসের সোজাসাপটা জবাব, ‘‘জমির সমস্যা এত দিনে মিটে যাওয়া উচিত ছিল। রাজ্য সরকার তা পারেনি। সরকার যা করেছে, তা হল কৃষকদের জন্য মাসে ১৬ কেজি করে চাল আর ২০০০ টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা। কিন্তু এতে সংসার চলে না।’’ তা হলে উপায়? কৃষিজমি রক্ষা কমিটির এককালের দাপুটে নেতার কথায়, ‘‘শিল্প করতে হয় করুক। আমাদের জমিটুকু ছেড়ে দিক।’’
কতটা জমি ছাড়তে হবে সিঙ্গুরে টাটাকে ফেরাতে হলে? বড়জোর ১০০ একর। কারণ তৃণমূলের সরকার ক্ষমতায় আসার পর জমি ফেরত চাওয়ার আবেদন জমা দিতে বলা হয়েছিল সিঙ্গুরের কৃষকদের। সব মিলিয়ে যে পরিমাণ জমি ফেরানোর আবেদন জমা পড়েছিল, তা ১০০ একরেরও অনেক কম। মুখ বাঁচানোর তাগিদে কুড়িয়ে বাড়িয়ে প্রায় ১০০ একরের মতো জমি ফেরানোরই কাগজপত্র তৈরি করেছিল সরকার। কিন্তু ১০০ একরের অনেক বেশি জমিই তো এক সময় কৃষকদের ফিরিয়ে দিয়ে সমঝোতায় পৌঁছতে চেয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার। তা সত্ত্বেও সমঝোতা হয়নি কেন সে দিন? বৃহত্তর রাজনৈতিক লাভের কথা ভেবে কি ভেস্তে দেওয়া হয়েছিল রফাসূত্র?
প্রশ্নটা নতুন নয় সিঙ্গুরে। আগেও উঠেছে। কিন্তু সিঙ্গুরবাসীকে চোখ ঠেরে থাকতে শেখানো হয়েছিল এই প্রশ্নের দিক থেকে। এক দশক ধরে রাজনীতির ফাঁসে আটকে থাকতে থাকতে এ বার চোখ খুলতে শুরু করেছে সিঙ্গুর। কোনও প্রশ্ন তুলতেই আর অস্বস্তি নেই সিঙ্গুরের। শাপমুক্তি কোন পথে? আকুল জিজ্ঞাসা ধুঁকতে থাকা অর্থনীতির। সেই সব অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখে পড়তে চান না বলেই নাকি এখন খাসেরভেড়ি, বেড়াবেড়ি, রতনপুর, জয়মোল্লার পথ আর মাড়ান না ওই সব গ্রামের এককালের ‘প্রিয় নেত্রী’।
প্রস্তাবিত কারখানা চত্বর থেকে সামান্য কিছু জমি ছেড়ে দিলেই নাকি এখন শিল্প ফেরানো সম্ভব সিঙ্গুরের পরিত্যক্ত, ভূতুড়ে প্রকল্প এলাকাটায়। কিন্তু ওই সামান্য জমিটুকু ছেড়ে রফাসূত্রে পৌঁছে গেলে যে পরিমাণ রাজনৈতিক জমি বেরিয়ে যাবে হাত থেকে, তা ছাড়তে কি প্রস্তুত হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট? উত্তরটা জানে না সিঙ্গুরও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy