Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

‘চিনি না ওরে, চিনতেও চাই না আর’, আসামিদের বাড়ির কথা

রায় ঘোষণা যে শুক্রবার,  দিন তিনেক আগে এনআইএ-র দফতরে তা শুনে এসেছিলেন খাগড়াগড়ের সুতোয় জড়িয়ে যাওয়া হবিবুর রহমানের বাবা আব্দুল করিম।

এখন যেমন: খাগড়াগড়ের সেই বাড়ি। ছবি: উদিত সিংহ

এখন যেমন: খাগড়াগড়ের সেই বাড়ি। ছবি: উদিত সিংহ

নিজস্ব প্রতিবেদন 
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০১৯ ০৩:০৮
Share: Save:

ডিশ অ্যান্টেনা লাগানো পড়শি বাড়ির জানলা গলে দমকা হাওয়ার মতো ছুটে আসছে বাংলা চ্যানেলের খবর—

‘...খাগড়াগড় বিস্ফোরণ কাণ্ডে শুক্রবার সাজা ঘোষণা...’, মাথার ঘোমটা লম্বা করে টেনে বারান্দায় চলে গেলেন মনোয়ারা বিবি। তার পর, দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বুঝি, ‘‘আর পেরে উঠি না বাবা, আল্লা আমার হবিবুরটারে আর কত শাস্তি যে দেবে!’’

রায় ঘোষণা যে শুক্রবার, দিন তিনেক আগে এনআইএ-র দফতরে তা শুনে এসেছিলেন খাগড়াগড়ের সুতোয় জড়িয়ে যাওয়া হবিবুর রহমানের বাবা আব্দুল করিম। এ দিন বিকেল বহরমপুরের উপরডিহায় হবিবুরের বাড়িতে পড়শিদের ভিড়। বাড়িতে টিভি নেই, টালি ছাওয়া লম্বা বারান্দায় তাই প্রতিবেশীর অ্যান্ড্রয়েড ফোনের উপরে হুমড়ি খেয়ে আব্দুল জানতে চান, ‘‘ক’বৎসর সাজা দিল, ক’দেহি!’’ আট বছর শুনে, মেঘ ছাওয়া আকাশের দিকে চেয়ে চুপ করে বসে পড়েন উঠোনের পেঁপে গাছতলায়। ফিরে আসার মুখে, উঠে দাঁড়ান আব্দুল, বলছেন, ‘‘‘জ়ানেন ছেলেটা মাছি মারতেও জ়ানত না। সে কিনা জঙ্গি বলে কবুল করল!’’

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

হবিবুরের বাড়ি থেকে কিলোমিটারখানেক দূরে নবগ্রামের তালগড়িয়া গ্রাম। খাগড়াগড় বিস্ফোরণে অভিযুক্ত দুই মহিলার অন্যতম আলিমা বিবির নিতান্তই আটপৌরে বাড়ি। স্বামী আব্দুল হাকিমের সঙ্গে আদালত তার উপরেও ঝুলিয়ে দিয়েছে শাস্তির মেয়াদ— ৬ বছর। টিভি-ফোন, এ বাড়ির চৌহদ্দিতে সে সবের বালাই নেই। সাজা ঘোষণা যে আজ, জানতেনই না কেউই। আলিমার মা, সাবিরা বিবি নির্বিকার গলায় বলছেন, ‘‘আইজ সাজা হল বুঝি, জ়ানি না তো, খোদা জ়া করেন ভালর জন্যই করেন!’’

সন্ধে হয়ে আসছে, শাড়ির আঁচলে চোখ মোছেন সাবিরা। তার পর যেন স্বগতোক্তির মতো বলতে থাকেন, ‘‘শিমুলিয়া মাদ্রাসায় পড়ার সময়েই বীরভূমের আব্দুল হাকিমের সঙ্গে নিকা হল মেয়েটার। তার যে এমন পরিণতি হবে কে জানত!’’

এত কিছুর পরেও অবশ্য ‘আল্লাতালার’ উপরে ভরসা রাখছেন আমজাদ আলি ওরফে কাজলের মা মমতাজ বেগম। কীর্ণাহারের গ্রামে তাঁর ভাঙা উঠোনে বসে বলছেন, ‘‘এখনও ভরসা রাখি তেনার উপরে! ছেলেটা নির্দোষ জানেন, দেখবেন আল্লার বিচারে এক দিন বেকসুর খালাস হবে।’’ পায়া-ভাঙা খাটের উপরে শুয়ে কাজলের বাবা সুকুর শেখও আশা বুনছেন, ‘‘এই ভাল, আট বছরের সাজা, এক দিন ঠিক ফিরবে!’’

খাগড়াগড়ের অভিযুক্তদের দীর্ঘ তালিকায় রয়েছেন নদিয়ার বারবাকপুরের আজিজুল গাজির ছোট মেয়ে রাজিয়া। শাকিল আহমেদের সঙ্গে নিকার পরে দিব্যি সংসারে ডুবে ছিল মেয়ে। রাজিয়ার মা জাহিমা বেওয়া শিউরে ওঠেন, ‘‘জামাই (শাকিল) যে বাংলাদেশের তা কি জানতাম! তার মনে যে এত পাপ তা-ই বা বুঝব কী করে। নিজেও (শাকিল আহমেদ) ছিন্নভিন্ন হল, মেয়েটার জীবনও বরবাদ করল গো!’’

বর্ধমানের বাদশাহি রোডের রেজাউল করিম আর মঙ্গলকোটের কুলসুনো গ্রামের আবুল কালাম— দু’জনেরই সাজার মেয়াদ আট বছর। বাড়িতে এখনও ঝুলছে মরচে পড়া তালা। লাগোয়া বাড়িতেই থাকেন রেজাউলের কাকা চমক শেখ। বলছেন, ‘‘ভাইপোটাকে আমিই রাজমিস্ত্রির কাজ শিখিয়েছিলাম। এক সঙ্গে কাজেও যেতাম। এমন সর্বনাশ হল যে কী করে!’’ কুলসুনো গ্রামে কালামের বাড়িতে অবশ্য ভাইকে নিয়ে তেমন মাথাব্যথা নেই দাদা আব্দুস সালামের, স্পষ্ট বলছেন ‘‘ভাইয়ের সঙ্গে বহু বছর সম্পর্ক নেই।’’ রঘুনাথগঞ্জের খোদারামপুরের ভুতবাগান পল্লিতেও তেমনই নিস্পৃহতা। খাগড়াগড় কাণ্ডে ধরা পড়ার পরে রেজাউল করিমকে তারা কেউ চিনতে চান না আর। পড়শিরা সমস্বরে বলছেন, ‘‘চিনি না ওরে, চিনতেও চাই না আর!’’

অন্য বিষয়গুলি:

Khagragarh Blast Terrorism
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy