অভিযোগকারিণী। — ফাইল চিত্র।
সুবিচারের আশায় দিন গুনছিলেন কেতুগ্রামের বিধবা।
প্রায় চার বছর আগে গোটা রাজ্যে হইচই ফেলে দেওয়া সেই কাটোয়া ধর্ষণ মামলায় সব অভিযুক্তই বেকসুর খালাস হয়ে গেলেন।
শুক্রবার দুপুরে বর্ধমানের কাটোয়া আদালতের ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের বিচারক কাজী আবু হাসেম জানান, যা সাক্ষ্যপ্রমাণ তাঁর হাতে এসেছে, তাতে ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। ডাকাতি হয়েছিল ঠিকই, তবে অভিযুক্তেরা যে তাতেও জড়িত ছিল, এমন কোনও প্রমাণও মেলেনি।
প্রত্যাশিত ভাবেই, রায় শুনে ভেঙে পড়েছেন অভিযোগকারিণী ও তাঁর পরিবার। হতাশ গোটা গ্রাম। অভিযোগকারিণী বলেন, “সত্য ঘটনাও প্রমাণিত হল না! অপরাধীদের চিনিয়ে দেওয়া থেকে সব রকম ভাবে সাহায্য করেছি। আর কী করতে পারতাম!” গ্রামের অনেকেরই প্রশ্ন, নাবালিকা মেয়ের মাথায় বন্দুক ধরে যে মাকে ট্রেন থেকে নামিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তাঁর অভিযোগ প্রমাণ করা গেল না কেন? পুলিশের উপরে কোনও চাপ ছিল?
ঘটনাচক্রে, ২০১২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ওই ঘটনার পরেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘সাজানো ঘটনা’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। এ দিন রেজাউল মির্জা-সহ পাঁচ অভিযুক্ত বেকসুর খালাস হওয়ার পরে অভিযোগকারিণীর ভাসুরের আক্ষেপ, “দীর্ঘ লড়াইয়ের পরে দেখা গেল, সবাই মিলে মুখ্যমন্ত্রীর কথা সত্যি পরিণত করল।”
সেই সময়ে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য ছিল, ‘‘সে (অভিযোগকারিণী) বলেছে, তার স্বামী সিপিএম করেন।’’ যদিও মহিলার স্বামী তার ১১ বছর আগেই মারা গিয়েছেন। তা ছাড়া, কেউ সিপিএম করলে তাঁর স্ত্রীকে ধর্ষণ করার অধিকার মেলে কি না, সেই প্রশ্নও তুলেছিলেন বিরোধীরা। এ দিন রায় বেরনোর পরে প্রত্যাশিত ভাবেই তাঁরা ফের সরব হয়েছেন।
বিধানসভার বিরোধী দলনেতা, সিপিএমের সূর্যকান্ত মিশ্রের মম্তব্য, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী এই ধর্ষণের ঘটনাকে সাজানো বলেছিলেন। এখন সব অভিযুক্ত খালাস পেয়ে গেল! এতেই তো গোটা ব্যাপারটা পরিষ্কার।’’ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর কটাক্ষ, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী তো বলেই দিয়েছিলেন, সাজানো ঘটনা। এই ইঙ্গিতই তো তৃণমূল সরকারের পুলিশের কাছে যথেষ্ট ছিল। পুলিশ তেমন ভাবেই কাজ করেছে।’’ রাজ্য বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান, সিপিএম নেতা বিমান বসুর মতে, ‘‘সঠিক তদন্তই হচ্ছে না। প্রশাসন অপরাধীদের আড়াল করছে বলেই তারা ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে।’’
অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে সরকারি আইনজীবীর ভূমিকা নিয়েও। কাটোয়া আদালতের যে সরকারি আইনজীবী গোড়া থেকে এই মামলা লড়ে এসেছেন, তৃণমূলের জেলা সহ-সভাপতি সেই কাঞ্চন মুখোপাধ্যায় রায় শোনার পরেই ইস্তফা দেন। তাঁর কথায়, ‘‘অপরাধ প্রমাণের ভার আমারই ছিল। আমি আদালতকে বোঝাতে পারিনি, এটা আমার ব্যর্থতা। তাই ইস্তফা দিচ্ছি।’’
রাজ্য সরকার কি এই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে যাবে? বর্ধমান জেলার সরকারি আইনজীবী সুব্রত হাটি রাতে দাবি করেন, গোটা ঘটনাটা তিনি বিশদে জানেন না। তাঁর কথায়, ‘‘আগে কাগজপত্র হাতে পাই। প্রয়োজনে উচ্চ আদালতে যাব।’’
অভিযোগকারিণীর যা পারিবারিক অবস্থা, তাতে নিজেরা এই মামলা চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা তাঁদের নেই। সিপিএম সূত্রে খবর, মহিলা যাতে এই রায় চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে যেতে পারেন, তাতে সহায়তা করার ভাবনাচিন্তা চলছে। অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবী ধীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য বলেন, ‘‘আদালতে প্রমাণ হয়ে গিয়েছে যে ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগ করা হয়েছিল। উচ্চ আদালতে গেলেও ওরা হারবে।’’
সুপ্রিম কোর্টের মতে, কোনও মহিলা নিজের সম্ভ্রম বাজি রেখে ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগ করেন না। কাজেই কেউ এমন অভিযোগ আনলে তা গুরুত্ব দিয়ে বিচার করতে হবে। এমনকী ডাক্তারি পরীক্ষায় যদি যথেষ্ট প্রমাণ না-ও মেলে, তাতেও অভিযোগ লঘু করা যাবে না। সেই প্রসঙ্গ টেনে বিরোধীদের প্রশ্ন, দুই মেয়ের মা তবে কি মিথ্যে অভিযোগ করেছিলেন, বিশেষ করে এক মেয়ের সামনেই যখন তাঁকে ট্রেন থেকে নামিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল? তাতে তাঁদের কী লাভ হয়েছে? উল্টে গত সাড়ে তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে ওই বিধবা ও তাঁর মেয়েরা প্রায় গৃহবন্দি রয়েছেন। এখন তাঁরা আরও বেশি সন্ত্রস্ত। মহিলার কথায়, ‘‘ওরা জেল থেকে বেরিয়ে আসছে। খুব বিপদে পড়ে গেলাম। আমার যা যাওয়ার তা তো গিয়েছেই, মেয়েদের নিয়েই চিন্তা।’’
এই সংক্রান্ত আরও খবর...
ফৌজদারি মামলায় অন্যতম গুরুত্ব পায় যে দু’টি বিষয়— ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গোপন জবানবন্দি এবং টিআই প্যারেডে অপরাধীদের শনাক্তকরণ, দু’টিই এই মামলায় করা হয়েছিল। গোপন জবানবন্দিতে বিধবা এবং তাঁর ছোট মেয়ে (ঘটনার সময়ে যার বয়স ছিল মোটে ১১ বছর এবং যার মাথায় বন্দুক ধরা হয়েছিল বলে অভিযোগ) ট্রেন থেকে
নামিয়ে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণের কথা বলেছিলেন। কাটোয়া উপ-সংশোধানাগারে টিআই প্যারেডে মূল অভিযুক্ত রেজাউল মির্জাকে দেখে চটি হাতে তেড়ে গিয়েছিলেন অভিযোগকারিণী।
বিচারকের কিন্তু জবানবন্দির বয়ান বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। রায়ে অন্য নানা অসঙ্গতির উল্লেখ করেছেন তিনি। শনাক্তকরণ প্রসঙ্গে তাঁর সংশয়— ডাকাতির সময়ে একে তো অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল, তার উপরে দুষ্কৃতীরা এসেছিল মুখে কাপড় বেঁধে, সে ক্ষেত্রে মহিলা বা তাঁর মেয়ে কী করে তাদের মুখ দেখলেন? পুলিশ আগেই রেজাউলদের ছবি তাঁদের দেখিয়ে দিয়েছিল কি না, সেই প্রশ্নও তুলেছে অভিযুক্ত পক্ষ।
আশ্চর্য কারণে কিন্তু বাদ গিয়েছে জরুরি একটি পরীক্ষা। রেজাউলই আসল অপরাধী কি না তা যাচাই করার জন্য তার বীর্যের নমুনার সঙ্গে অভিযোগকারিণীর পোশাকে লেগে থাকা বীর্যের চিহ্ন মিলিয়ে দেখা জরুরি ছিল। কিন্তু পুলিশ তা সংগ্রহই করেনি। সে সময়ে কাটোয়া মহকুমা হাসপাতালের চিকিৎসক জানান, রেজাউল ঘাবড়ে যাওয়ায় তার বীর্য পাওয়া যায়নি। কিন্তু পরে আর চেষ্টা করা হল না কেন, তার সদুত্তর মেলেনি। ফলে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন এড়ানো যাচ্ছে না।
মামলার তদন্তকারী অফিসার জয়জিৎ লোধ অবশ্য দাবি করেন, ‘‘উপযুক্ত তদন্ত করেই চার্জশিট দেওয়া হয়েছিল। আশা করেছিলাম, অভিযুক্তেরা সাজা পাবে। কেন এই রায়, বুঝছি না।’’
রাজ্যের মন্ত্রী তথা তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মতে, বিরোধীরা বিষয়টির মধ্যে অহেতুক রাজনীতি খুঁজছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘প্রশাসনকে সব সময়েই নির্ভীক ভাবে কাজ করতে বলা হচ্ছে। মুশকিল হল, যখন প্রশাসন কাজ করে, তখন বিরোধীরা বলে প্রভাবিত করা হচ্ছে! আর যখন কাজ করে না, বলা হয় প্রশাসন নিষ্ক্রিয়!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy