নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নানা মন্তব্য আলোচিত হয়েছে। নিজস্ব চিত্র।
তিনি যেন আক্ষরিক অর্থেই ‘দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন’-এর ভূমিকায় নিজেকে মেলে ধরেছিলেন। অনেকের কাছেই রাতারাতি ‘ভগবান’ হয়ে উঠেছেন। রাজ্যে শিক্ষায় নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ডে তাঁর একের পর এক নির্দেশ ঘিরে সরগরম হয়েছে রাজ্য রাজনীতি। পাশাপাশি তার আঁচ পড়েছে জনমানসেও। কলকাতা হাই কোর্টের সেই বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাস থেকে নিয়োগ সংক্রান্ত মামলা সরানোর নির্দেশ দিল সুপ্রিম কোর্ট।
নিয়োগ দুর্নীতিতে একাধিক মামলায় ‘সাহসী’ রায় দিয়ে নজর কেড়েছেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। নিয়োগ দুর্নীতির বিভিন্ন মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। তাঁর নির্দেশেই বিপাকে পড়েন প্রাক্তন মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, তৃণমূল বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্য-সহ শিক্ষা দফতরের একাধিক আধিকারিক। নিয়োগ দুর্নীতির বিভিন্ন মামলায় বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশ হইচই ফেলে দিয়েছে সর্বত্র। নিয়োগ দুর্নীতির মামলার শুনানিতে তদন্তের গতিপ্রকৃতি নিয়ে বিভিন্ন সময় সিবিআইকেও ভর্ৎসনা করেছেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়।
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশগুলির মধ্যে অন্যতম প্রাক্তন মন্ত্রী পরেশ অধিকারীর কন্যা অঙ্কিতাকে চাকরি থেকে বরখাস্তের নির্দেশ। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশ ছিল, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষিকা হিসাবে অঙ্কিতা যত বেতন পেয়েছেন, তা দু’দফায় ফেরত দিতে হবে। একই সঙ্গে তিনি আর শিক্ষিকা হিসাবে নিজের পরিচয় দিতে পারবেন না। অঙ্কিতার সেই চাকরি পান যোগ্য প্রার্থী ববিতা সরকার। অযোগ্য প্রার্থীকে সরিয়ে যোগ্য প্রার্থীকে চাকরি দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে রাতারাতি জনতা-জনার্দনের কাছে ‘ভগবান’ হয়ে ওঠেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। পরবর্তী কালে একের পর এক শুনানিতে শিক্ষক-অশিক্ষকের চাকরি গিয়েছে। তার মধ্যে যেমন রয়েছেন প্রাথমিক শিক্ষক, তেমনই নবম-দশম, একাদশ-দ্বাদশের শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মী।
২০২৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি। সেই সময় বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় নির্দেশে এসএসসির গ্রুপ ডি-র ১,৯১১ জন কর্মীর চাকরি যায়। রাজ্যের ১,৯১১ জন গ্রুপ ডি কর্মীকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার পাশাপাশি তাঁদের ৩ সপ্তাহের মধ্যে বেতন ফেরতের নির্দেশ দেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। এর পর ১০ মার্চ, শুক্রবার গ্রুপ সি’তে কর্মরত ৮৪২ জনের চাকরি বাতিলের নির্দেশ দেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। নির্দেশে আদালত জানায় ওই ৮৪২ জন আর স্কুলে প্রবেশ করতে পারবেন না।
নিয়োগ দুর্নীতির বিভিন্ন মামলায় বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের মন্তব্য এবং নির্দেশ বরাবরই খবরের শিরোনামে থেকেছে। নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ডে গ্রেফতার করা হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি তথা পলাশিপাড়ার তৃণমূল বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্যকে। মানিকের সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। এক মামলায় তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘‘যাঁরা সাদা খাতা জমা দিয়ে চাকরি পেয়েছিলেন, তাঁরা পদত্যাগ না করলে এ ব্যাপারে আদালতই ব্যবস্থা নেবে।’’ ববিতার মতো আরও অনেক যোগ্য প্রার্থীকে চাকরি দিতে নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রিয়ঙ্কা সাউ নামে এক ‘যোগ্য’ চাকরিপ্রার্থী। তাঁকেও চাকরি দিতে এসএসসিকে নির্দেশ দিয়েছিল আদালত।
মামলা চলাকালীন তাঁর বিভিন্ন মন্তব্যও আলোচিত হয়। কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি নিয়ে ‘বিরূপ’ মন্তব্য করার অভিযোগ উঠেছিল এক বর্ষীয়ান আইনজীবীর বিরুদ্ধে। নাম না করে ওই আইনজীবীকে ‘জ্যাঠামশাই’ বলে সম্বোধন করেছিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। আবার, নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় কখনও তিনি বলেছেন, ‘‘দুর্নীতির মহাসমুদ্রে আমি হাবুডুবু খাচ্ছি।” আবার তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘চারপাশে এত দুর্বৃত্ত, দিদি একা সামলাতে পারছেন না।’’ এসএসসির উদ্দেশে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় এক বার বলেছিলেন, ‘‘কোনও রকম ভয় পাবেন না। অনেক ধেড়ে ইঁদুর বেরোবে।’’ গত ৬ ডিসেম্বর ২০১৬ সালের প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ার পুরো প্যানেল বাতিলের হুঁশিয়ারি দেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। ওই হুঁশিয়ারি দিয়ে বিচারপতি বলেছিলেন, ‘‘আমি ঢাকি সমেত বিসর্জন দিয়ে দেব।’’ পরে অবশ্য তিনি বলেন, পর্ষদের আইনজীবীরা তাঁকে এই কথা বলতে বাধ্য করেছেন।
শিক্ষা ক্ষেত্রে নিয়োগ দুর্নীতির মামলার পাশাপাশি পুরসভায় নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। শিক্ষায় নিয়োগ দুর্নীতিতে গ্রেফতার করা হয়েছে হুগলির প্রোমোটার অয়ন শীলকে। তাঁর কাছ থেকে পুরসভায় নিয়োগের বেশ কিছু নথি উদ্ধার করা হয়। তার পরই পুরসভায় নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেন তিনি। গত ২৯ মার্চ শহিদ মিনারের সভা থেকে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেছিলেন, সারদা মামলায় হেফাজতে থাকার সময় মদন মিত্র এবং কুণাল ঘোষকে তাঁর নাম নিতে বলেছিল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। অভিষেকের এই মন্তব্যের পর পরই নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ডে ধৃত তৃণমূলের প্রাক্তন যুব নেতা কুন্তল ঘোষ অভিযোগ করেন যে, তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের নাম বলার জন্য তাঁকে ‘চাপ’ দিচ্ছেন কেন্দ্রীয় তদন্তকারীরা। জেল থেকে ইডি এবং সিবিআইয়ের বিরুদ্ধে ওই অভিযোগ করে চিঠিও লিখেছিলেন কুন্তল। পরে নিম্ন আদালতের বিচারকের কাছেও একই মর্মে অভিযোগ জানিয়েছিলেন। সেই অভিযোগের বিষয়টি হাই কোর্টে তুলেছিল ইডি। সেই চিঠি প্রসঙ্গে নির্দেশনামায় বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, প্রয়োজনে অভিষেককে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে ইডি, সিবিআইয়ের মতো কেন্দ্রীয় সংস্থা। সেই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিলেন অভিষেক। যে রায়ের উপর স্থগিতাদেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট।
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের একাধিক নির্দেশ এবং মন্তব্য ঘিরে সরগরম হয়েছে রাজ্য রাজনীতিও। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়কে আক্রমণ শানান তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ। তাঁকে রাজনীতিতে আসার কথাও বলেন।
নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের একের পর এক নির্দেশ এবং তাঁর মন্তব্য নজর কেড়েছে জনমানসে। তাই হাই কোর্টের চৌহদ্দির বাইরে যখনই কোথাও তিনি গিয়েছেন, তাঁকে দেখে ভিড় জমিয়েছেন সাধারণ মানুষ। কেউ ছবি তুলেছেন, কেউ আবার এক বার চোখের দেখা দেখেছেন। এমন ‘জনপ্রিয়তার’ আবহে নিয়োগ দুর্নীতির মামলা চলাকালীনই একটি টিভি চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিয়ে নতুন করে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। যা ঘিরে বিভিন্ন মহলে সমালোচনা চলে। সেই সাক্ষাৎকারের জন্যই শেষ পর্যন্ত মামলা সরানো হল বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাস থেকে।
চলতি সপ্তাহেই বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘‘শুনছি কেউ কেউ রটাচ্ছে আমি নাকি ইস্তফা দিচ্ছি...! আমি পদত্যাগ করছি না। যে লড়াই শুরু হয়েছে। সেই লড়াই চলবে।’’ আরও বলেছিলেন, ‘‘আমি হয়তো সব দিন থাকব না। কিন্তু আমি থাকি বা না থাকি লড়াই বন্ধ হবে না।’’ নিয়োগ সংক্রান্ত মামলা সরানো হল তাঁর এজলাস থেকে, এ বার কেমন লড়াই চালাবেন তিনি? সে দিকেই নজর থাকবে রাজ্যবাসীর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy