বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
প্রাথমিকের নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। তা নিয়ে কোর্টের নির্দেশে তদন্ত চলছে। এ বার প্রাথমিক শিক্ষকদের ‘পোস্টিং’ নিয়েও একই অভিযোগ উঠল। সে রকম একটি মামলার প্রেক্ষিতে মঙ্গলবার বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় সিবিআই-কে নির্দেশ দিলেন, রাতেই প্রেসিডেন্সি জেলে গিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যকে জেরা করতে হবে। সেই নির্দেশ মতো রাতেই প্রেসিডেন্সি জেলে পৌঁছলেন সিবিআইয়ের চার আধিকারিক। এসপি কল্যাণ ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে জেলে গিয়ে মানিককে জেরা করছেন দু’টি পৃথক মামলার তদন্তকারী আধিকারিক মলয় দাস, ওয়াসিম আক্রম খান-সহ চার জন। হাই কোর্টের নির্দেশে এই জিজ্ঞাসাবাদের ভিডিয়োগ্রাফিও করা হবে।
প্রাথমিক শিক্ষকদের ‘পোস্টিং’ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে একটি মামলা করেন সুকান্ত প্রামাণিক। মঙ্গলবার সেই মামলাটি বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসে ওঠে। বিচারপতির পর্যবেক্ষণ, প্রাথমিকের নিয়োগে পরিকল্পিত ভাবে দুর্নীতি হয়েছে। যার নেপথ্যে রয়েছেন প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের তৎকালীন সভাপতি মানিক ভট্টাচার্য। মানিক ছক কষে দুর্নীতি (ডিজাইনড্ করাপশন) করেছেন। এর পরেই বিচারপতি জানান, মানিককে জেরা করার প্রয়োজন রয়েছে। তাঁর মতে, ‘‘যে ব্যক্তি টাকার বিনিময়ে সুবিধা পাইয়ে দিয়েছেন, তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।’’
এই জিজ্ঞাসাবাদের ভার তিনি সিবিআইয়ের উপরেই দেন। জানান, দক্ষ আধিকারিকদের জেলে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। রাত সাড়ে ৮টা থেকে শুরু করতে হবে জিজ্ঞাসাবাদ। এজলাসে বসেই সিবিআইয়ের আধিকারিকদের মামলার বিষয়বস্তু বুঝিয়ে দেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি এ-ও নির্দেশ দেন যে, এ বিষয়ে তদন্তকারী আধিকারিকদের সাহায্য করবেন জেলের সুপার। অসহযোগিতার অভিযোগ এলে আদালত কড়া পদক্ষেপ করবে বলেও জানান বিচারপতি। এমনকি, এই মামলায় ইডি-কেও যুক্ত করার নির্দেশ দেন তিনি। জানিয়ে দেন, এই মামলায় কোনও আর্থিক তছরুপ হয়ে থাকলে তদন্ত করতে পারবে ইডি। মঙ্গলবার থেকেই শুরু করা যাবে তদন্ত।
সিবিআইকে জিজ্ঞাসাবাদের দায়িত্ব দেওয়ার পাশাপাশি তাদের তদন্ত নিয়েও অসন্তোষও প্রকাশ করেছেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি জানিয়েছেন, প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীর দফতরেও যাবেন তিনি। কারণ, সিবিআইকে নিয়োগ করেন তিনিই। অন্য দিকে, ২০১২ সালে প্রাথমিক নিয়োগে নিয়ে একটি মামলায় মঙ্গলবার রাজ্যের শিক্ষা দফতরকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। ২০১২ সালে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে পূর্ব মেদিনীপুরে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। তা নিয়ে মামলাও হয়। ২০১৬ সালে শিক্ষা দফতরের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারিকে তদন্তের নির্দেশ দেয় আদালত। কিন্তু সাত বছর পেরিয়ে গেলেও সেই নির্দেশ এখনও কার্যকর হয়নি। বিষয়টি নিয়ে নতুন করে মামলা দায়ের হয় হাই কোর্টে। সেই মামলাতেই শিক্ষা দফতরকে জরিমানা করেন বিচারপতি। জানান, যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হবে, তাঁদের থেকে জরিমানার টাকা নিতে হবে।
হাই কোর্টের পাশাপাশি, মঙ্গলবার শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির মামলা উঠেছে সুপ্রিম কোর্টেও। সেখানে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষক নিয়োগের মামলায় উত্তরপত্র (ওএমআর শিট) দেখতে চেয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। তবে ওএমআর শিট প্রকাশের বিষয়ে এক সপ্তাহের অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ দিয়েছে শীর্ষ আদালত।
জেলে গিয়ে জেরা
কোথায় কোন প্রাথমিক শিক্ষককে নিয়োগ করা হবে, এই সংক্রান্ত মামলায় মঙ্গলবার বিকেলে মানিককে প্রেসিডেন্সি জেলে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য সিবিআইকে নির্দেশ দেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। এর পর সন্ধ্যায় বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় ফের এজলাসে গিয়ে বসেন। সেখানে ছিলেন এসপি পদমর্যাদার সিবিআই আধিকারিক কল্যাণ ভট্টাচার্য-সহ ওয়াসিম আক্রম খান এবং ইনস্পেক্টর মলয় দাস। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় তাঁদের নির্দেশ দেন, ‘‘এখনই প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগারে চলে যান।’’ সেখানে গিয়ে রাত সাড়ে ৮টা থেকে মানিককে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দেন তিনি। মামলার বিষয়বস্তু তদন্তকারী আধিকারিকদের বুঝিয়েও দেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর আরও নির্দেশ, সিবিআই আধিকারিকদের সমস্ত রকম সহযোগিতা করতে হবে জেল সুপারকে। অসহযোগিতার অভিযোগ এলে আদালত কড়া পদক্ষেপ করবে। মামলাকারীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, জেল সুপারকেও মামলায় যুক্ত করতে হবে।
সিবিআই নিয়ে ক্ষোভ
মঙ্গলবার প্রাথমিক শিক্ষকের ‘পোস্টিং’ সংক্রান্ত একটি মামলায় সিবিআইয়ের ভূমিকায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। মঙ্গলবার তিনি মন্তব্য করেন, কিছুই হচ্ছে না। তিনি যে বিষয়টি ‘সহ্য’ করবেন না, জানিয়ে দেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর মন্তব্য, ‘‘দিল্লি থেকে সিবিআইয়ের অধিকর্তাকে তলব করব। আমি নিজেকে আটকে রাখতে পারব না। আমি দেখছি। আপনারা না পারলে আমি দেশের প্রধানমন্ত্রীর দফতরে বিষয়টি বলব। কারণ, সেখান থেকে আপনাদের নিয়োগ করা হয়।’’ এর আগে নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে সিবিআইয়ের ভূমিকা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে নিম্ন আদালত। তদন্তে ঢিলেমির কথাও বলেছিলেন বিচারক।
মানিকের হলফনামা তলব
প্রাথমিকে নিয়োগের অন্য একটি মামলায় মানিকের কাছ থেকে হলফনামা চেয়েছিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। মঙ্গলবার সেই হলফনামা বিচারপতির এজলাসে জমা দিতে আসেন মানিকের কন্যা স্বাতী ভট্টাচার্য। কিন্তু তাঁর কাছ থেকে হলফনামাটি জমা নেননি বিচারপতি। পরিবর্তে প্রেসিডেন্সি কারা কর্তৃপক্ষকে তাঁর নির্দেশ, মানিক যাতে জেল থেকেই হলফনামা দিতে পারেন, সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
ইডিকে যুক্ত করার নির্দেশ
প্রাথমিক শিক্ষকদের পোস্টিং সংক্রান্ত একটি মামলায় ইডিকে যুক্ত করার নির্দেশ দিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। ইডিকে তাঁর নির্দেশ, এই মামলায় কোনও আর্থিক তছরুপ হয়ে থাকলে তদন্ত করতে পারবে তারা। মঙ্গলবার থেকেই শুরু করা যাবে তদন্ত। এই প্রসঙ্গে বিচারপতির মন্তব্য, ‘‘আর্থিক দুর্নীতি খুঁজে বার করুন।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি টাকার বিনিময়ে সুবিধা পাইয়ে দিয়েছেন, তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।’’ ইডির পাশাপাশি এই মামলার তদন্ত করবে সিবিআই। তারা চাইলে নতুন এফআইআর দায়ের করতে পারে। এই মামলায় বিচারপতির পর্যবেক্ষণ, প্রাথমিকের নিয়োগে পরিকল্পিত দুর্নীতি হয়েছে। যার নেপথ্যে রয়েছেন প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি মানিক ভট্টাচার্য। মানিক ছক কষে দুর্নীতি (ডিজাইনড্ কোরাপশন) করেছেন বলে পর্যবেক্ষণে জানান বিচারপতি।
শিক্ষা দফতরকে জরিমানা
২০১২ সালের একটি শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগে হওয়া মামলায় রাজ্যের শিক্ষা দফতরকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করলেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া (২০১২)-য় পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় কারচুপির অভিযোগ ওঠে। স্বজনপোষণের মাধ্যমে কয়েক জন প্রার্থী চাকরি পেয়েছিলেন বলে অভিযোগ। বিষয়টি হাই কোর্টে পৌঁছয়। আদালত ২০১৬ সালে শিক্ষা দফতরের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারিকে তদন্তের নির্দেশ দেয়। কিন্তু সাত বছর পেরিয়ে গেলেও সেই নির্দেশ এখনও কার্যকর হয়নি। বিষয়টি নিয়ে নতুন করে মামলা দায়ের হয় হাই কোর্টে। মামলাকারীর আইনজীবী তাঁর আবেদনে জানিয়েছেন, ২০১২ সালে পূর্ব মেদিনীপুরে যাঁরা স্বজনপোষনের মাধ্যমে চাকরি পেয়েছেন, তাঁদের নিয়োগ বাতিল করা হোক। একই সঙ্গে গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে আদালত যাতে তদন্তের নির্দেশ দেয়, সেই আবেদনও জানানো হয়। এই মামলাতেই রাজ্যের শিক্ষা দফতরকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর নির্দেশ, আগামী ১০ দিনের মধ্যে হাই কোর্টের ‘লিগ্যাল এড সার্ভিস’-এ ওই টাকা জমা দিতে হবে শিক্ষা দফতরকে। একই সঙ্গে আগামী ছ’সপ্তাহের মধ্যে তদন্ত শেষ করে প্রিন্সিপাল সেক্রেটারিকে জমা দিতে হবে রিপোর্ট। হাই কোর্ট তার পর্যবেক্ষণে জানিয়েছে, প্রিন্সিপাল সেক্রেটারির যদি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা না থাকে, তবে তাঁর পদত্যাগ করা উচিত।
মামলা গড়াল সুপ্রিম কোর্টে
একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষক নিয়োগের মামলায় উত্তরপত্র (ওএমআর শিট) দেখতে চেয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। তবে ওএমআর শিট প্রকাশের বিষয়ে এক সপ্তাহের অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ দিয়েছে শীর্ষ আদালত। গত ৭ জুলাই কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় নির্দেশ দিয়েছিলেন, ২০১৬ সালে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যে ৫,৫০০ জনকে চাকরি দেওয়া হয়েছিল, তাঁরা-সহ ওয়েটিং লিস্টে থাকা চাকরিপ্রার্থীদের উত্তরপত্র (ওএমআর শিট) প্রকাশ করতে হবে কমিশনকে। উত্তরপত্রের পাশাপাশি নাম, বাবার নাম, ঠিকানা, স্কুলের নাম-সহ ৯০৭ জনের তালিকাও প্রকাশ করতে হবে, যাঁদের বিকৃত উত্তরপত্র উদ্ধার করেছিল সিবিআই। মঙ্গলবার শীর্ষ আদালত ওএমআর শিট প্রকাশে অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ দিলেও নাম, ঠিকানা সম্বলিত তালিকা প্রকাশের নির্দেশ বহাল রেখেছে। চাকরিপ্রার্থী ববিতা সরকার হাই কোর্টে মামলা করেছিলেন। ববিতার আবেদন ছিল, একাদশ-দ্বাদশের বিস্তারিত তথ্য-সহ প্যানেল প্রকাশ পেলে কারা, কী ভাবে, কোথায় চাকরি পেয়েছেন তা পরিষ্কার হয়ে যাবে। যদি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রথম ২০ জনের মধ্যে দুর্নীতির কারণে কেউ চাকরি পেয়ে থাকেন তবে তাঁর শিক্ষিকা হওয়ার আবার সুযোগ আসবে। তার পরেই হাই কোর্টের বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় ওএমআর শিট প্রকাশের নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে হাই কোর্টে ডিভিশন বেঞ্চের দ্বারস্থ হন চাকরিপ্রার্থীরা। ডিভিশন বেঞ্চ বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশ বহাল রাখে। তখন এসএসসি এবং চাকরিপ্রার্থীরা সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন। সেই মামলাতেই ওএমআর শিট দেখতে চাইল সুপ্রিম কোর্ট। যদিও ওএমআর শিট প্রকাশের ব্যাপারে এক সপ্তাহের অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ দিয়েছে শীর্ষ আদালত।
বন্দির অধিকার: এপিডিআর
বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশে মঙ্গলবার রাতেই প্রেসিডেন্সি জেলে মানিক ভট্টাচার্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে গিয়েছে সিবিআই। এই বিষয়ে মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর-এর সাধারণ সম্পাদক রঞ্জিত শূর একটি বিবৃতিতে বলেন, “এই রাতে হাই কোর্টের নির্দেশ পেয়ে প্রেসিডেন্সি জেলে সিবিআই! বন্দি তো পালিয়ে যাচ্ছেন না, তাহলে রাতেই জিজ্ঞাসাবাদ কেন?” তিনি আরও বলেন, “বন্দিরও কিছু অধিকার থাকে। যা খুশি করা যায় না। ঘুমের অধিকারও মৌলিক অধিকার।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy