মানিক ভট্টাচার্য এবং বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
প্রাথমিকের নতুন মামলায় মানিক ভট্টাচার্যকে প্রেসিডেন্সি জেলে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে সিবিআইকে নির্দেশ দিলেন কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। একই সঙ্গে ইডির উদ্দেশে বিচারপতির নির্দেশ, এই মামলায় কোনও আর্থিক তছরুপ হয়ে থাকলে তদন্ত করতে পারবে তারা। প্রয়োজনে মানিককে হেফাজতে নিতে পারবে ইডি। মঙ্গলবার থেকেই তদন্ত শুরু করতে পারবে তারা। এই প্রসঙ্গে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘‘যে ব্যক্তি টাকার বিনিময়ে সুবিধা পাইয়ে দিয়েছেন, তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।’’ এই মামলার পরবর্তী শুনানি সন্ধ্যা ৬টায়।
সিবিআইয়ের সিটের প্রধান অশ্বিনী শেনভিকে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় নির্দেশ দিয়েছেন, ‘‘এই মামলাটি আইনজীবীদের কাছ থেকে দক্ষ অফিসারদের পাঠিয়ে বুঝে নিতে হবে মঙ্গলবারই। প্রেসিডেন্সি জেলে গিয়ে দক্ষ অফিসারদের মানিককে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে।’’ বিচারপতির মন্তব্য, ‘‘অন্য মামলায় সুপ্রিম কোর্ট মানিককে যে নির্দেশ দিয়েছিল, তা ৯ মাস ধরে বহাল রয়েছে।’’ মানিককে রক্ষাকবচ দিয়েছিল দেশের শীর্ষ আদালত। অর্থাৎ, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ ছিল, তদন্ত চালিয়ে গেলেও মানিকের বিরুদ্ধে কোনও কড়া পদক্ষেপ করতে পারবে না সিবিআই।
মঙ্গলবার হাই কোর্টে প্রাথমিকে নিয়োগ সংক্রান্ত একটি মামলা দায়ের হয়। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসে সেই মামলাটি ওঠে। মামলাকারী সুকান্ত প্রামাণিকের তরফে আইনজীবী ছিলেন দিব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়। ওই মামলায় বিচারপতির পর্যবেক্ষণ, প্রাথমিকের নিয়োগে পরিকল্পিত দুর্নীতি হয়েছে। যার নেপথ্যে রয়েছেন প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের তৎকালীন সভাপতি মানিক ভট্টাচার্য। মানিক ছক কষে দুর্নীতি (ডিজাইনড্ কোরাপশন) করেছেন। হাই কোর্টের নির্দেশে পর্ষদ সভাপতির পদ থেকে আগেই অপসারণ করা হয়েছিল মানিককে। পরে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। বর্তমানে তিনি প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগারে রয়েছেন। এই মামলায় মঙ্গলবার দুই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি এবং সিবিআইকে অবিলম্বে যুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়।
বিকেলে শুনানিতে এক ঘণ্টার মধ্যে সিবিআইয়ের সিট-প্রধানকে তলব করেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। এর প্রেক্ষিতে সিবিআইয়ের আইনজীবী জানান, সিটের প্রধান এখন শহরে নেই। তিনি দিল্লিতে রয়েছেন। এ কথা শুনে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় তাঁকে দিল্লি থেকেই ভার্চুয়াল মাধ্যমে শুনানিতে যোগ দিতে বলেন। বিকেল সাড়ে ৫টায় তাঁকে যোগ দিতে বলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। এর পর পরই ভার্চুয়াল মাধ্যমে যোগ দেন সিবিআইয়ের সিট-প্রধান। তার পরই মানিককে নিয়ে ওই নির্দেশ দেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়।
আগে যা হয়েছে
গত ১১ অক্টোবর শিক্ষক নিয়োগ-দুর্নীতি মামলায় প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান তথা বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্যকে গ্রেফতার করে ইডি। বয়ানে অসঙ্গতি এবং জেরায় অসহযোগিতার অভিযোগ এনে পলাশিপাড়ার বিধায়ককে গ্রেফতার করা হয়। তার আগে রাতভর জেরা করা হয়। সূত্রের খবর, ইডির তরফে তাঁকে যে সময়ে তলব করা হয়েছিল, সেই সময়ের অনেক পরে তিনি সিজিও কমপ্লেক্সে হাজির হন।
পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মামলায় ইডি যে চার্জশিট দিয়েছিল, তাতে মানিকের নাম ছিল। চার্জশিটে অভিযোগ আনা হয়েছিল যে, চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চাকরি দিয়েছিলেন মানিক। সেই খবর ছিল পার্থের কাছেও। কিন্তু পার্থ এই বিষয়ে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। ইডি সূত্রে খবর, প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ এবং প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান মানিকের মোবাইল বার্তা আদানপ্রদানের প্রমাণ রয়েছে তাদের হাতে। চার্জশিটেও এর উল্লেখ রয়েছে।
চার্জশিট জমা দেওয়ার পর মানিককে তলব না করা সত্ত্বেও ২১ সেপ্টেম্বর রাতে তিনি নিজেই ইডি আধিকারিকদের কাছে গিয়ে বিভিন্ন নথি জমা দিয়ে আসেন বলে সূত্রের খবর। সেই নথি ধরে তদন্ত চলছিল। ইডি সূত্রে খবর, মানিক যে নথি জমা দিয়েছিলেন, সেখানে একাধিক গরমিল রয়েছে।
মানিককে পর্ষদের চেয়ারম্যান পদ থেকে অপসারণের নির্দেশ দিয়েছিলেন হাই কোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। পাশাপাশি নিয়োগ দু্র্নীতি মামলায় সিবিআই তদন্তেরও নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। মানিক সেই সবক’টি নির্দেশের বিরুদ্ধেই সুপ্রিম কোর্টে পাল্টা আবেদন করেছিলেন। প্রাথমিকের শিক্ষক নিয়োগ-দুর্নীতি মামলায় শুনানি শেষ হলেও সুপ্রিম কোর্ট রায় ঘোষণা স্থগিত রাখে। পাশাপাশি শীর্ষ আদালত এ-ও জানিয়ে দিয়েছিল, প্রাথমিকের শিক্ষক নিয়োগ-দুর্নীতি মামলায় রায় ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত মানিককে কোনও ভাবেই গ্রেফতার করতে পারবে না সিবিআই। তবে, টেট মামলায় সিবিআই তদন্ত করার যে নির্দেশ কলকাতা হাই কোর্ট দিয়েছিল, তাতেও স্থগিতাদেশ দেয়নি দেশের শীর্ষ আদালত। শিক্ষক নিয়োগ-দুর্নীতি সংক্রান্ত নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মানিক সুপ্রিম কোর্টে গেলেও প্রাথমিকের শিক্ষা পর্ষদের নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে গৌতম পালকে নিয়োগ করে রাজ্য। গ্রেফতার হন মানিকও।
গত জানুয়ারি মাসে মানিককে জরিমানাও করেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। মালারানি পাল নামে এক পরীক্ষার্থী ৮ বছর ধরে প্রাথমিকে নিয়োগের পরীক্ষা (টেট)-র ফল জানতে পারেননি। সে কারণে পর পর ২ বার টেটে বসতে পারেননি তিনি। পরীক্ষার্থীদের কেরিয়ার নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের এই ‘দায়িত্বজ্ঞানহীনতা’র জন্য পর্যদের প্রাক্তন সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যকেই দায়ী করেছিল কলকাতা হাই কোর্ট। গত জানুয়ারি মাসে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় এই মর্মে পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি মানিককে দু’লক্ষ টাকা জরিমানা করেছিলেন। একই সঙ্গে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, মানিককে ওই অর্থ ১৫ দিনের মধ্যেই দিতে হবে। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় এ-ও জানিয়েছিলেন, পরীক্ষা দিয়ে ফল জানার অধিকার প্রত্যেক পরীক্ষার্থীর রয়েছে। কিন্তু পর্ষদের শীর্ষ পদে এমন এক ব্যক্তি ছিলেন বলেই এক পরীক্ষার্থী ফল জানতে পারেননি। সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মানিক ডিভিশন বেঞ্চে আবেদন করেছিলেন। ডিভিশন বেঞ্চে শুনানির জন্য মামলা ওঠার সময় বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে মানিকের আইনজীবী তাঁর দেওয়া নির্দেশ সংশোধন করার আর্জি জানিয়েছিলেন। কিন্তু তখন জরিমানার অঙ্ক দ্বিগুণ করে দেন বিচারপতি। ২ লক্ষ টাকার বদলে ৪ লক্ষ টাকা করা হয় জরিমানার অঙ্ক।
পরে অনুরূপ একটি মামলায় জরিমানার ৫ লক্ষ টাকা না মেটানোয় মানিকের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি হাই কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে এই নির্দেশ দেন। দেশে, বিদেশে মানিকের যত সম্পত্তি আছে, তা বাজেয়াপ্ত করতে হবে। জরিমানার অর্থ না মেটানো পর্যন্ত তাঁকে সম্পত্তি ফেরত দেওয়া হবে না।
৩৬ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি বাতিলের নির্দেশ দিতে গিয়ে মানিকের প্রসঙ্গ টানেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। ৩৬ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি বাতিলের নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। বিচারপতি জানান, ওই শিক্ষকদের নিয়োগ প্রক্রিয়ার সময় প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি ছিলেন মানিক। তাই নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়ার খরচ রাজ্য সরকার চাইলে মানিকের কাছ থেকে নিতে পারবে বলে নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়।
এ দিকে নিয়োগ দু্র্নীতি কী ভাবে হয়েছিল, আদালতে তা জানিয়েছিল ইডি। ইডির আইনজীবী দাবি করেছিলেন, ‘উত্তরপত্রে দু’টি প্রশ্নে দাগ দিলেই’ কাজ হত। ‘অযোগ্য’ প্রার্থীদের সে রকম ভাবে উত্তরপত্র জমা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। বাকি ওএমআর শিট বা উত্তরপত্র ফাঁকা রাখার নির্দেশ ছিল। ইডির দাবি, যুব তৃণমূল নেতা কুন্তল ঘোষকে জেরায় এই তথ্য উঠে এসেছে। মানিকের নজরদারিতেই এ সব চলত বলে অভিযোগ ইডির।
নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় নাম জড়ায় মানিকের স্ত্রী শতরূপা ভট্টাচার্য এবং ছেলে শৌভিক ভট্টাচার্যের। গত ২২ ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁদের গ্রেফতার করা হয়। ইডি মনে করে, নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তেই বিদেশে ঘুরেছিলেন মানিকের স্ত্রী এবং পুত্র। অনেক দিন ধরেই ইডির নজরে রয়েছে মানিক এবং তাঁর পরিবারের বিদেশভ্রমণ। তদন্তকারীদের মতে, বিদেশভ্রমণে প্রায় ৫ কোটি টাকা খরচ করেছে মানিকের পরিবার। যার অধিকাংশ খরচ করা হয়েছে নগদেই। কারণ, ব্যাঙ্ক থেকে বড়সড় কোনও লেনদেনের প্রমাণ পায়নি ইডি। ইডি সূত্রে খবর, ২০১২ সালের পর থেকে মানিকের পরিবারের সদস্যেরা বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেছেন। মানিকের পুত্র শৌভিক ভট্টাচার্য ইংল্যান্ড, আমেরিকা, মলদ্বীপ, মালয়েশিয়া-সহ একাধিক দেশে গিয়েছেন। কখনও শৌভিক একাই বিদেশে গিয়েছেন, কখনও গিয়েছেন সপরিবার। তাঁদের ভ্রমণের তালিকায় রয়েছে সুইৎজ়ারল্যান্ড, জামার্নির মতো ইউরোপের একাধিক দেশ। নাইজেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা এমনকি, চিনও রয়েছে তালিকায়। প্রায় প্রতিটি দেশেই দীর্ঘ দিন থেকেছেন তাঁরা। ইডি আধিকারিকদের একাংশের দাবি, তাঁদের কাছে এই সব ভ্রমণের উদ্দেশ্য স্পষ্ট নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy