বিভিন্ন সময়ে গোয়ান্দাদের হাতে আসা সালাউদ্দিনের ছবি। সংগৃহীত
কওসর-ইজাজ ধরা পড়লেও বহাল তবিয়তে রয়েছে ‘বড় ভাই’। কলকাতা পুলিশের নাকের ডগাতে থেকে যাওয়ার বহু দিন পর, জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) জঙ্গি গোষ্ঠীর ওই প্রধানের ডেরার হদিশ পেয়েছিল জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)।
কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ) থেকে শুরু করে এনআইএ-সহ অন্তত চারটি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এই বড় ভাই ওরফে সালাউদ্দিন সালেহিন-কে পাকড়াও করতে চাইছে। কিন্তু তার পরেও বার বার গোয়েন্দাদের পাতা জাল কেটে বেরিয়ে যাচ্ছে সে। শুধু গোয়েন্দাদের ধোঁকা দেওয়া নয়, একই সঙ্গে জায়গায় জায়গায় নতুন জেএমবি মডিউল তৈরি করে ছোট ছোট ব্যাচে অস্ত্র এবং বিস্ফোরক তৈরির প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করে চলেছে সালাউদ্দিন। গত সপ্তাহে এমনটাই জানতে পেরেছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দারা আরও জানতে পেরেছেন, বাংলাদেশের হাসিনা সরকার বিরোধী কয়েকটি ধর্মীয় সংগঠনের নেতৃত্বের একাংশ সরাসরি সাহায্য জোগাচ্ছে সালাউদ্দিনকে। তাদের হাত ধরেই এ দেশে নিরাপদ আশ্রয় পাচ্ছে বড় ভাই।
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা তিনটি আলাদা আলাদা ঘটনা এক সুতোয় জোড়া বলে মনে করছেন। সব ক’টি ঘটনাই গত তিন-চার মাসের। সম্প্রতি এসটিএফের হাতে সালাউদ্দিনের ঘনিষ্ঠ এক প্রথম সারির জেএমবি নেতা গ্রেফতার হয়। বীরভূমের বাসিন্দা মহম্মদ ইজাজ জেএমবি-র ভারতীয় শাখার প্রধান বলে দাবি করেছিলেন এসটিএফের গোয়েন্দারা। ইজাজকে জেরা করে হদিশ মিলেছিল তার তৈরি জেএমবি-র উত্তর দিনাজপুরের মডিউলের। পাকড়াও করা হয় ওই মডিউলের তিন সদস্যকে। কিন্তু তার পরও সালাউদ্দিনের গতিবিধি সম্পর্কে সাম্প্রতিক কোনও তথ্য পাননি গোয়েন্দারা। সূত্রের খবর, যা পাওয়া যাচ্ছে, সবই কয়েক মাসের পুরনো তথ্য। সেখান থেকেই গোয়েন্দাদের ধারণা— বেঙ্গালুরু এবং কেরলে নিয়মিত যাতায়াত রয়েছে সালাউদ্দিনের এবং সেখানেই কোনও জায়গায় গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে সে। এবং সেই ডেরা থেকেই দফায় দফায় রাজশাহির কয়েকটি প্রত্যন্ত গ্রামে ১০-১২ জনের ব্যাচে সদ্য যোগ দেওয়া জেএমবি জিহাদিদের অস্ত্র এবং বিস্ফোরক তৈরির প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে।
আরও পড়ুন: এ বার দিলীপকে ফোন শোভনের
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের একটি অংশের দাবি, রাজশাহি এক সময়ে ছিল জেএমবি-র সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাঁটি। এখনও সেখানে জেএমবি-র স্লিপার সেল রয়েছে। তাদের মাধ্যমেই চলছে প্রশিক্ষণ। গোয়েন্দাদের দাবি, প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর এরা কেউই ফের সালাউদ্দিনকে যোগাযোগ করছে না। এরা নিজেরাই ফের প্রশিক্ষকের ভূমিকা পালন করছে। তৈরি হচ্ছে নতুন মডিউল। প্রতিটি মডিউল একে অপরের থেকে সম্পূর্ণ ভাবে বিচ্ছিন্ন একটা নেটওয়ার্ক। ফলে একটি মডিউল ধরা পড়লে বাকি মডিউলের হদিশ মিলছে না। তেমনই মডিউলগুলি থেকে গোটা নেটওয়ার্কের মাথায় বসে থাকা সালাউদ্দিনের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ মডিউলগুলির সঙ্গে সালাউদ্দিনের যোগাযোগ একমুখি। সালাউদ্দিনই যোগাযোগ করতে পারে। অন্য দিক থেকে সরাসরি কেউ সালাউদ্দিনকে যোগাযোগ করতে পারে না।
গোয়েন্দাদের একটি সূত্র জানাচ্ছে, প্রাথমিক ভাবে জানা গিয়েছে, সম্প্রতি এ রাজ্য (পশ্চিমবঙ্গ) থেকে কিছু যুবক প্রশিক্ষণ নিয়েছে রাজশাহিতে। গোয়েন্দারা একটি ব্যাচ সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য জানতে পারলেও, তার আগে এবং পরে আরও কতজন যুবকের প্রশিক্ষণ হয়েছে, তা নিয়ে অন্ধকারে গোয়েন্দারা।
আরও পড়ুন: জোর করেই হাসপাতালে, বাড়ি ফিরতে ব্যাকুল বুদ্ধ
রাজশাহির ওই প্রশিক্ষণের ঘটনার সমসাময়িক আরও একটি ঘটনা চিন্তায় ফেলেছে গোয়েন্দাদের। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্তা বলেন, ‘‘ঠিক ওই সময়তেই কম পক্ষে ৫০ জন বাংলাদেশি যুবক পাসপোর্ট ভিসা নিয়ে অর্থাৎ বৈধ ভাবে ভারতে এসেছেন। তাঁরা প্রত্যেকেই গিয়েছেন বেঙ্গালুরু এবং তামিলনাড়ুতে। ভিসার আবেদনে তাঁরা জানিয়েছেন, দক্ষিণ ভারতে ঠিকাদারের অধীনে কাজ করতে যাচ্ছেন তাঁরা।”
ঢাকার শহরতলি থেকে ওই যুবকদের ভারতে ‘কাজের’ জন্য যাওয়া আপাতভাবে সামান্য ঘটনা হলেও, গোয়েন্দাদের চিন্তায় ফেলেছে তাঁদের অর্থনৈতিক অবস্থা-সহ অন্যান্য কিছু তথ্য। এক গোয়েন্দা কর্তা ব্যাখ্যা করেন, ‘‘এঁরা প্রত্যেকেই দিনমজুর পরিবার থেকে আসা। অথবা খুব ছোট চাষি। এঁরা প্রত্যেকে ভারতে যাওয়ার জন্য এক লাখ থেকে দেড় লাখ টাকা খরচ করেছেন, যা তাঁদের পরিবারের পক্ষে দেওয়া কার্যত অসম্ভব।”
তৃতীয় ঘটনাটিও সমসাময়িক। শ-তিনেক জেএমবি সদস্যের জেল থেকে মুক্তি। ২০০৫ সালে গোটা বাংলাদেশ জুড়ে ধারাবাহিক বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটিয়েছিল জেএমবি। সেই হামলারও অন্যতম মাথা ছিল সালাউদ্দিন। সেই হামলার পর বাংলাদেশ জুড়ে জেএমবি-র কয়েকশো সক্রিয় সদস্য গ্রেফতার হয়। সম্প্রতি সাজার মেয়াদ শেষে এ রকম প্রায় ৩০০ জেএমবি সদস্য জেল থেকে মুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশ পুলিশের নজরদারি এড়িয়ে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ওই জেএমবি সদস্যদের একটা অংশ ফের গা ঢাকা দিয়েছে। গোয়েন্দাদের আশঙ্কা, ওই গা ঢাকা দেওয়া জেএমবি সদস্যরা সীমান্ত পেরিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে তাদের সংগঠনের বিভিন্ন গোপন ডেরায়।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ওই তিনটি আলাদা আলাদা ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন বলে মনে করছেন না গোয়েন্দারা। তাঁদের আশঙ্কা, সালাউদ্দিন নয়া মডিউল তৈরি করে, পুরনো সঙ্গীদের মাধ্যমে বড় নাশকতার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু খোদ সালাউদ্দিনকে না ধরতে পারলে সেই নাশকতার ছকের হদিশ পাওয়া সম্ভব নয়। সালাউদ্দিনের হদিশ পেতে তাই তাকে যারা আশ্রয় দিচ্ছেন তাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করছেন গোয়েন্দারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy