ধর্নায় বসলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাজ করছেন অন্তর্বর্তীকালীন উপাচার্য বুদ্ধদেব সাউ। — নিজস্ব চিত্র।
এত দিন ছাত্ররা ধর্নায় বসতেন। কিন্তু যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বার ধর্নায় বসেছেন স্বয়ং উপাচার্য। ছাত্রদের বিরুদ্ধে তাঁর সেই ধর্নাস্থলে পৌঁছে দেখা গেল শান বাঁধানো মেঝের উপর চাদর পেতে উপুড় হয়ে শুয়ে রয়েছেন তিনি। তবে ওই ভাবেই প্রশাসনিক সইসাবুদের কাজও চালাচ্ছেন তিনি। মাস দুয়েকও হয়নি যাদবপুরের অন্তর্বর্তী উপাচার্যের দায়িত্ব নিয়েছেন বুদ্ধদেব সাউ। ছাত্রদের স্বার্থও দেখবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। উপাচার্যকে তাই প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘‘দু’মাসের মধ্যেই মত বদলাল? ছাত্রদের বিরুদ্ধে হঠাৎ ধর্নায় বসলেন কেন?” প্রশ্ন শুনে উপাচার্য বলেছেন, ‘‘চেয়ারে বসে যে সম্মান পাওয়ার, তা পাচ্ছিলাম না। তাই ধর্নায় বসেছি।’’
বুধবার রাতে ধর্নায় বসেছিলেন তিনি। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টা ৫ মিনিট নাগাদ অবস্থান প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।
গত অগস্ট মাস থেকে একের পর এক সমস্যা চলেছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্রমৃত্যুর ঘটনা, তার নেপথ্যে র্যাগিংয়ের অভিযোগ, কর্তৃপক্ষের গাফিলতি, ইউজিসির চোখরাঙানি, উপাচার্য নিয়োগ বিতর্ক, পুলিশ-তদন্ত-ছাত্র বিক্ষোভ সব মিলিয়ে গত দু’মাস ধরে ঘটনাবহুল যাদবপুর চত্বর। এর মধ্যেই যাদবপুরে নতুন দায়িত্ব নিয়ে অন্তর্বর্তিকালীন উপাচার্য বুদ্ধদেব জানিয়েছিলেন, তিনি যাদবপুরে প্রশাসনের হাল শক্ত হাতে ধরবেন, ছাত্রদের দাবি-দাওয়াও শুনে সমাধান করবেন। কিন্তু দু’মাস পরে সেই তিনিই বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ধর্নায় বসেন। তাঁর সঙ্গে ধর্নায় ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক বিধি নিয়ন্ত্রক সংগঠন এগজ়িকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্যরা। যাঁর মধ্যে ছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন অফ সায়েন্স সুবিনয় চক্রবর্তীও।
বুধবার যাদবপুরের এগজ়িকিউটিভ কাউন্সিল বা ইসির বৈঠক ছিল। সেই বৈঠকেই পড়ুয়ারা অধ্যাপক, উপাচার্য-সহ ইসির সদস্যদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন বলে অভিযোগ। যাদবপুরের অন্তর্বর্তিকালীন উপাচার্য জানিয়েছেন, ছাত্রেরা যে ভাষায় তাঁদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তা মুখে আনা যায় না। ওই কটুকথা শুনে তাঁদের আর ছাত্র বলে মনে করাও যায় না। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে খবর, ছাত্রদের কটুকথা এবং আক্রমণে অপমানিত বোধ করে প্রথমেই বৈঠক ছেড়ে বেরিয়ে আসেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন অফ সায়েন্স সুবিনয়। তার পরে একে একে বেরিয়ে আসেন অন্য সদস্যরাও। উপাচার্যও আর ছাত্রদের সঙ্গে বৈঠক করেননি। তার পরেই বুধবার রাত থেকে ছাত্রদের অসদাচরণের বিরুদ্ধে ধর্নায় বসেন ইসির সদস্যরা। বৃহস্পতিবার এ প্রসঙ্গে যাদবপুরের ডিন অফ সায়েন্সকে প্রশ্ন করা হলে তিনি সাফ বলে দিয়েছিলেন, ছাত্ররা যত ক্ষণ না এসে ক্ষমা চাইছেন, তত ক্ষণ এই ধর্না চালিয়ে যাবেন তিনি। তাতে যদি তাঁকে ১০ দিন বসে থাকতে হয়, তবে তা-ই থাকবেন।
ছাত্রদের আচরণ নিয়ে প্রকাশ্যে ক্ষোভপ্রকাশ করেছেন উপাচার্যও। তিনি বলেন, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য যে সমস্ত সুপারিশ রয়েছে, সেই সমস্ত সুপারিশ পালন করতে গেলেই ছাত্রদের সমস্যা। এখন বুঝতে পারছি, কেন এত দিন ওই সমস্ত সুপারিশ পালন করা যায়নি। কারণ এই ছাত্ররাই তা করতে দেননি।’’
যাদবপুরের ছাত্রদের জন্য ছাত্রাবাস আলাদা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল ইসির বৈঠকে। প্রথম বর্ষের জন্য আলাদা হস্টেল। এবং অন্যান্য বর্ষের জন্যও আলাদা আলাদা হস্টেল করার প্রস্তাব ছিল। কিন্তু ছাত্ররাই তা চাইছেন না বলে জানিয়েছেন উপাচার্য। তিনি বলেছেন, ‘‘উল্টে ওরা বলেছে হস্টেলের প্রতি ব্লক থেকে এক জন করে ছাত্র প্রতিনিধি রাখা হোক ইসিতে। ভাবুন তো। সেটা করলে কত জন ছাত্র প্রতিনিধি রাখতে হবে! সংখ্যাটা অন্তত ১৮ জনে গিয়ে দাঁড়াবে। আর ইসির মোট আসনসংখ্যাও ওরই কাছাকাছি। তা হলে আর আমরা কোথায় থাকব? আমাদের আর থাকার দরকারই বা কী?’’
উপাচার্য মতে, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কাজের উপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ পেতে চায় ছাত্ররা, সব উপাচার্যকে নিয়েই ওঁদের সমস্যা। তবে পছন্দ কোন উপাচার্যকে? যারা ওঁদের কথা মতো সই করে যাবে? এই চেয়ারে বসে সম্মান কোথায়? সম্মান নেই বলেই ধর্নায় বসেছি।’’ একই সঙ্গে উপাচার্য এ-ও বলেছেন যে, ‘‘আমি সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যকে বলব আপনারা ঠিক করে দিন, কী ভাবে এখানে কাজ হবে?’’
বৃহস্পতিবার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ধর্নারত ইসি সদস্যদের কথা জানা গেলেও অবশ্য এ ব্যাপারে ছাত্রছাত্রীদের প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। জুটা জানিয়েছে, তারা এ ব্যাপারে শিক্ষকদের পাশে। কখনওই শিক্ষকদের অপমান সমর্থন করবে না তারা। তবে একই সঙ্গে জুটার সহকারী সম্পাদক রাজেশ্বর সিংহ জানিয়েছেন, ‘‘কয়েক জন ছাত্রকে দিয়ে সমস্ত ছাত্রের মূল্যায়ন করা ঠিক হবে না। যাঁরা এই কাজ করেছেন, তাঁরা সংখ্যায় অল্প। যাদবপুরে ১৩ হাজার ছাত্রছাত্রী রয়েছেন। তাঁদের অধিকাংশই এমন ভাবেন না। তবে আশা করব ওই ছাত্রদেরও শীঘ্রই বোধোদয় হবে।’’
বৃহস্পতিবার যাদবপুরের ইসি সদস্যদের ধর্না নিয়ে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুও মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘ যাদবপুরে কী ঘটছে সেটা আমি খুব ভাসা ভাসা শুনেছি। ছাত্র-ছাত্রীরা আন্দোলন করতেই পারে। কিন্তু কোনও অধ্যাপককে চার অক্ষরে গালাগালি করা বা তুইতোকারি করাও কাম্য নয়। এটা আন্দোলনের কোনও বহিঃপ্রকাশ বা আন্দোলনের রাস্তা হতে পারে না। আমরাও ছাত্র বয়সে আন্দোলন করেছি। অধ্যাপকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি। কিন্তু কোনও অধ্যাপককে কখনও তুইতোকারি করা বা চার অক্ষর বা পাঁচ অক্ষরে গালাগালি দিইনি। সব শিক্ষককে যেমন শ্রদ্ধা করা যায় না, সে রকম সব ছাত্রকেও স্নেহ করা যায় না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy