Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
TMC and CPM

সাগরদিঘির পরে তৃণমূল কি সিপিএমের ‘পুনরুত্থান’ দেখছে? তাই কি আক্রমণের অভিমুখ বদল শাসকের?

বাংলার রাজনীতিতে অনেকটাই প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলেছে সিপিএম। কিন্তু সম্প্রতি শাসক তৃণমূল বিজেপির চেয়ে বেশি করে সিপিএমকে আক্রমণ করছে কেন বাম তথা সিপিএমকে?

Is TMC wants to highlight CPM to defend BJP

সিপিএমকে এত আক্রমণ কেন? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ মার্চ ২০২৩ ১৫:১৮
Share: Save:

সাগরদিঘি-উত্তর পর্বে ‘উদ্বিগ্ন’ হয়েই কি সিপিএমকে আক্রমণ করতে শুরু করেছে শাসক তৃণমূল? গত কয়েক দিন ধরে যে ভাবে বিভিন্ন সরকারি ক্ষেত্রে নিয়োগ দুর্নীতিতে তীব্র একমুখিতা নিয়ে পূর্বতন সিপিএম আমলকে আক্রমণ করতে শুরু করেছেন তৃণমূলের বিভিন্ন স্তরের নেতারা, তাতে রাজনীতিতে আলোচনা শুরু হয়েছে। জল্পনার মূল বিষয়— তৃণমূলের রাজনৈতিক আক্রমণের অভিমুখ কেন ঘুরে যাচ্ছে?

নিয়োগ দুর্নীতিতে শাসক তৃণমূল যখন ‘বেকায়দায়’, তখনই সিপিএম আমলের নিয়োগ নিয়ে প্রথম সরব হন মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলের সর্বময় নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনিই প্রথম বলেছিলেন, বাম আমলে ‘চিরকুট’ দিয়ে ব্যাপক নিয়োগ হয়েছিল। তার পরেই একে একে মুখ খুলতে শুরু করেন তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ, শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুরা। তাঁরা সরব হন সিপিএমের প্রাক্তন সাংসদ ও বিধায়ক সুজন চক্রবর্তীর স্ত্রীর কলেজে চাকরি পাওয়ার পদ্ধতি নিয়ে। উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী উদয়ন গুহ এক ধাপ এগিয়ে জানিয়ে দেন, তাঁর প্রয়াত পিতা বামফ্রন্টের কৃষিমন্ত্রী কমল গুহও এমন অনেক নিয়োগের সুপারিশ করেছিলেন। সিপিএমকে আক্রমণ করতে শুরু করেন বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকও।

তার মধ্যেই ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ ভাবে নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় ধৃত প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও আদালতে হাজিরার ফাঁকে সুজনকে নিয়ে সরব হন। সুজন এবং তাঁর স্ত্রী পাল্টা চ্যালেঞ্জ জানানোর পর ময়দানে নেমেছেন সিপিএমের প্রাক্তন নেতা সমীর পুততুণ্ড। ঘটনাচক্রে, সমীর যে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় সিপিএম রাজনীতি করতেন, সেখানে ‘ক্ষমতাসীন’ ছিলেন সুজনের শ্বশুর শান্তিময় ভট্টাচার্য। অনেকের মনে করেন, তাঁর সঙ্গে লড়াইয়ের ফলেই সমীর এবং তাঁর স্ত্রী অনুরাধা পুততুণ্ড সিপিএম ছেড়ে পিডিএস তৈরি করেন। তাঁরা সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলন পর্বে মমতার সঙ্গে ছিলেন। সিঙ্গুরে মমতার ধর্নামঞ্চেও হাজির ছিলেন সমীর। কালক্রমে তৃণমূলের সঙ্গে তাঁদের দূরত্ব বাড়ে। কিন্তু এই নিয়োগ দুর্নীতির বাজারে সমীর আবার আসরে অবতীর্ণ হয়েছেন।

সেই আক্রমণের সুর আরও চড়া করে মঙ্গলবার কুণাল টুইট করেছেন সিপিএমের যুবনেতা শতরূপ ঘোষের ২২ লক্ষ টাকার গাড়ি কেনা নিয়ে। সিপিএমের ‘হোলটাইমার’ হয়ে শতরূপ কী করে এত দামি গাড়ি কেনেন, সেই প্রশ্ন তুলেছেন কুণাল।

অনেকে বলছেন, সিপিএমকে ‘প্রাসঙ্গিক’ করে তুলতে এটি শাসক তৃণমূলের পরিকল্পিত উদ্যোগ। বিরোধী দল হিসাবে বিজেপির ‘একক গুরুত্ব’ কমাতেই ধারাবাহিক ভাবে সিপিএমকে আক্রমণ করছে তৃণমূল। পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিরোধী ভোট যাতে ভাগ হয়ে যায়, এটা তারই কৌশল। কিন্তু অন্য অনেকের বক্তব্য, এর সঙ্গে নিয়োগ দুর্নীতির সম্পর্ক নেই। বরং অনেক বেশি সম্পর্ক আছে সাগরদিঘির সাম্প্রতিক ফলাফলের। তাঁদের মতে, যদিও মাত্র একটি আসনে উপনির্বাচনের ফলাফল দেখে কোনও উপসংহারে পৌঁছনো যায় না, কিন্তু সাগরদিঘি অনেকগুলি সম্ভাবনার জন্ম দিয়ে গিয়েছে। তার মধ্যে একটি হল সিপিএম তথা বামেদের পুনরুত্থানের সম্ভাবনা। তাই বাম আমলের ‘নিয়োগ দুর্নীতি’ নিয়ে সিপিএমকে আক্রমণ করতে উঠেপড়ে লেগেছে তৃণমূল।

সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমেরও বক্তব্য, ‘‘তৃণমূল বাধ্য হয়ে আমাদের সমালোচনা করছে। কারণ, এটা ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে যে, তৃণমূলের বিকল্প হিসাবে মানুষ বিজেপি নয়, সিপিএমকে চাইছেন।’’ আবার বিজেপি মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী থেকে বিধায়ক, শিশু থেকে বিশু— সকলেই কোমাচ্ছন্ন সিপিএমকে জীবনদান করতে চাইছে। কিন্তু এখন সিপিএমের যেটা রয়েছে সেটা হল প্রাণহীন চঞ্চলতা।’’ আর তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষের ব্যাখ্যা, ‘‘এ সব কোনও দাবিই ঠিক নয়। এ রাজ্যে আগের শাসকের সমালোচনা করতে হলে তো বামেদের কথাই বলতে হবে। যেমন মধ্যপ্রদেশ নিয়ে বলতে গেলে বিজেপির ব্যাপক কেলেঙ্কারির কথা তো আসবে!’’

সিপিএম আমলের দুর্নীতি টেনে আনার যে ‘কৌশল’ তৃণমূল শুরু করেছে, তাতে এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বড় মোচড় প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ। সম্প্রতি আদালতে ঢোকার মুখে পার্থ বলেন, ‘‘যে সুজন চক্রবর্তী, দিলীপবাবু (ঘোষ), শুভেন্দুবাবুরা (অধিকারী) বড় বড় কথা বলছেন, তাঁরা নিজেদের দিকে দেখুন! সমস্ত জায়গায় তদ্বির করেছেন। কারণ, আমি তাঁদের বলেছি করতে পারব না! আমি নিয়োগকর্তা নই। এ ব্যাপারে কোনও সাহায্য তো দূরের কথা, আমি কোনও কাজ বেআইনি করতে পারব না।’’ ঘটনাচক্রে, তার ১৮ মিনিট আগে কুণাল যে টুইট করেছিলেন, তাতেও পার্থের বলা তিন জনের নামই ছিল। পাশাপাশিই নাম ছিল শমীক এবং ‘আরও কয়েক জন’-এর। কুণালের টুইটে লেখা ছিল, ‘‘শিক্ষায় নিয়োগ বিতর্ক: দিলীপ ঘোষ, সুজন চক্রবর্তী, শুভেন্দু অধিকারী, শমীক ভট্টাচার্য ও আরও কয়েক জন চাকরির সুপারিশ করেছিলেন কি? তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে অনুরোধ করেছিলেন কি? তদন্ত হোক। কেন্দ্রীয় এজেন্সি একমুখী কাজ না করে নিরপেক্ষ কাজ করুক।’’

তৃণমূলের নেতাদের একাংশও মেনে নিচ্ছেন যে, সাগরদিঘির উপনির্বাচনের ফলাফল রাজ্য রাজনীতিতে অনেকগুলি সম্ভাবনাও তৈরি করে দিয়েছে। যেমন ওই ফলাফল দেখে মমতাও বুঝতে পেরেছেন যে, সংখ্যালঘু ভোট পুরোপুরি তৃণমূলের সঙ্গে নেই। কিন্তু যে ব্যবধানে জিতেছেন বাম-কংগ্রেস প্রার্থী, তাতে এমনও হতে পারে যে, বিজেপির ভোটও বাম-কংগ্রেস জোটের প্রার্থীর বাক্সে গিয়েছে। সেই সূত্রেই অনেকে বলছেন, ‘সংখ্যালঘু’ হিসাবে নয়, সাগরদিঘির বড় অংশের ভোটারদের সঙ্গে মুসলিমরা ‘প্রতিষ্ঠানবিরোধী’ ভোট দিয়েছেন। যা শাসক শিবিরের কাছে উদ্বেগের। এই ধারা বজায় থাকলে আগামী বছর লোকসভা ভোটে বিপদের আশঙ্কা রয়েছে।

বস্তুত, অনেকে বলছেন, সাগরদিঘি-উত্তর পর্বে সিপিএম এবং কংগ্রেস যাতে ‘কাছাকাছি’ না থাকে, তার জন্য রাহুল গান্ধীর সাংসদ পদ খারিজ হওয়ার পর কংগ্রেসের ডাকা বিরোধী দলগুলির বৈঠকে প্রতিনিধিও পাঠিয়েছিল তৃণমূল। যা কিছু দিন আগেও ভাবা যেত না। একইসঙ্গে ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ যে, বুধ এবং বৃহস্পতিবার ‘মুখ্যমন্ত্রী’ হিসাবে বকেয়া কেন্দ্রীয় অর্থের দাবিতে মমতা রেড রোডে আম্বেদকর মূর্তির পাদদেশে যে ধর্নায় বসছেন, তা নিয়ে প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি তথা সাগরদিঘির জেলা মুর্শিদাবাদের বহরমপুরের সাংসদ অধীর চৌধুরীর বক্তব্য। মমতা ওই ধর্নার কর্মসূচি ঘোষণা করার পরে অধীর বলেছিলেন, দাবিতে যদি যথার্থতা থাকে, তা হলে তিনি তা সমর্থন করবেন। তারও আগে অধীরের অধীনস্থ আইনজীবী-নেতা কৌস্তুভ বাগচী মমতাকে ‘ব্যক্তি আক্রমণ’ করার পর অধীর তাঁকে নিরস্ত হতে বলেছিলেন। তৃণমূলের অনেকের মতে, এই ঘটনা পরম্পরাও ‘তাৎপর্যপূর্ণ’।

অন্য বিষয়গুলি:

TMC CPM
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE