চার দশকে বদল কতটা? ফাইল চিত্র
সময় মানে বদল। সেই সময়ও নাকি বদলাতে পারেনি পশ্চিমবঙ্গের সিপিএমকে! কিন্তু পারে না কি? অনেক কিছু বদলেছে ঠিকই। কিন্তু সমালোচকরা বলেন, সেই বদলটা এতই ক্ষীণ, যে দূরবিন দিয়ে দেখতে হয়!
একটা বদল অবশ্য এসেছে। ১৯৮২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সিপিএমের তৎকালীন রাজ্য সম্পাদক প্রমোদ দাশগুপ্ত হাঁপানির চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন চিনে। সেখানে চিকিৎসাই ছিল লক্ষ্য। কিন্তু বেজিংয়েই সে বছর ২৯ নভেম্বর মৃত্যু হয় তাঁর। সেই দিনটার ৪০ বছর পার। গত চার দশকের দীর্ঘ সময় ধরে সেই ‘আদর্শের শব’ বহন করে এসেছে সিপিএম। বলা হত, সামান্য সর্দিজ্বর হলেও তখন সিপিএম নেতারা চিনে বা রাশিয়ায় যেতেন। সময়ের এখন এতটা বদল যে, চিকিৎসার জন্য চিন তো দূরের কথা, বিদেশে যাওয়ার কথাও ভাবা হয় না।
তবে সেই সময়ে প্রমোদবাবুকে শুধুই চিকিৎসার জন্য চিনে নিয়ে যাওয়া হয়নি বলে দাবি করেন সিপিএমের বর্তমান রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। তাঁর কথায়, ‘‘সেই সময়ে চিনের সঙ্গে আমাদের পার্টির সম্পর্কের পুনরুদ্ধার পর্ব চলছিল। সেই কারণে ওঁকে যেতেই হত।’’ অবশ্য চিকিৎসার জন্য গেলেও রাজনীতিকরা একটা লোকদেখানো সরকারি কর্মসূচি খাড়া করেন। সে তিনি যে দলেরই হোন না কেন। যেমন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী আমেরিকায় গিয়েছিলেন চিকিৎসার জন্য। তবে তখন তিনি ভারতের ইউএন প্রতিনিধি দলের সদস্যও ছিলেন বটে।
তবে এটা অনস্বীকার্য যে, ভারতের চিকিৎসার মান এখন আগের চেয়ে অনেক উন্নত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। কোনও কোনও জটিল ক্ষেত্রে বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজন হয় শুধু ভারতে উপযুক্ত যন্ত্রপাতি নেই বা থাকলেও চিকিৎসকদের সেগুলি ব্যবহার করার অভিজ্ঞতা নেই বলে। চিকিৎসার জন্য অধুনাপ্রয়াত অরুণ জেটলি আমেরিকায় গিয়েছিলেন। গিয়েছিলেন সনিয়া গান্ধীও। চোখের জটিল চিকিৎসার জন্য আমেরিকা যাওয়া ছাড়া তৃণমূল নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়েরও উপায় ছিল না।
তখন সরকারের মুখ জ্যোতি বসু, সংগঠনের প্রমোদ দাশগুপ্ত। — ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
তবে চিকিৎসা কেন, বিদেশের কোনও বিষয়েই সিপিএমের এখন মাথাব্যথা নেই। আগে ময়দানে জনসভা ডাকা হত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য। রসিকতা রয়েছে— বিমান বসুর ধমকের ভয়েই আমেরিকা আফগানিস্তান থেকে পালিয়েছে!
আরও কিছু বদল চোখে পড়ার মতো। একটা সময়ে বিদেশি ‘লাল পতাকা’ ছাড়া বাকি সব কিছুকে ব্রাত্য করে রাখা সিপিএম জাতীয় পতাকা তুলতে অভ্যস্ত হয়েছে। রাজ্য থেকে পাড়ার পার্টি অফিসে ১৫ অগস্ট পালনের ধুম দেখা যাচ্ছে। চলতি বছরে তো পশ্চিম বর্ধমানের পাণ্ডবেশ্বরে সিপিএমের পার্টি অফিসে জাতীয় পতাকা তুলতে তৃণমূল বিধায়ককে ডাকার মতো ঘটনাও ঘটেছে। ইদানীং সিপিএম নেতারা প্রকাশ্যে ঠাকুরদেবতাকে ধূপধুনো না দিলেও তাঁদের পুজোর মণ্ডপে যাওয়ায় মন হয়েছে।
কিন্তু কেন এমন হল? দলের লোকেরাই বলছেন, আসলে সেই রামের সঙ্গে সেই অযোধ্যাও যেমন নেই, তেমনই সেই সিপিএমও আর নেই। তাই কিছু কিছু বদল আনতেই হয়েছে। শুধু সংসদে, বিধানসভায় আসনসংখ্যা কমে যাওয়ার জন্য নয়। বদলটা এসেছে আকারের সঙ্গে প্রকারেও। বাংলার সিপিএমকে দেখলেই বোঝা যায়, সেলিমদের দল এখন অনেক অন্তর্মুখী। বিদেশ তো দূরের কথা, জাতীয় রাজনীতি নিয়েও তেমন আগ্রহ নেই। সে সব আছে থাক। এক সময়ে কিউবার জন্য পথে-নামা বাংলা সিপিএম এখন কাশ্মীর নিয়েও ততটা ভাবে না। নেতাদের বক্তৃতায় একটু-আধটু উঠে এলেও সেখানেই শেষ। সে সবের থেকে সেলিমরা মনে করেন, পরের থেকে ঘর ভাল। মন আর শক্তির যেটুকু বেঁচে আছে, তা নিজের রাজ্যে কাজে লাগানোই ভাল। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে কথা বলাটাকে এখন ‘মিছিমিছি’ মনে করা হয়। সেলিম বলেন ‘‘জো বাইডেনের (আমেরিকার প্রেসিডেন্ট) নামে কিছু বললে যদি এই রাজ্যে পঞ্চায়েতে দু’টো আসন পাওয়া যেত তবে বলতাম।’’
প্রমোদ দাশগুপ্ত স্মরণে জ্য়োতি বসুর পাশে বিমান বসু। — ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
কেরল কিন্তু চিরকালই অন্তর্মুখী। আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের ধারণা, এর একটা প্রধান কারণ, পিনারাই বিজয়নরা নিয়মিত ভাবে নির্বাচনে জেতেন। দ্বিতীয় বার জেতার পরে মুখ্যমন্ত্রী বিজয়নের রাজনৈতিক জমি এখন যথেষ্ট পোক্ত। সেই সুযোগে ‘জাতশত্রু’ প্রকাশ কারাটকে রাজনীতি থেকে প্রায় অবসর নিইয়ে ফেলিয়েছেন। কারাটের কাছে এখন ত্রিবান্দ্রমের দরজা কার্যত বন্ধ। তাই তিনি দিল্লির দফতরে নিয়ম মেনে আসেন। দলের ইংরেজি মুখপত্রে ইংরেজি ভাষায় নিবন্ধ লেখেন। বলা বাহুল্য, সেই সেই নিবন্ধ নিয়ে বাংলা বা কেরলের কোনও কমরেডেরই আগ্রহ নেই। কোথাও সিপিএম সদস্য বা কর্মীদেরও আগ্রহ নেই।
‘কেরল লাইন’ বলে আগে একটা কথা ছিল। সেই কেরল লাইন আসলে ছিল ‘কারাট লাইন’। কট্টরপন্থী, আপসহীন বাম রাজনীতি। কারাটের নির্বাসনের সঙ্গে সঙ্গে কেরলও অনেকটা মুক্তি পেয়েছে। সমাজবাদ নিয়ে আগ্রহ তাদের আগেও ছিল না, এখন আরও নেই। উল্টে দ্বিতীয় বার জয়ী হওয়ার পরে অনেকটা না হলেও খানিকটা শিল্পায়নের পথে এসেছে কেরলের পার্টি। সেই অর্থে কেরল এখন ‘ফিকে বাংলা লাইন’ গ্রহণ করেছে। বাংলা ও কেরল সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে লড়াই ভুলেছে। ইউক্রেন বা বাইডেন নয়, পঞ্চায়েত জয় তাদের আসল লক্ষ্য। বাংলার আশা-আকাঙ্ক্ষাই বেশি গুরুত্ব পায় সেলিমদের কাছে। তিনি বলেন, ‘‘আসলে অর্থনীতিতে বিশ্বায়ন হলেও সমাজ ও রাজনৈতিক দর্শন এখনও স্থানীয়। পুরনো পথ ছেড়ে আমরা তাই ‘থিঙ্ক গ্লোবাল, অ্যাক্ট লোকাল’ নীতি নিয়েছি। বাংলার গ্রামের অবস্থা কেমন সে দিকে নজর ঘোরাতে হয়েছে সময়ের দাবি মেনেই।’’
অতীতে যে বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে বেশি মাথা ঘামানো হত, সেটা কেন এখন আর কার্যকরী নয়, তার জন্য অন্য আরও যুক্তি রয়েছে সেলিমের। তিনি বলেন, ‘‘একটা সময়ে আমাদের মুশকিল হয়েছিল যে, সবাই আমেরিকার প্রেসিডেন্টের নাম জানে। অথচ ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রীর নাম জানে না। বিদেশি রাষ্ট্রনায়কের কুকুরের নাম জানা থাকলেও অসমের মুখ্যমন্ত্রীর স্ত্রীর নাম কারও জানা ছিল না। কিন্তু এখন সময় বদলেছে। ঘরের দিকে বেশি করে নজর দিতে হবে। এমনকি, হিন্দি ভাষার আগ্রাসন থেকে রক্ষা পেতে বাংলার ভাষার জন্যেও লড়তে হবে। নিজেদের নাচ, গান-সহ নানা সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য বজায় রাখার লড়াইটাও দরকার।’’
দলের আকারের সঙ্গে প্রকারেও এসেছে বদল। ফাইল চিত্র।
৪০ বছরে দল যে আরও অনেক ক্ষেত্রে বদলেছে, সেটাও স্বীকার করেন সেলিম। কেমন ছিল সেই সময়? ১৯৬৪ সালে রাজ্য সম্পাদক হয়েছিলেন প্রমোদ দাশগুপ্ত। সেই পদে ছিলেন আমৃত্যু। তাঁর হাত ধরেই ১৯৭৭ সালের ‘ঐতিহাসিক জয়’। তখন বামফ্রন্টেরও চেয়ারম্যান প্রমোদবাবু। সরকারের স্টিয়ারিং হাতে পাওয়ার পরে জ্যোতি বসু হয়ে ওঠেন রাজ্য সিপিএমের প্রধানতম মুখ। কিন্তু সংগঠনের হাল ধরে ছিলেন প্রমোদবাবুই। আবার বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যখন রাজ্যের মুখ, তখন দলের মুখ অনিল বিশ্বাস। সংগঠনই শেষ কথা। তার বাইরে কিছুই করার ক্ষমতা ছিল না মুখ্যমন্ত্রীদের। ইচ্ছার বিরুদ্ধেও জ্যোতিবাবুকে মেনে নিতে হয়েছিল প্রাথমিক পাঠ্যক্রম থেকে ইংরেজি বাদ দেওয়া। নিজের কলেজ প্রেসিডেন্সির শিক্ষক নিয়োগ নিয়েও ইচ্ছামতো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি বুদ্ধদেব।
বুদ্ধদেব রাজ্যে শিল্পায়ন শুরু করেন পলিটব্যুরোর অনুমোদনের পরে। তবুও পুরনোপন্থীরা বলতেন, প্রমোদবাবু বেঁচে থাকলে শিল্পায়ন নিয়ে এতটা নাচানাচি করতে দিতেন না। অবশ্য বুদ্ধদেব বলতেন, ‘‘প্রমোদ’দা প্র্যাক্টিক্যাল লোক ছিলেন। সময়ের সঙ্গে তিনি নিজেকেও পরিবর্তন করতেন।’’ আবার এ-ও ঠিক যে, প্রমোদবাবুর সময় থেকেই প্রশাসনিক ক্ষেত্রের সিদ্ধান্তও সংগঠনের হাতে নেওয়ার চল তৈরি হয় রাজ্যে। যা পরে অনিল মেনে চলেছেন। পরে তৃণমূলের ক্ষেত্রেও মুকুল রায় বা অভিষেক সেটাই করেন বলে অভিযোগ। যদিও শাসকদল কখনওই তা স্বীকার করে না। উল্টে উড়িয়েই দেয়।
প্রমোদবাবুর সময়ের সিপিএম যে এখন আর নেই, তা নিয়ে অনেকে হা-হুতাশ করতেই পারেন। কিন্তু সেলিম মনে করেন এ-ও সময়েরই দাবি। তাঁর কথায়, ‘‘তখন দল নতুন করে ক্ষমতায় আসছে। নতুন নতুন জায়গায় জয় পাচ্ছে। ফলে আন্দোলনে অংশগ্রহণ অনেক স্বতঃস্ফূর্ত ছিল। কিন্তু পরের দিকে টানা ক্ষমতায় থাকার সময় স্বতঃস্ফূর্ততা কমে গিয়ে সেটা অনেক সংগঠিত হতে শুরু করে। এখন দেখছি, সেই পুরনো দিন ফিরে আসছে। আবার আন্দোলনে স্বঃতস্ফূর্ত যোগদান দেখতে পাচ্ছি।’’
এখন সিপিএম সময়ের সঙ্গে বদলাচ্ছে বলে সেলিম দাবি করলেও তেমন মনে করছেন না দলের দুই প্রাক্তন নেতা। সিপিএম ছেড়ে বিজেপিতে আসা শিশির বাজোরিয়া যেমন বলছেন, ‘‘বিজেপির চাপে জাতীয় পতাকা তোলা বা পুজোর মতো অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করছে সিপিএম। তবে বাকি কিছু বদলায়নি। কোনও কালেই সিপিএম ভারতের দল হতে পারেনি। যে কোনও দফতরে গেলে দেখবেন বিদেশি নেতাদের ছবি ঝুলছে। এখনও জাতীয় সঙ্গীত নয়, ‘ইন্টারন্যাশনাল’ গাওয়া হয়। সময়ের সঙ্গে বদলাতে পারেনি বলেই তো সময় ওদের ছেড়ে চলে গিয়েছে।’’
একই রকম কথা বললেন এককালের দাপুটে সিপিএম নেতা হলদিয়ার লক্ষ্মণ শেঠ। প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ কংগ্রেস, বিজেপি দুই দলই করে ফেলেছেন। যে দলকে প্রথম জীবনের ব্রত করেছিলেন তার নিন্দায় ঝাঁঝালো আক্রমণ করে লক্ষ্মণ বলছেন, ‘‘সিপিএম বদলাতে পারেনি। জাতীয় পতাকা উত্তোলন তো ছোটখাটো ব্যাপার। কিন্তু বাকি ক্ষেত্রে সময়োপযোগী করা যায়নি। মূল কারণ, যাঁরা নেতৃত্বে রয়েছেন তাঁদের ভাবনার দুর্বলতা। চিন্তাশক্তির খুবই দৈন্য। নেতৃত্ব গঠন হয় অগণতান্ত্রিক ভাবে। প্রতিভাবান, সৃজনশীল মানুষের অভাব রয়েছে। ফলে নতুন কোনও ভাবনা আসে না।’’
তবে অতীতের নেতারাও প্রতিভাবান ছিলেন না বলে মনে করেন লক্ষ্মণ। তাঁর কথায়, ‘‘ঘটনাচক্রে ওঁরা দলের নেতৃত্বে থেকে গিয়েছিলেন। কিন্তু কেউই প্রতিভাবান ছিলেন না। কারও কোনও সৃজনশীলতা ছিল না।’’ বস্তুত, প্রমোদবাবুর চিনে চিকিৎসা করাতে যাওয়া বা বিভিন্ন বিষয়ে বিদেশের লাভক্ষতি দেখে চলার নীতিও ভুল ছিল বলে মনে করেন লক্ষ্মণ। তাঁর বক্তব্য, ‘‘এই দেশের মাটিতে কী চাষ ভাল হবে, সেটা বাইরে থেকে শেখা যায় না। কোনও কিছু আমদানি করা যায় না।’’
তৎসত্ত্বেও সেলিমের দাবি— বদল এসেছেই! আসছে! আরও আসবে! কতটা? সময় ছাড়া আর কে বলবে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy