এই রাজ্যে “শিল্প সব সময়ই রাজনৈতিক বিরোধের বর্শার লক্ষ্য হয়ে থেকেছে।” মত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিল্প পরিচালকের। ফাইল চিত্র।
প্লেন ভাড়া করে বিনিয়োগ উড়িয়ে আনতে গেলে বোধহয় চন্দ্রবাবু নায়ডুর উত্তরসূরি হতে হয়। আর না হলে পশ্চিমবঙ্গের মতো বসে থাকতে হয় হাতে পেন্সিল নিয়েই। এই মন্তব্য পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ করতে অনেকটা এগিয়েও পিছিয়ে যাওয়া ভারতের এক বড় ইস্পাত সংস্থার শীর্ষ আধিকারিকের।
কেরলের কিটেক্স গোষ্ঠীর তিন হাজার ৫০০ কোটি টাকার বস্ত্র উত্পাদন প্রকল্পকে তেলঙ্গানা যে ভাবে জিতে নিল, সেই প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনাতেই নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিল্প পরিচালকের এই উক্তি। ১৯৯৫-৯৬ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গের বিনিয়োগ টানার দৌড়ে সঙ্গে থেকে এখন হাল ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। তাঁর আক্ষেপ একটাই, বিনিয়োগে অগ্রগণ্য রাজ্যগুলিতে রাজনৈতিক দলগুলি কখনই শিল্পায়নের উপর নিজেদের বিরোধের প্রভাব ফেলতে দেয়নি। কিন্তু তাঁর কথায়, এই রাজ্যে “শিল্প সব সময়ই রাজনৈতিক বিরোধের বর্শার লক্ষ্য হয়ে থেকেছে।”
কেরলের কিটেক্স গোষ্ঠীর সাবু জেকব যে দিনই তাঁর প্রস্তাবিত প্রকল্প সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা ঘোষণা করেন সে দিনই মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়ে তামিলনাড়ু, কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশ আর তেলঙ্গানা। জেকব যখন তামিলনাড়ুতে যাবেন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন, তখনই হায়দরাবাদ থেকে ভাড়া করা বিমান কোচি বিমানবন্দরে হাজির তাঁকে উড়িয়ে নিয়ে আসতে। লক্ষ্য অবশ্যই সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ। এর মধ্যে তেলঙ্গানার শিল্পমন্ত্রী কেটি রামা রাও টেলিফোনে জেকবের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে গিয়েছেন যাতে অন্য কোনও রাজ্য এই বিনিয়োগ ছিনিয়ে না নিতে পারে। পারেওনি। ওয়ারাঙ্গেলের কাকাতিয়া টেক্সটাইল পার্কের জমিতেই কিটেক্সের বিনিয়োগের প্রথম পর্ব। প্রতিশ্রুতি চার হাজার কর্মসংস্থানের। প্রাথমিক বিনিয়োগ হাজার কোটি।
জেকবের দাবি, কেরলের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নের আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও তাঁর দলীয় সহকর্মীরা তাঁদের মান্ধাতার আমলের মনোভাব বদলাতে রাজি নন। তাঁর আরও দাবি, এই ভাবে চললে কেরল শিল্পে শ্মশান হয়ে যাবে।
মাথায় রাখতে হবে জেকবের কিন্তু টোয়েন্টি ২০ (টোয়েন্টি টোয়েন্টি) নামে রাজনৈতিক দলও আছে এবং স্থানীয় রাজনীতিতে জায়গাও করে নিয়েছে তাঁর দল। বিরোধীদের বক্তব্য, জেকব যতটা না শিল্পনীতির বলি, তার থেকেও বড় বলি রাজনীতির। প্রসঙ্গত বলে রাখা যাক, জেকবের সিদ্ধান্তের ১০ দিনের মধ্যেই কেরলে টিকার কারখানা খোলার আগ্রহ দেখিয়েছে রাশিয়া।
দেশের সংবাদমাধ্যমে বিনিয়োগ টানার গল্পে অবশ্য পশ্চিমবঙ্গ শেষ পাতেও নেই। অনেক কষ্টে জায়গা তৈরি করেও সেই জমি হারিয়েছে এই রাজ্য।
জ্যোতি বসুর জামানার শেষের দিকে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে শিল্প নিগমের শীর্ষে বসিয়ে বিনিয়োগ বিরোধিতার নাম ঘোচাতে যে প্রয়াস শুরু হয়েছিল, তা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মুখ্যমন্ত্রিত্বে একটা নির্দিষ্ট মাত্রা পায়। সব্যসাচী সেন, জিডি গৌতম, ডিপি পাত্রের মতো সচিবরা বিনিয়োগকারীদের অফিসে গিয়ে হাজির হচ্ছেন। বিনিয়োগই তখন পাখির চোখ। ‘ভাবমূর্তি’ শব্দটি তখন আঞ্চলিক সংবাদমাধ্যমে বোধহয় সব থেকে বেশি ব্যবহৃত।
“চন্দ্রবাবু নায়ডু গুগলের বিনিয়োগ টানতে অনেক আগেই আলোচনা শুরু করেন। গুগল ভারতে বিনিয়োগ করতে পারে এই সম্ভাবনা দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ যখন সবে তার বিনিয়োগ-বিরোধী তকমা ঘুচিয়ে নতুন বিনিয়োগ টানতে পদক্ষেপ করছে, তখনই টাটা মোটরসের বিনিয়োগ রাজ্যের রাজনীতির বলি হয়ে গেল।” বললেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক টাটার একটি সংস্থার অবসরপ্রাপ্ত ডিরেক্টর। এ রাজ্যের শিল্পবিরোধী ভাবমূর্তি বদলানোর প্রয়াসে উদ্যোগীদের অন্যতম এই প্রাক্তন কর্তার গলায় বেশ হতাশাই। মাথায় রাখতে হবে, শুধু গুগল নয়, চন্দ্রবাবুর আমলে তাঁর রাজ্যে ঘর বেঁধেছিল মাইক্রোসফট, আইবিএমের মতো অন্যান্য বড় সংস্থাও। চন্দ্রবাবু সাইবার সিটি পরিকল্পনা করেছিলেন এদের কথা মাথায় রেখেই।
কিটেক্স প্রসঙ্গে ওই অবসরপ্রাপ্ত কর্তার মন্তব্য, “প্রায় প্রতিটি দক্ষিণী রাজ্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এই লগ্নি টানতে।” এদের মধ্যে যে সব থেকে বেশি সুযোগ দিতে পারবে সে-ই জিতবে। এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা তো লড়াইতেই নেই।”
শিল্পপতি রমাপ্রসাদ গোয়েঙ্কার পুত্র এবং আরপিজি এন্টারপ্রাইজের কর্ণধার হর্ষবর্ধন গোয়েঙ্কা কলকাতায় মানুষ। তাঁর কথায়, “সাম্প্রতিক কালে বিনিয়োগ টানার নির্ধারক হিসেবে উঠে এসেছে রাজনৈতিক স্থিরতা, ব্যবসা করার সুবিধা, এবং নীতির স্থিরতা। ভারতের অনেক রাজ্যই এখন দ্রুত এগোচ্ছে এক জানলা ব্যবস্থা-সহ নানান শিল্প সহায়ক ব্যবস্থা নিয়ে।”
পশ্চিমবঙ্গও যে এ পথে হাঁটছে না তা নয়। মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্প সহায়ক নানান ব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট দফতরগুলি করছে। কিন্তু বাম জামানার শেষ ভাগে যে বিনিয়োগ টানার রাজনৈতিক ইচ্ছা শিকড় গেড়ে বসছিল, টাটা মোটরসের চলে যাওয়া তা সমূলে উপড়ে ফেলে। আর শিল্পমহল জোর দিচ্ছেন এটার উপরেই। “আমরা তো আবার কেঁচে গণ্ডুষ করতে চলেছি। বিনিয়োগকারীরা এখন এ রাজ্যে পা দেবে কেন সহজে, যখন অন্তত সাতটি রাজ্য পরিকাঠামো সাজিয়ে, শিল্পবান্ধবের প্রমাণিত তকমা নিয়ে বসে রয়েছে? আমরাই তো যুদ্ধটা কঠিন করে তুলেছি।” মন্তব্য এক প্রবাসী বর্ষীয়ান শিল্প পরিচালকের, যিনি বুদ্ধবাবুর জমানায় মার্কিন মুলুক থেকে এত ঘন ঘন কলকাতায় আসতেন যে সংশ্লিষ্ট মহল তাঁকে ঠাট্টার ছলে ‘হপ্তা বাবু’ বলতে শুরু করেন।
কিন্তু হর্ষবর্ধন গোয়েঙ্কার প্রথম শর্তটিই যে আমরা পূরণ করতে পারি তাই প্রমাণ করে উঠতে পারেনি রাজ্যের রাজনীতি। আর বড় বিনিয়োগ টানতে না পেরে রাজ্যের অর্থনীতির নির্ভরশীলতা বাড়ছে অসংগঠিত শিল্পের উপর। অর্থনীতিবিদরা এ নিয়ে চিন্তিত। জিএসটি-র জামানায় করের উত্স কমে গিয়েছে তাও যেমন ঠিক, তেমনই অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় রাজস্ব বাড়ানোর যে সব উপায় এখনও আছে তার সদ্ব্যহারও সে ভাবে পশ্চিমবঙ্গ করতে পারছে না বলে নীতি আয়োগ ও ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট কলকাতার এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে।
রাজস্ব না থাকলে শিল্পকে ছাড় দেওয়ারও রাস্তা কমে আসে। বড় বিনিয়োগ টানাও কঠিন হয়ে পড়ে। বামফ্রন্টের সময়ও শিল্প টানার ক্ষেত্রে ভাবমূর্তি, রাজনৈতিক সদিচ্ছা, দক্ষ শ্রমিকের অভাবকে বিনিয়োগের অন্যতম প্রতিবন্ধক বলে নির্দিষ্ট করেছিল শিল্পমহল। এখনও সেই একই প্রতিবন্ধকতা রাজ্যের পায়ে বেড়ি হয়ে রয়েছে। “বাম আমলে তবুও আলিমুদ্দিনে বললে স্থানীয় সমস্যা মিটত। এখন সর্বোচ্চ মহলে বললেও স্থানীয় রাজনৈতিক উৎপাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না”— পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ শুরু করেও গুটিয়ে পালানো এক শিল্পসংস্থার কর্তার হতাশ উক্তি।
কিন্তু নেড়া কতবারই বা বেলতলায় যাবে? এরই মাঝখানে আলোকরেখা হল বেদান্ত গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান অনিল আগরওয়ালের বক্তব্য। কয়েক সপ্তাহ আগে বণিকসভা ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্সের বার্ষিক সাধারণ সভায় তাঁর দাবি, “রাজ্যে নতুন সরকার গঠন হওয়ার পক্ষকালের মধ্যেই আমার সঙ্গে বিনিয়োগ করার অনুরোধ নিয়ে যোগাযোগ করা হয়।” এর বেশি তিনি আর কিছু বলেননি।
বাকিরাও জনসমক্ষে রাজ্যের বদনাম ঘুচিয়ে বিনিয়োগবান্ধব হতে কী প্রয়োজন তা বলতে নারাজ। রাজ্য থেকে ব্যবসা গোটানো এক বিনিয়েগকারী বললেন “যত দিন আমরা নিজেদের মন্তব্য প্রকাশ্যে করতে অস্বস্তিতে থাকব, তত দিন কিন্তু ভাবমূর্তি নিয়ে সমস্যাটা রাজ্যের থাকবেই।” বিনিয়োগ গুটিয়েছেন কিন্তু অস্বস্তিটা ঝেড়ে ফেলতে পারছেন না। আর এটাই এখনও বিনিয়োগ টানার পথে প্রথম কাঁটা বলে মনে করেন শিল্পমহল।
বড় বিনিয়োগ নেই। রাজস্ব বাড়ানোর রাস্তা নেই। দক্ষ শ্রমিক তৈরির শিক্ষায়তন নেই। রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে মুক্তি নেই। এ রকম হাজারও ‘না’-কে উপড়ে ফেলে পারবে কি পশ্চিমবঙ্গ বিনিয়োগ বিরোধী বদনাম ঘোচাতে? প্রশ্ন এখন সেটাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy