নিজের বাড়িতে পরিজনের সঙ্গে বশিরুল। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়
কলকাতায় ফিরেছেন বারো ঘণ্টারও বেশি গিয়েছে। কিন্তু কুলগ্রামে জঙ্গি হানার তিন দিন পরেও সেই আতঙ্কের প্রহর ভুলতে পারছেন না বশিরুল সরকার। এসএসকেএম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় থেকে-থেকেই শিশুর মতো কাঁদছেন ট্রমা কেয়ারের ২০ নম্বর শয্যার ওই রোগী। তিনি যে বেঁচে আছেন, সেটাই যেন বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না! বৃহস্পতিবার রাতে যখন বাড়িতে ফিরলেন, তখনও কান্না আর আতঙ্ক তাঁর সঙ্গী।
৯ অক্টোবর কাশ্মীরের কুলগ্রাম এলাকার কাতরাসুতে আপেল বাগানে ঠিকা শ্রমিকের কাজ করতে যান বশিরুল। সঙ্গে ছিলেন কামিরুদ্দিন শেখ, রফিকুল শেখ, রফিক শেখ, মুরসালিম শেখ, নইমুদ্দিন শেখ এবং জহিরুদ্দিন শেখ। ২৪ তারিখে কাজ সেরে সন্ধ্যায় ভাড়া বাড়িতে ফিরে আড্ডায় জমিয়েছিলেন তাঁরা। এ দিন কথাগুলোর বলার সময় বশিরুলের চোখের সামনে যেন ভেসে উঠছিল সেই সন্ধ্যা। পরনে মলিন চেক শার্ট। বাঁ হাতের দিকটা ছেঁড়া। প্যান্টও মলিন। কবে থেকে ওই পোশাক পরে আছেন, বলতে পারছেন না। এসএসকেএম সূত্রের খবর, কলকাতা বিমানবন্দরে নামার পরে তাঁর অবস্থা দেখে ভোর ৩টে নাগাদ বশিরুলকে ট্রমা কেয়ারে নিয়ে আসে পুলিশ।
এ দিন সকালে নাম ধরে ডাকতে লাল চাদর সরিয়ে উঠে বসলেন বশিরুল। কী হয়েছিল সেই সন্ধ্যায়? বশিরুল বলেন, ‘‘ডেরায় আড্ডার মধ্যেই রাতের খাবারের জন্য ভাত আনতে যাই আমি। সঙ্গীরা ঘরেই ছিল। ভাতের পাত্র ঘরে এনে দেখি, কেউ নেই। ভাতের পাত্র রেখে ওদের খোঁজে রাস্তায় বেরোলাম। এক দোকানদার বলল, ‘‘ভাগো ভাগো।’’ কিছু না-বুঝে যাঁর কাছে কাজ করছিলাম, তাঁর বাড়ি গেলাম। ওঁর ঘরে সবে বসেছি, বাইরে শুরু হল ফায়ারিং।’’ ‘ফায়ারিং’ শব্দটা বলেই থমকে গেলেন যুবক। একটু পরে বললেন, ‘‘ফায়ারিং হয়ে গেল!’’
সব চুপচাপ হয়ে যেতেই বেরিয়ে সঙ্গীদের রক্তাক্ত দেহ দেখতে পান বশিরুল। সেই আতঙ্ক কাটিয়ে উঠতে পারেননি। মনোরোগ চিকিৎসকদের পরিভাষায় যার নাম ‘রিলিভিং অব দ্য ট্রমা’। এ দিন বশিরুলের অস্থিরতা স্পষ্ট অনুভব করা যাচ্ছিল। যেন কী করবেন, খুঁজে পাচ্ছেন না। কাঁদতে কাঁদতে কখনও বলছেন, ‘‘আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দাও। বাড়ি যাব। বাড়িতে আমার বুড়ি মা রয়েছে।’’ কখনও দাবি করছেন, কামিরুদ্দিন, রফিকুলদের মৃতদেহের সঙ্গেই তাঁকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হোক। কর্তব্যরত স্বাস্থ্যকর্মীরা বোঝানোর চেষ্টা করেন, তাঁর সঙ্গীদের দেহ মুর্শিদাবাদের বাহালনগরে চলে গিয়েছে। শুনে বশিরুল বললেন, ‘‘এত ক্ষণে নিশ্চয়ই পৌঁছে গিয়েছে।’’
বশিরুলের মানসিক সঙ্কটের বিষটি ‘ইনস্টিটিউট অব সাইকায়াট্রি’ বা আইওপি-তে জানানো হয়েছিল। বেলা ১টা নাগাদ তাঁকে দেখতে ট্রমা কেয়ারে আসেন আইওপি-র অধিকর্তা প্রদীপ সাহা। ‘‘রোগী সাইকোলজিক্যাল ট্রমায় আছে। এটাকে ‘বিরিভমেন্ট স্টেজ’ বলে। শরীরে আঘাত না-থাকলেও মানসিক দিক থেকে সে মর্মাহত। পরে এটা পোস্ট ‘ট্রমাটিক ডিসঅর্ডারে’ পরিণত হতে পারে।’’ তা যাতে না-হয়, সেই জন্য আইওপি-তে দু’দিন চিকিৎসাধীন থাকার পরামর্শ দেন প্রদীপবাবু। কিন্তু রোগী নারাজ। বশিরুলের ভাই সাবিরুল সরকার বললেন, ‘‘সাংসদের কাছে প্রথম জানতে পারি, দাদা এসএসকেএমে রয়েছে। প্রথমে ভেবেছিলাম, দাদারও বোধ হয় চোট লেগেছে। এখানে পৌঁছে দাদাকে দেখে স্বস্তি পেলাম।’’ জেনারেল সার্জারির বিভাগীয় প্রধান মাখনলাল সাহা বলেন, ‘‘রোগীর কোনও শারীরিক আঘাত ছিল না। তবে প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন ছিলেন। ইনস্টিটিউট অব সাইকায়াট্রিতে ভর্তি করার কথা বলা হয়েছিল। রোগী রাজি নন। তাই বিকেলে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।’’
বাড়ি যত কাছে আসছে, অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছিল বশিরুলের। গাড়ি থেকে নামতেই কান্না। বেঁচে ফেরার আবেগ যেন ঝরে পড়ল অশ্রুধারায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy