মুম্বইয়ে ‘ইন্ডিয়া’র বৈঠকের একটি মুহূর্ত। ছবি: সংগৃহীত।
বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র বৈঠকে আসন সমঝোতার ফর্মুলা নিয়ে মতানৈক্য তৈরি তৃণমূল এবং বামেদের মধ্যে। মুম্বইয়ের বৈঠকে শুক্রবার উপস্থিত একটি সূত্রের দাবি, লোকসভা ভোটে আসন সমঝোতা নিয়ে তৃণমূলের সেনাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফর্মুলায় স্পষ্ট আপত্তি জানান সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। তাঁকে সমর্থন করেন সিপিআইয়ের সাধারণ সম্পাদক ডি রাজা। বিহারের কয়েকটি দলের নেতাও সীতারাম এবং রাজার পাশে দাঁড়ান। যদিও বৈঠকের পর সাংবাদিক সম্মেলনে রাহুল গান্ধী বলেন, নিজেদের মধ্যে মতানৈক্য অনেকটাই কমিয়ে আনা গিয়েছে।
জোটের বৈঠকে উপস্থিত একটি সূত্রের খবর, বাংলার শাসক দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, লোকসভা ভোটে আসন সমঝোতা কী ভাবে হবে, তা ঠিক করুক ‘ইন্ডিয়া’। অর্থাৎ, গোটা প্রক্রিয়াটাই হোক ‘কেন্দ্রীয় স্তরে’। সেই ফর্মুলায় তীব্র আপত্তি জানিয়ে সীতারাম জানান, আসন সমঝোতা কখনও কেন্দ্রীয় স্তরে হতে পারে না। এক একটি রাজ্যের পরিস্থিতি এক এক রকম। এক একটি রাজ্যের বাস্তবতা এক এক রকম। ফলে রাজ্য স্তরে সেই মতোই আসন সমঝোতা হবে। সীতারামকে খোলাখুলি সমর্থন করেন রাজা। এর পর বিহারের বেশ কয়েক জন নেতাও বৈঠকে জানান, কখনওই ‘ইন্ডিয়া’ সারা দেশের আসন সমঝোতা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। তা রাজ্য স্তরেই করতে হবে।
লোকসভা ভোটকে সামনে রেখে শুক্রবার ‘ইন্ডিয়া’ যে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম ‘রাজ্যওয়াড়ি’ আসন সমঝোতা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, বিজেপি-বিরোধী ভোট এক জায়গায় আনার ক্ষেত্রে জোটভুক্ত সমস্ত দলকে ইতিবাচক ভূমিকা নিতে হবে। তৃতীয়ত, চেষ্টা করতে হবে, যাতে পদ্ম শিবিরকে একের বিরুদ্ধে এক লড়াইয়ের মুখোমুখি করা যায়। প্রথম সিদ্ধান্তটি বলছে, ‘রাজ্যওয়াড়ি’ আসন সমঝোতা করার উপরেই সিলমোহর পড়েছে।
ঘটনাপ্রবাহ বলছে, মুম্বইয়ে জোটের বৈঠক শেষে যে যৌথ সাংবাদিক সম্মেলন হয়েছিল, সেখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা অভিষেককে দেখা যায়নি। অনেকের বক্তব্য, বৈঠকে মতপার্থক্যের জন্যই তাঁরা ছিলেন না যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে। পক্ষান্তরে, মমতা-অভিষেক অনুপস্থিত থেকে ওই সিদ্ধান্ত থেকে খানিক ‘দূরত্ব’ রচনা করতে চেয়েছেন। যদিও ওই অভিমতের কোনও আনুষ্ঠানিক সমর্থন মেলেনি। বরং উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনার মুখপাত্র সঞ্জয় রাউত বলেন, “মমতার বিমান ধরার তাড়া ছিল। তাই তিনি সাংবাদিক বৈঠকে থাকতে পারেননি।”
বিজেপি বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র বৈঠকের শুরুতে বৃহস্পতিবার তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘‘সময় নষ্ট করার মতো সময় নেই।’’ শুক্রবার বৈঠক শেষে ‘ইন্ডিয়া’ও তেমনটাই বলল। মুম্বইয়ে ‘ইন্ডিয়া’র বৈঠক থেকে তিনটি মূল প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। যার মধ্যে দিয়ে লোকসভা ভোটের লক্ষ্যে জোটের আগামী কর্মসূচির একটি নকশাও আন্দাজ করা যাচ্ছে। ২৮টি অ-বিজেপি দল ‘ঐক্যবদ্ধ ভাবে’ তিনটি বিষয় চূড়ান্ত করেছে। এক, রাজ্যে রাজ্যে দ্রুত আসন সমঝোতা সেরে ফেলতে হবে। দুই, ১৪ সদস্যের সমন্বয় কমিটি ‘ইন্ডিয়া’র পরবর্তী কাজকর্ম দেখভাল করবে। যে কমিটিতে রয়েছেন তৃণমূলের ‘সেনাপতি’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও। এবং তিন, ‘ইন্ডিয়া’র স্লোগান হবে, ‘জুড়েগা ভারত, জিতেগা ইন্ডিয়া’।
পাশাপাশি, চারটি পৃথক কমিটিও ঘোষণা করা হয়েছে ‘ইন্ডিয়া’র তরফে। সংবাদমাধ্যম, সামাজিক মাধ্যম, গবেষণা ও প্রচার সংক্রান্ত কমিটিতে রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিনিধিরা রয়েছেন সেখানে। ১৪ জনের যে মূল সমন্বয় কমিটি সেখানে সিপিএমের জন্য একটি জায়গা ফাঁকা রয়েছে। শিবসেনা নেতা সঞ্জয় রাউত বলেন, ‘‘সীতারাম ইয়েচুরি বৈঠকে বলেছেন, পরে তাঁদের দলের তরফে নাম দেওয়া হবে।’’ তবে সীতারাম কেন নিজে রইলেন না, তা নিয়ে জল্পনা তৈরি হয়েছে।
মুম্বইয়ের বৈঠক শেষে শিবসেনার তরুণ নেতা আদিত্য ঠাকরে ওই তিন প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার কথা ঘোষণা করেন। সেই সঙ্গে উদ্ধব-পুত্র বলেন, রাজ্যে রাজ্যে জনসমাবেশ করবে ‘ইন্ডিয়া’। এখানেই রাজনৈতিক মহলে কৌতূহল তৈরি হয়েছে, জোটের স্লোগান ‘জুড়েগা ভারত, জিতেগা ইন্ডিয়া’ কি আদৌ পশ্চিমবঙ্গে বাস্তবায়িত হবে? প্রসঙ্গত, শুক্রবার যখন মুম্বইয়ে প্রত্যয়ের সঙ্গে রাহুল গান্ধী বলেছেন, সবাই মিলে একসঙ্গে লড়লে বিজেপি হারবে, তখন প্রায় একই সময়ে ধূপগুড়ি উপনির্বাচনে সিপিএম প্রার্থীর হয়ে প্রচারে গিয়ে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি তথা লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতা অধীর চৌধুরী বিজেপি-তৃণমূলকে একই বন্ধনীতে ফেলে আক্রমণ শানিয়েছেন।
বাংলার কংগ্রেস এবং সিপিএম খোলাখুলিই বলছে, এ রাজ্যে তৃণমূলের সঙ্গে তাদের জোট হবে না। কয়েক সপ্তাহ আগে অধীরই এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘‘পুকুর এবং নদীর মধ্যে ফারাক আছে। আমার কাছে বাংলা হল পুকুর। আর ভারত হল নদী। আমি যেটা বলতে চাই, সেটাই বলি। পিছন থেকে কথা বলি না।” তিনি জাতীয় স্বার্থের কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন, তাঁদের এখন পুকুরের কথা ছেড়ে নদীর কথা ভাবতে হবে। যা নিয়ে বিস্তর জল্পনা তৈরি হয়েছিল। বুধবার কাকভোরে দিল্লিতে রাহুলের সঙ্গে অভিষেকের বৈঠকের পর থেকে বঙ্গ কংগ্রেসের যাঁরা তীব্র তৃণমূল-বিরোধী তাঁদের অনেকেই আরও বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন। শুক্রবার অধীরের বক্তৃতা তাঁদের মধ্যে আবার আশার সঞ্চার ঘটিয়েছে। ফলে বাংলায় ‘ইন্ডিয়া’র ঐক্য থাকবে কি না, তা নিয়ে সংশয় থাকছেই। আবার অনেকের মতে, রাজনীতিতে কিছুই অসম্ভব নয়। কে ভেবেছিল ২০১৬ সালে কলকাতায় একমঞ্চে সভা করবেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আর রাহুল? এ বারই বা কে বলতে পারে রাজ্যে সব বিবাদ ভুলে ‘মূল শত্রু’ চিহ্নিত করে মমতা, মহম্মদ সেলিম একমঞ্চে দাঁড়াবেন না? সিপিএম অবশ্য বলছে, তার কোনও সম্ভাবনা নেই।
‘ইন্ডিয়া’র বৈঠকে মমতা
শুক্রবার বৈঠকে ঢোকার আগে মমতা বলেছিলেন , ‘‘যা আলোচনা হওয়ার ভিতরে হবে। এখন কিছু বলব না। তবে, আমরা যা করব দেশের ভালর জন্য করব।’’ বৈঠক শেষে সাংবাদিক বৈঠকে ছিলেন না মমতা। শিবসেনার সঞ্জয় বলেন, বিমান ধরার জন্য তৃণমূলননেত্রীকে আগে বেরিয়ে যেতে হয়েছে। সাংবাদিক বৈঠকের আগে বেরিয়ে গিয়েছিলেন সমাদবাদী পার্টি নেতা অখিলেশ যাদবও।
অভিষেক ‘ইন্ডিয়া’র সমন্বয় কমিটিতে
মুম্বইয়ের বৈঠক থেকে ১৪ জনের সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাৎপর্যপূর্ণ, কাউকে আহ্বায়ক করা হয়নি। সেই কমিটিতে তৃণমূলের তরফে রয়েছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক। বিষয়টিকে জাতীয় রাজনীতির আঙিনায় অভিষেকের ‘উত্তরণ’ হিসাবেই দেখছেন অনেকে।
ইডি-সিবিআই নিয়ে সতর্ক করলেন খড়্গে
লোকসভা ভোটের আগে আরও সক্রিয়তা বাড়াতে পারে সিবিআই, ইডির মতো কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলি। বিরোধী নেতাদের নিশানা করে তল্লাশি অভিযান বাড়তে পারে। হতে পারে আরও গ্রেফতারির ঘটনাও। ‘ইন্ডিয়া’র বৈঠকে শুক্রবার এ ভাবেই সতর্ক করেছেন কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গে। তাঁর কথায়, ‘‘পটনা এবং বেঙ্গালুরু বৈঠক দেখে বিজেপির আশঙ্কা বেড়েছে। তাই কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলিকে ব্যবহার করে আক্রমণের মাত্রা বাড়ানো হবে। বিজেপির এই প্রতিহিংসার রাজনীতির মোকাবিলায় আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।’’
ইসরোকে অভিনন্দন ‘ইন্ডিয়া’র
চন্দ্রযান ৩-এর সাফল্যের জন্য ইসরোকে অভিনন্দন জানিয়ে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে ‘ইন্ডিয়া’র বৈঠকে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘‘চন্দ্রযান-৩ সারা দুনিয়াকে রোমা়ঞ্চিত করেছে।’’ সেই সঙ্গে এ-ও বলা হয়েছে, ছয় দশকের বেশি সময় ধরে ইসরো মহাকাশ গবেষণা নিয়ে কাজ করে চলেছে। অনেকের মতে, ‘ইন্ডিয়া’ মনে করিয়ে দিতে চেয়েছে, ইসরো আজকের প্রতিষ্ঠান নয়।
কে কী বললেন
রাহুল গান্ধী শুক্রবার সাংবাদিক বৈঠকে লাদাখ সীমান্তে চিনা ফৌজের আক্রমণ ও আদানি ইস্যুতে তীব্র সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর। নাম না-করে আদানি প্রসঙ্গে সরব হন শিবসেনা (ইউবিটি) নেতা উদ্ধবও। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী তথা ডিএমকে প্রধান এমকে স্ট্যালিন শুক্রবার সাংবাদিক বৈঠকে বলেন, ‘‘আমরা সকলেই আলাদা আলাদা রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি। কিন্তু আজ আমরা এক মঞ্চে এসেছি। কারণ একটাই— দেশকে বাঁচাতে হবে। ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, বহুত্ববাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকে রক্ষা করতে হবে।’’ আপ নেতা অরবিন্দ কেজরীওয়ালের কথায়, ‘‘আমাদের ‘ইন্ডিয়া’ শুধু ২৭-১৮টা দলের জোট নয়, দেশের ১২৬ কোটি জনতার জোট। একবিংশ শতকের ভারতকে নির্মাণ করাই আমাদের উদ্দেশ্য।’’ আরজেডি প্রধান লালুপ্রসাদের কথায়, ‘‘দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিপদের মুখে। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় আঘাত হানছে মোদী সরকার। সেই সরকারকে সরিয়েই আমরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলব।’’ সিপিএম সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি জানান, মূলত রাজ্য স্তরেই হবে আসন ভাগাভাগির প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের জোট বাড়ছে। আরও দু’টি দল এসেছে। আগামী দিনে রাজ্যস্তরে আসন সমঝোতা নিয়ে আলোচনা হবে। আমাদের সকলের একটাই উদ্দেশ্য— ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং ভারতীয় সংবিধানের সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে রক্ষা করা।’’
ধূপগুড়িতে অধীরের নিশানায় মোদী-দিদি
ধূপগুড়ি উপনির্বাচনে সিপিএম প্রার্থীর হয়ে প্রচারে গিয়েছিলেন অধীর। সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের উপস্থিতিতে বহরমপুরের কংগ্রেস সাংসদ বলেন, ‘‘সারা দেশে লুট করছে মোদীর বিজেপি। আর রাজ্যে লুট করছে দিদির তৃণমূল।’’ তাঁর কথায়, ‘‘বিধানসভায় এখন শুধু বিজেপির সাম্প্রদায়িকতা আর তৃণমূলের সন্ত্রাস। এই দুই শ্বাপদের দলকে হারান। সন্ত্রাস আর সাম্প্রদায়িকতার মাঝে প্রগতিশীল নিশ্বাস ফেলার সুযোগ দিন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy